শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থের নিবন্ধ


শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির মূলে

মাট কালো আস্তরণের দুই প্রান্তে শিশু ও শ্রমিক বিপরীতার্থ শব্দ দুটি একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে। বুঝতে পারি শত চেষ্টাতেও পিছু আর ছাড়েনা,এই কঠিন শিশু শ্রমিকের ব্যাধি।

এতো জাঁকজমক করে নির্মূলিকরণের প্রচার করেও পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? শিশু শ্রমিক হয়ে ওঠার জন্য দায়ী কারা? 

আমরা আকাশ-পাতাল যুক্তি,প্রতি যুক্তি দিয়ে ভরিয়ে তুলি,কিন্তু মাটির ছোঁয়াটিও থাকে না। আমরা কেউ গোড়ায় গলদ বুঝতে পারি না।কেউ  শিশুটির একান্ত আপনজন যারা,সেই বাবা-মায়ের কঠগড়ায় দাঁড় করাই না কেন?

আমার এই নিবন্ধে আপাতত মায়েদের খানিকটা ছেড়ে রাখলাম। তার অনেক সংগত কারণ আছে।যেমন:যতই নারীমুক্তির কথা বলিনা কেন,প্রকারান্তরে নারীরা পুরুষ শাসিত সমাজে বন্দিনী হয়ে আজও।নানা ভাবে তাদের পায়ে বেড়ি পরানো হয়েছে।

মনুসংহিতায় পাই :শৈশবে পিতার,যৌবনে স্বামীর,বার্ধ্যক্যে পুত্রের অধীনতার কথা। তা ছাড়া প্রশংসায় বেঁধেছি 'সংসার সুখের হয়, রমণীর গুনে 'পুরুষের গুন থাকার প্রয়োজন নেই।জড়তায় বেঁধেছি 'লজ্জা নারীর ভূষণ' নির্লজ্জ পুরুষের পৌরুষের গর্ব। আবার অসতী প্রমাণ করতে বলি 'নারী নরকের দ্বার' আর পুরুষেরা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে অকৃতদার রইল আমৃত্যু।এমন মূল্যবান মিথ্যা তথ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

সন্তানসন্ততির প্রতি মায়েদের দায়িত্ব বোধের কথায় বলি 'মা ছেঁয়ড়ে পার নেই' কথাটা অনেকাংশে সত্য। কিন্তু এখানে,তবে বলি কি মায়েদের ঘাড়ে  সব দায় দায়িত্ব তুলে দিয়ে এক শ্রেণির পুরুষ সমাজ আর এড়িয়ে না গেই ভালো।

প্রতিটা শিশুকে পরিপূর্ণ করে সমাজের বুকে মানুষের মতো মনুষ করে গড়ে তুলতে বাবা-ময়ের সমান দায়িত্ব,সমান ভূমিকা আছে। আমি একাই কেন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সবাই তা মনে করি। 

শুধু শিশু শ্রমিক বললেই তো সব বলা হয়ে গেল না। আছে অপুষ্টি,অশিক্ষা। এই দিকগুলো এর অন্যতম কারণ। 

আমি যদি রাজনৈতিক কর্মী হই আর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করি এককথায় বলব,এর জন্য সরকার দায়ী। আর্থ সামাজিক কাঠামো মজবুত না থাকার জন্য  দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ এমন দূর্দশার শিকার হচ্ছে।

এই যে কেউ একজন অদৃশ্য কারোর ঘাড়ে  দায় চাপিয়ে দিল।এতেই দায়িত্বহীন অভিভাবকেরা ভাবল,তাদের বুঝি কোনো দোষ নেই। তার এই ছোট্ট ছেলেটি পরের দোকানে বা অন্যের বাড়িতে কাছে পাঠিয়েছে বা পরিবেশ পরিস্থিতি কাজে পাঠাতে বাধ্য করিয়েছে।আরো একটু খুলে বললে বুঝতে সুবিধা হবে।

প্রথমতঃ সংসারধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা। প্রবাদে শুনি 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বে,কাপড় চোপড় নে'।সেই সময়ে "গৌরীদান" প্রচলিত রীতি ছিল।অর্থাৎ নয় বছর বয়সি শিশুকন্যাদের বিয়ে দেওয়া হতো। ওই বয়সে ছুঁড়ি হয়ে ওঠার কথা নয়।বলা বাহুল্য যে ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে হয়,কৈশোর অতিক্রান্ত তো বটেই বরং যুবক হওয়াটাই সাভাবিক।তাই কর্তা পুরুষটি শিশুপত্নীকে নরম মাটির মতো নিজের ইচ্ছে মতন গড়পিটে নিতেন।এখন সে সময় নয়। মেয়েদের বিয়ে হয় সেই সময়ে  বরেদের বয়সের সমানে বা তারও বেশি বয়সে।

খুব বেশি বয়সে বিয়ে হলে,ভালো কি মন্দ আমার আলোচ্য বিষয় নয়। বিশেষ করে বেশি বয়সে বিয়ে করা পুরুষদের ক্ষেত্রে দুর্মুখদের বলতে শুনেছি এরা স্ত্রৈণ হয়ে পড়ে। আমার কাছে খুব একটা খারাপ লাগেনা। বলতে পারি যাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসায় ভাটা পড়েছে তারাই বলতে পারে বোধ হয়।যাক ও কথা,প্রসঙ্গে আসি।

মোদ্দা কথা হলো সংসারী হওয়ার আগে সংসার সম্পর্কে আমাদের কম বেশি ধারণা থাকা বিশেষ ভাবে দরকার।মুখফোঁড় যারা বলেই বসবে,'অভিজ্ঞতা চাইছেন,হয়ে যাবে?'

নানা আমি তোমাদের কর্মখালিতে যেমনটি বলে থাকে 'এতো দিনের অভিজ্ঞতা ছাড়া যোগাযোগ নিষ্প্রয়োজন 'সে ভাবে বলছি না। 

তোমরা সবাই বিয়েসাদি করো,সুখেশান্তিতে ঘর সংসার করো।সবার মতো আমিও চাই। কিন্তু এটা তো সবাই একবাক্যে মানবে? একদিন না একদিন বাবা হবে। কোল আলো করে শিশুসন্তান আসবে। তাদের  নুন্যতম চাহিদাগুলো তো তোমাকেই মেটাতে হবে। তাদের খাওয়ানো,পরানো,শিক্ষার আলো দিয়ে সমাজে মানুষের মতো মানুষ করে দাঁড় করানোর দায়িত্বভার তো তোমাকের নিতে হবে।অজুহাত দিয়ে অন্যের ঘাড়ে চাপানো যাবে না।আর তোমাকেই ঠিক করতে হবে।সামর্থ অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে তোমাকেই।এবার ভাবো পৃথিবীর আলোতে ক'জনকে আনবে?

দ্বিতীয়তঃ সন্তান প্রতিরোধের চিন্তাই যারা করে না।প্রচলিত বিশ্বাস,এ জন্মে সন্তান যদি নানা ভাবে নষ্ট করে পরজন্মে পুত্রের জন্য হা-হা করে বেড়াতে হবে।তাই,নিজের সাধ্যের বাইরে যেকটা সন্তান হয় হোক। তার পরবর্তীতে দুমুঠো অন্নের জন্য সাতবাড়িতে হাহাকার করলেও।পিতা হয়ে নিজের বিবেকে আঘাত করবে না। 

এইসব পিতামাতার সাম্যের প্রতি আস্থা  প্রবল। কি ভাবে তবে বলি।পুত্র ও কন্যা অন্তত দুটো না হলে "আটকুড়ো" নাম ঘোচে না।একদিন দিয়ে যেমন ভালো,তার উলটো ফল কেমন দেখুন।পুত্র সন্তান চেয়ে কন্যা সন্তান বাড়ান।আবার কন্যা সন্তানের আশায় পুত্র সন্তান বৃদ্ধি করে।উভয় সংকট।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের পরিণতি কি হয়, আমার চাক্ষুষ ঘটনার কথা বলি। বরদানগরে সামন্ত পরিবারে দম্পতি প্রতিবারে পুত্রসন্তান চেয়ে কন্যাসন্তান হয়। কয়েকটি ছাড়া কে কি ভাবে মারা গেছে সেই করুণ কাহিনি বিস্তারিত নাই বা বললাম। এভাবে বলা যায়,হারাধনের দশটি ছেলে কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল ভাবলে অনেকটা বুঝতে পারব।এক্ষত্রে বিশটার মতো সংখ্যাটা। তবে সন্তানের সংখ্যা কমবেশিতে উপলব্ধির হেরফের হবেনা।

সমাজে অপদার্থ পিতা,তেমন সহযোগী স্ত্রী হয়।তাদের সংখ্যা যতই বাড়বে,তাদের সংসারে অপুষ্টি,অনাহার,অশিক্ষার শিকার হবে তাদের শিশুসন্তানেরা। অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে সেই পরিবার।তবে এইসব অভিভাবকেরা সবকিছুতে নির্বিকার সহনশীল হয়ে ওঠে। কতকটা পাঁড় মালখোরের মতো।লিভার যখন পচে গেছে, ওষুধ খেয়ে আর কি হবে। যে কদিন বাঁচি বেশি করে খাই।এটিই এদের জীবনে ঘটে।

এই অজ্ঞ অপদার্থ দায়িত্বহীন অভিভাবকেরা (স্বামী বা বাবা )তারা সংসারের হাল ছেড়ে দেয়।কে চালাবে,কি ভাবে চালাবে, যেন তার জানার কথা নয়। তারা তাস পিটে, আড্ডা মেরে,টলমল পায়ে বাড়ি ফেরাটা সাভাবিক দৈনন্দিন ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। না এনে কৈফিয়ৎ চায়,রান্না কী হয়েছে? কেন হয় নে?এসব তো পুরোনো কথা।

প্রতি দিনতো সমান যায়না।একদিন হয় তো ভালো মেজাজে বাড়ি ফিরল।বাড়িতে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিল।দিব্যচক্ষুতে আবিস্কার করল কোনো ছেলে বা মেয়ে দেখতে না পাওয়ার কারণ।স্কুলছুট ছেলে ওই বয়সে নিজের পেটের খোরাক নিজেই করে নিয়েছে।শুধু তাই নয়,কিছু নগদ টাকা বাড়ির জন্য মার হাতে পৌঁছে দিতে পারছে। সেই টাকায় ছোট ছোট ভাই-বোনেদের মুখ অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য।

এবার আক্ষরিক অর্থে কর্তা মানুষটির প্রথম ধাক্কায় পরিবর্তন আসে তো আর কথাই নেই। তা না হলে বউ পরের বাড়িতে  দাসীবৃত্তি অবধারিত।ছেলে অন্যের বাড়িতে কাজ করবেই।যেখানে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা নেই,কর্তা নির্বিকার চিত্তে যেমন চলছে চলুক। লিভার যখন পচেছে মাত্র বাড়ালে কী আর নতুন ক্ষতি হবে।

এমন দায়িত্বহীন অভিভাবকদের বাড়ি থেকে  শিশুশ্রমিক জন্ম নেবে না তো কোথায় নেবে?এর ওর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেললে চলবে?শিশু শ্রমিক বন্ধ করতে পারে একমাত্র প্রতিটি  দায়িত্বশীল বাবা-মা নিজেদের সচেতনতায়! 

লেখক শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
লক্ষ্মীকান্তপুর, বিজয়গঞ্জবাজার, দক্ষিণ ২৪পরগনা






















0 Comments