
সোনার পইতে
পুজো যত এগিয়ে আসছে রিক,বিষ্টু আর মনের মনখারাপ তত বেড়ে যাচ্ছে। অতিমারীর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার দাপটে বড়দের সঙ্গে সঙ্গে ছোটরাও কোণঠাসা।
এতোদিন তো স্কুল বাড়িতেই হল,তাই পূজোর ছুটির আর আলাদা অনুভূতি কি,সেই তো ঘরে বসে ভ্যারেন্ডা ভাজা-হয় টিভিতে খেলা দেখ, নয় কম্পিউটারে গেম। এখন তো ছোটরা আবার নাচে,গানেও ওস্তাদ,তাই তারও প্র্যাক্টিস আছে।মোটকথা পুজোয় নিরানন্দের হাতছানি,এরকম হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় রিক,বিষ্টু আর মনের হাতে চাঁদ প্রাপ্তি হল। রিকের মামা সিআইডি অফিসার রঙ্গন ঠিক করেছে পুজোটা এবার তার দেশের বাড়ি ওন্দাতে কাটাবে, সেখানে ওদের পারিবারিক পুজো হয়। পুজোর পালি জ্ঞাতিদের মধ্যে ভাগ করে হয়,এবারের পালা রঙ্গনদের।
মামা যাবে আর মামার ভক্ত পল্টনেরা যাবে না, তাই কখনো হয়। রিকের মায়ের অনেকদিন বাপের বাড়ি যাওয়া হয় না, তাই তিনিও যাবেন। রঙ্গন বিষ্টু আর মনের বাড়িতে অনুরোধ করেছিলেন,যদি ওদের ছাড়ে, কারণ রিক চলে গেলে ওদের পূজো আরো মাটি হয়ে যাবে। প্রথমে দুই বাড়ির আপত্তি থাকলেও রিকের মা সঙ্গে যাওয়াতে ছাড়তে রাজী হয়।যেহেতু কলকাতার থেকে পূজোয় সবার জামাকাপড় ও পূজোর সামগ্রীও কিছু যাচ্ছে তাই ওরা সোজা গাড়িতেই রওনা দেয়। বিষ্টু আর মন-এর তো আনন্দের সীমা নেই,রিকের মুখে চন্ডীমন্ডপ,পাতাল ভৈরবী, মনসা তলা, নাটমন্ডপ- এসব শুনে শুনে ওদের কৌতূহলেরও কোন সীমা নেই। রঙ্গন পুলিশি গাম্ভীর্য ছেড়ে কচিকাচাদের সঙ্গে মেতে উঠেছে, ওদের সব প্রশ্নের উত্তর রঙ্গনমামার মগজে রেডি। সাঁতরাগাছি অব্দি গাড়ি স্পীড তুলতে পারে নি, সাঁতরাগাছি ছাড়াতেই রঙ্গনের স্পেশাল ড্রাইভার ফটিকের হাত খুলে গেল। এবার তালগাছ,বটগাছ, দূরের আটচালা সব তালগোল পাকিয়ে ঝড়ের গতিতে পার হতে থাকল, গিয়ে থামল একেবারে বর্ধমানে।ওখান থেকে নেওয়া হল মিহিদানা,সীতাভোগ। সবাই পেট পুরে কচুরী তরকারি খেয়ে নিল।
গাড়ি এবার একটানা যাবে,বিশেষ দরকার না পড়লে থামবে না। পেট ভরা থাকায় বিচ্ছুগুলো গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে পড়েছে। রঙ্গন সামনে,রিকের মা বাচ্ছাগুলোর সঙ্গে পেছনে। মুচিপাড়া মোড় ঘুরে গাড়ি বাঁকুড়ার রাস্তা ধরল। রাত নেমে যাওয়ায় রঙ্গন চিন্তা করছে-হাতির পাল্লায় না পড়তে হয়। পুচকেগুলো হাতির কথা শুনে চোখ কচলে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল। রিক জিজ্ঞেস করল-"কেমন করে আসবে মামা।" রঙ্গন বলল-"সে কি আমাকে বলে কয়ে আসবে, ঝাড়খন্ডের দিক থেকে হাতির পাল এদিকের জঙ্গলে চলে আসে।" যা হোক বাকী রাস্তা ঠিকমতো কাটিয়ে ওন্দায় মুখুজ্যে পাড়ায় গাড়ি থামল। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় রিকরা আর এদিক,ওদিক বিচ্ছুমি না করে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে বাধ্য হল।
বিষ্টু আর মন,রিকের দিদিমাকে ওদের কলকাতার বাড়িতে কখনো সখনো দেখেছে। রিকের বড়মামা-মামী এখানেই থাকে,বড়মামা স্থানীয় কলেজে পড়ান। রাতে বাড়ির পুকুর থেকে তোলা টাটকা রুইমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া হল। দোতলা একটা ঘরে রঙ্গনমামার সঙ্গে রিক আর বিষ্টু শুতে গেল,মন রইল রিকের মায়ের সঙ্গে নীচের একটা ঘরে। খাটে শুয়ে মনকে রিকের মা বললেন-"কি রে মায়ের জন্য মন খারাপ করছে না তো?
আমি তোর মাকে পৌঁছন সংবাদ দিয়ে দিয়েছি,ঘুমো এবার নিশ্চিন্তে।" মুখুজ্যে বাড়িতে সবাই এখন ঘুমের দেশে,দূরে শেয়ালের ডাক শুনে পাড়ার কুকুরগুলো সমানে ডেকে চলেছে। কোনো ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে রাত দুটো বাজল। ঘুমন্ত মুখুজ্যে বাড়ি,চন্ডীমন্ডপ-দালান,পুকুর,দেউটি রাতের চাদরে ঢাকা পড়েছে।
পরদিন রিকের ঘুম ভাঙল সকলের হইহই চিৎকারে, পাশে বিষ্টুকে ঠেলে তুলতে গিয়ে দেখে মামা আগেই ঘুম থেকে উঠে চলে গেছে। বিষ্টু উঠলে দুজনে মিলে নীচে নেমে দেখল মন উঠে পড়েছে, নীচটা লোকে লোকারণ্য।রিক গুটি গুটি রঙ্গনের পাশে গিয়ে জানতে চাইল-"কি হয়েছে?" রঙ্গন বলল-"চন্ডীমন্ডপের পাশে, বিষ্ণু মন্দির থেকে বিষ্ণুর গলার সোনার পইতে চুরি গেছে।" সবাই একসঙ্গে বসে পুরুতমশাই গৌর চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আর তিনি হাউ হাউ করে কাঁদছেন। কি জানি কেন রিকের মনে হল গৌরমামা একান্তই নিরাপরাধ,তাই রিকের চোখও কান্নায় ভিজে উঠল। বিষ্টু আর মনের অবস্থাও তথৈবচ। রিকের মা এসে বললেন "গৌরদা এ কাজ করতে পারে না,এ অন্য কারো কাজ,কাউকে কিচ্ছু করতে হবে না, রঙ্গন আছে ওই দেখবে ব্যাপারটা,সবাই যে যার বাড়িতে যান।"গৌরদাও কেঁদে বলল-"মা জননী বিশ্বাস করুন,এ যে কিভাবে ঘটল,আমি তার কিছুই জানি না।"রিকের মা গৌর চক্রবর্তীর হাত দুটো ধরে বললেন-"আমি জানি গৌরদা,তুমি নিশ্চিন্ত থাক,ভাই ঠিক আসল অপরাধীকে ধরে ফেলবে,আর হ্যাঁ পুজো দিয়ে একেবারে জলখাবার খেয়ে তবে বাড়ি ফিরবে।"ভিড় পাতলা হতে শুরু করল, সকলে যে যার কাজে ফিরে গেল। সকালের জলখাবার খাওয়া পর্ব শেষ করে রঙ্গন চন্ডীমন্ডপের দিকে পা বাড়ালো, রিক-বিষ্টু আর মনও মামার পিছু নিল। রঙ্গন চন্ডীমন্ডপ,বিষ্ণুমন্দির তার আশেপাশের জায়গায় অনুসন্ধান চালাতে লাগল।
তিন খুদেও তীক্ষ্ণ চোখে মামার সঙ্গে ঘুরতে থাকল। হঠাৎ একটা ঝোপের দিকে তাকিয়ে মন চেঁচিয়ে উঠল-"ওই দেখ সোনার মতো কি একটা।"সবাই সেখানে এসে দেখল সোনার ছোট্ট বেলপাতা,বিষ্ণুমন্দিরে বিষ্ণুর পায়ের কাছে থাকে। রঙ্গন বলল-"চোরের নেওয়ার সময় কোনভাবে এটা সোনার পইতে টার সঙ্গে উঠে এসেছিল,অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো এখানে পড়ে গেছে,চোর খেয়াল করে নি।" এরপর তন্নতন্ন করে খুঁজে বিষ্ণুমন্দিরের পাশ থেকে পাওয়া গেল একটা রুমাল,যার কোণায় সুতো দিয়ে নক্সা করে-"A"-লেখা। আজকের অনুসন্ধানের ফলাফল এই,সবাই বাড়ি ফিরে এলো। খোয়া যাওয়া সোনার বেলপাতা যে ফেরত এলো এতে সবার ধারণা হল এইভাবে সোনার পইতেও উদ্ধার হবে।রিকের দিদা কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন-"জয় মা,জয় বিষ্ণু।"রিক,বিষ্টু আর মন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল এমনভাবে যে বিষ্ণুকে আবার কেন, এটা তো ওরাই উদ্ধার করবে।সবার অগোচরে রঙ্গন স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করে "A"-আদ্যক্ষর নামের কে কে এলাকায় বা আশপাশের এলাকায় আছে তার একটা লিস্ট তৈরী করতে বলল। স্থানীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দোকানের ওপর নজর রাখার কথাও বলল।
আজ ষষ্ঠী রঙ্গনদের পেতলের দুর্গাকে পূজো করা হয়, শুধু প্রতি বছর প্রতিমার কাপড় পাল্টে,রোজকার গয়না পাল্টে নতুন গয়না পরানো হয়। চতুর্থীতে বদলানোর কাজ হয়ে গেছে। এখন শুধু পূজো আর দর্শনার্থীদের প্রসাদ, ভোগ বিতরণ। মন্দিরের এক পাশে বড় বড় কড়াইতে সেসব রান্না করা হয়, ঊড়িষ্যা থেকে এইসব রান্নার ঠাকুররা আসে। মিষ্টি ভোগও ওরাই রান্না করে।
সকাল থেকে রিক,বিষ্টু আর মন এসব ঘুরে ঘুরে দেখছে,রিকের তো এসব দেখা আছে,বিষ্টু আর মনের জন্য নতুন, তাই ওদের দুজনের আগ্রহ দ্বিগুণ। ঘুরতে ঘুরতে বিষ্ণু মন্দিরের ওখানে যেতে দেখল গৌরমামা একজন ছেলেকে খুব বকছে,ছেলেটা বকুনি খেয়ে গজরাতে গজরাতে চলে গেল। রিক বলল-"গৌরমামা কাকে বকছিলে এরকম করে।"গৌর চক্রবর্তী বিরক্তিসহকারে উত্তর দিল-"আর বল কেন,ও আর্য, আমার ছেলে,দিন দিন বখাটে হয়ে যাচ্ছে,আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশছে,বারণ করলেও শোনে না।" মন মনে মনে বিড়বিড় করতে রইল-"A for Arya"-বিষ্টু ঠ্যালা দিতে চুপ করল।
বাড়ি ঢুকেই মন ওর বিড়বিড়ানিটা রঙ্গনকে উগড়ে দিল।আশ্চর্য, বিষ্টু চুপ করালেও রঙ্গন এটা লুফে নিল, বলল-"চ আমরা ঠাকুরমশাই গৌর চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।" রিকেরও কেসটা ঘেঁটেছিল, ও উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল-"গুরু,এতক্ষণ সন্দেহটা মনে আসে নি,ফেলুদা, আজকে ফেল মেরে দিলাম।" ওর বলার ভঙ্গি দেখে চারজনেই হেসে উঠল। নাট মন্দির পার হয়ে ডান দিকে বাঁক নিলে গৌর চক্রবর্তীর বাড়ি। ঠাকুরমশাই সবে মন্দির থেকে ফিরে দাওয়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।ওদের আসতে দেখে চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন-"কী হয়েছে রঙ্গন ভাই?" রঙ্গন জিজ্ঞেস করল-"আর্য কোথায়?"গৌর চক্রবর্তী রেগে বললেন-"সেকি ঘরে থাকার ছেলে,দেখ বখাটেদের সঙ্গে কোথাও তাসপাশা খেলছে মনে হয়।"রঙ্গন বিষ্ণু মন্দিরের কাছে পাওয়া রুমালটা দেখিয়ে বলল-"দেখুন তো গৌরদা এটা চেনেন?"
গৌর চক্রবর্তী উত্তর দিল-"এটা তো আর্য-র রুমাল,তুমি এটা কোথায় পেলে?" রঙ্গন তাড়াতাড়ি বলল-"চল রে সব আর্য-র পুরো বন্ধুদের গ্রুপটাকেই ধরতে হবে।"
স্কুলমাঠের বটগাছের তলায় আর্য আর ওর বন্ধুরা জুয়া খেলছে মনে হয়, রঙ্গনরা বটগাছের পাশে চায়ের দোকানের আড়াল থেকে ওদের ওপর নজর রাখা শুরু করল। একসময় আর্য ওদের সকলের চোখের সামনে বিষ্ণুর সোনার পইতেটা দুলিয়ে বলল-"এটা বিক্রি করলে পুজোর কদিন ফূর্তির অভাব হবে না।"- বাকীদের চোখও লোভে চকচক করে উঠল,উল্লাসে ফেটে পড়ল সব। এইসময় ওখান দিয়ে পুলিশ পেট্রলিংয়ের জিপ যাচ্ছিল,রঙ্গনকে ওখানে দেখে দাঁড়াল,রঙ্গনের ইশারায় আর্যদের লক্ষ করল। দলটার নজর এবার এদিকে পড়ল,আর্যই সব আগে দৌড় লাগালো,বাকীরা পেছন পেছন।
নাটমন্দিরের কাছে পৌঁছে গৌর চক্রবর্তীর সঙ্গে ওর ধাক্কা লাগল,মনে হয় উনি চিন্তায় চিন্তায় এদিকেই আসছিলেন। রঙ্গন পৌঁছতেই সোনার পইতেটা তুলে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন-"ধর ভাই আমাকেই ধর।" রঙ্গন বলল-"সরুন আপনি, আমাকে আমার কাজ করতে দিন,এ অপকর্ম আর্য করেছে,ওকে আমায় ধরতে দিন।"
গৌর চক্রবর্তী বললেন-"ওর সামনে গোটা ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, আমার কাছে যখন দেখছ,আমাকেই ধর।"
পেছনে তখন পুলিশের দলটা প্রায় এসে গেছে,রঙ্গন
চট করে পৈতেটাকে পাশের পুকুরে ছুঁড়ে দিল। পুলিশের দলটা আসতে ও বলল-"এ পাড়ার কটা ছেলে আসলে জুয়া খেলছিল,ওটাই তখন আপনাদেরকে দেখালাম, মাঝে মাঝে ধমকাবেন,নাহলে ভাল বাড়ির ছেলেরা সব বখে যাচ্ছে।"পুলিশের দলটা চলে যেতে রঙ্গনের হাত ধরে গৌর চক্রবর্তী ভেঙে পড়লেন,রিকদেরও মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
পরদিন রঙ্গন জেলেদের বলল-"মা স্বপ্ন দেখেছে, বিষ্ণুদেব স্বয়ং পুকুরের জলে সোনার পইতেটা
কাচতে নিয়ে গেছে,তোমরা একবার মাঝের পুকুরটায় দেখ তো।"যথারীতি ওখানেই পৈতে ছোঁড়া হয়েছিল,
ওখান থেকেই পাওয়া গেল। শুধু এবারের রহস্যভেদে রিক,বিষ্টু আর মন-এর কোন মজা এলো না। গৌরমামার জন্য মনটা কষ্টে ভরে রইল। শুধু দুর্গাঠাকুরের কাছে মনে প্রাণে চাইল-"ঠাকুর,আর্যদাদাকে ভাল মানুষ করে দাও।"
0 Comments