ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদের ভবিষ্যৎ



"ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদের ভবিষ্যৎ"


সময়ের দাবিকে মেনে নিয়ে পৃথিবীতে অনেক কিছু ব্যবস্থারই পরিবর্তন হয়েছে এবং আজও হয়ে চলেছে। এই পরিবর্তন কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের জীবন-জীবিকায় ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আজ বিশ্বব্যাপী করোনা সমস্যার পেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমাদের জীবনযাপনের অনেক ব্যবস্থারই পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য হয়েছি। শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। একটা জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। জ্ঞান, মেধা ও মননে আধুনিক চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতি একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।আধুনিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান করে নিয়েছি প্রযুক্তি। যা আজ শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ- কম্পিউটার ও অন্যান্য বৈদ্যুতিন মাধ্যম। সেজন্য সমগ্র বিশ্বে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্লাসরুমের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তির হাত ধরে এসে গেছে ঘরের মধ্যে। ডিজিটাল পদ্ধতি লেখাপড়ার চলকে একধাক্কায় অনেকখানি এগিয়ে দিল করোনা নামক বিশ্বত্রাসী ভাইরাস। 
শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কারণ মানবসম্পদ তৈরি না হলে দেশের অন্যান্য সম্পদ অনুৎপাদিত হয়ে পড়বে। তার ফলে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র অচল হয়ে যাবে।অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
প্রাচীনকাল হতে গুরুগৃহ- আশ্রম, টোল, মোক্তবের  হাত ধরে আজ স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে। আজ ভাইরাস রোগের প্রতিষেধক হচ্ছে পারস্পরিক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার। যা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন মতেই সম্ভব নয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সময় দাবি করছে অনলাইন পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা। তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যম সহ পরিপূরক অনেক মাধ্যম এগিয়ে এসেছে। সরকারও সমন্বয় সাধন করে আগ্রহ প্রকাশ করছে। কম্পিউটার, মোবাইল, টেলিভিশন শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বিদেশ সহ আমাদের দেশেও এর উদ্যোগ এক দশক আগেই শুরু হয়েছে এখন সেটি আরও ত্বরান্বিত হল এবং হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল। এই মুহূর্তে নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তাহলে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে এটাই কি ভবিষ্যৎ হবে? 
শিক্ষা শুধুমাত্র কতকগুলি তত্ত্ব তথ্য ও জ্ঞান গ্রহণ নয়। শিক্ষার্থীর মধ্যে নির্দিষ্ট পাঠক্রমের বাইরে এসে শিক্ষকের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে স্নেহ, ভালোবাসা, মমতার স্পর্শে নতুন নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটানো। কৌতূহলী মন 'কেন' প্রশ্নের মাধ্যমে নব নব আবিষ্কার করবে। দেশ সমৃদ্ধ হবে। শিক্ষা কোন বাজারি বস্তু নয় তাকে কিনে নিয়ে স্বেচ্ছাধীন প্রয়োগ ও ব্যবহার করা যাবে। এটা হল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দ্বিমুখীন পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া। এখানে উভয় পক্ষই শেখে। যে ব্যবস্থায়- 'আমাকে আমার মত থাকতে দাও' কে অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকে রক্ষা করে সেখানে সামাজিক স্বার্থ খর্ব হতে বাধ্য। এর ফলে শিক্ষার্থীর সমাজ বিচ্ছিন্ন মানসিকতা তৈরি হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার আড়ালে বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয়। এই আপৎকালীন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ডিজিটাল শিক্ষার মাধ্যম যেন স্থায়ী দূরত্ব তৈরি করে না বসে- সে ব্যাপারে আমাদের সতর্কীকরণ এর প্রয়োজন আছে। তাছাড়া আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের কাছে ডিজিটালের নতুন নতুন প্রযুক্তি পৌঁছায়নি। এই ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে চালু হলে আর্থিকভাবে উন্নত পরিবারের শিক্ষার্থীরাই এই ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে। বাকিরা বঞ্চিত থাকবে। পিছিয়ে পড়া অংশ আরো পিছিয়ে পড়বে। তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাতেও বাজারি অর্থনীতির স্বেচ্ছাধীন বিনিময় এর মতো তত্ত্ব আরও অটুট ভাবে জাঁকিয়ে বসবে। বাজারি ব্যবস্থায় এই ডিজিটাল পদ্ধতি কে গ্রহণ করার জন্য আমাদের সামনে কতগুলো কথা হাজির হবে যথা প্রথমত- এটি একটি কম ব্যয় সাপেক্ষ আধুনিকতম ব্যবস্থা। দ্বিতীয়- ক্লাস রুমে না গিয়ে নিজের মতো করে মোবাইলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে পাঠ গ্রহণ করা যাবে। নির্দিষ্ট ভাবে নিজের সুবিধামতো সময়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। রোগ প্রতিরোধক 'সামাজিক দূরত্ব' সত্যিকারের সামাজিক দূরত্বের স্বীকৃতি লাভ করবে। ব্যক্তি, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বার্থপর জীবন-যাপনে আরো বেশি বেশি করে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। সামাজিক সম্পর্ক বর্জিত এমন একটি শিক্ষণ পদ্ধতি যা মানুষ তৈরি না করে এক একটি যন্ত্র মানুষ তৈরি করবে। সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে এই কৌশলগত সামাজিক দূরত্ব মানুষের সঙ্গে মানুষের ও প্রকৃতির মধ্যে পাঁচিল তুলে স্থায়ী দূরত্ব তৈরি করে ফেলবে। এই মুহূর্তে আমরা পথপ্রদর্শক চিন্তানায়ক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা স্মরণ করতে পারি- 'যতটুকু আবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনে ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎ পরিমাণে আবশ্যক শৃংখলে বদ্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎ পরিমান স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলেই চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে।' 
ভবিষ্যতের কালগর্ভেই এর উত্তর লুকিয়ে আছে । 
               


প্রবন্ধকার লক্ষণ দাস ঠাকুরা     
                    সুকান্তপল্লী, পূর্ব বর্ধমান






0 Comments