সৌমী আচার্য্য'র গল্প


এসো আলো

নিবারণ হাঁ হয়ে বড়ো ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।মাত্র তো বারো বছর বয়স।এরই মধ‍্যে এমন বুদ্ধি হলো কি করে?ছেলের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে ঢাকটা কাঁধে তুলে নিলো।সুশান্ত মা আর ছোটো ভাইবোনের দিকে তাকিয়ে বললো,আমার জন‍্যি কাদবা না কিন্তু ওকান থেকে অনেক কিচু নে আসবো কেমন?মা বুনরে একা বেরোতি দেবা না আর পোসুন বুনরে চারমাতার ঠাকুরটা দেকায় দিবি,হাত ধরে নে যাবি নে আসবি বুজলি।

প্রসূণ দাদার কথায় মাথা নাড়ে।ছেলের মাথায় হাত রাখে শিবানী।ঝাপসা চোখে দেখে গটগট করে বাবার সাথে চলেছে ছেলে।শহরে এসে হকচকিয়ে গেলো সুশান্ত।বাবার গা ঘেঁষে এলো।নিবারণ ছেলেকে টেনে নিয়ে বললো,মুখে মাক্সটা সব সময় রাখবি বুঝলি?আর যে যা বলবে করে দিবি।চল আর একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাবো।

এই পাড়ার পুজোয় প্রায় আট বছর ধরে নিবারণ আসছে।ষষ্ঠীর দিনই চলে আসে।এখানকার মেয়েদের সময় নেই বলে সকালে স্নান সেরে পুজোর সব কাজ করে দেয়।এবারে বড়ো ছেলে বললো,বাড়িত থাকি কি করবো বাবা?ওকানে তোমারে হাতে হাতে কাজ করে দুবো,একটা পেট কমলি কটা টাকা তো বাঁচপে।নিবারণ হতবাক হয়ে গেছে।মনে একটু ভয় ছিলো পুজো কমিটির বাবুরা যদি রাগ করে।ঝামেলা পাকাতে চেয়েছিলো কুচুটে প্রদীপ সেন।

-না না এটা ঠিক করোনি নিবারণ না জানিয়ে এ বছর ছেলেকে আনলে কেন?এমনি তেই এবছর চাঁদা কম উঠেছে।

-ও কাকা আমারে টাকা দোওয়া লাগবে না।শুধু এট্টু ভোগ দেবেন।আমি কাজ করে দুবো।সব।

ছেলেটার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।হেসে হেসে সব কাজ করছে।কাকা,কাকি,জ‍্যাঠা,জ‍্যেঠি ডাকের মধুতে সবাই খুশি।

-ওরে সুশান্ত মাইকের ছেলেটা গেছে তো গেছে একটা কিছু চালাতে পারবি?

-হ‍্যাঁ,চালাচ্ছি জ‍্যেঠু।মহালয়া চালাবো আস্তে করে?না কি অজয় চকোত্তি?

নিবারণ বোঝে এ ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।ওর ভবিষ‍্যৎ ভালো।পাড়ার বাচ্চাকাচ্চারা বন্দুক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে,মুখে রঙিন মাস্ক।ওদিকে চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না ছেলেটা।মন দিয়ে ভোগের বাসন মাজছে।নিবারণ পিছনে এসে দাঁড়ালো।

-যা খেল গা।

-না বাবা তুমি একটু শোও।আজ আবার সন্ধীপুজোর হ‍্যাপা আচে।আমি বাড়ি গিয়ে খ‍্যালবো একন কাজ করি।

সন্ধীপুজোর সময় নিবারণ ঢাক বাজাতে বাজাতে মত্ত হয়ে ঘুরছিলো কিন্তু কাঁসরের তাল কাটছে শুনে খুব বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখে হ‍্যোৎকা মতো একটা ছেলে বাজাচ্ছে।চোখ দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছেলেকে খুঁজে পেলেনা।ঢাকে তেমন মন মজলো না আর।পুজো শেষ হতেই কাজের তোড়ে ছেলেকে আর খোঁজার সময় পেলো না হঠাৎ দেখে পাড়ার ছেলেরা পাঁজকোলা করে সুশান্তকে নিয়ে আসছে।হাতের থেকে জড়ো করা ফুল পড়ে যায় নিবারণের ছুট লাগায় মাঠের মধ‍্যে।

-কি হয়েছে ও সুশান্ত,কি হয়েছে রে?

সুশান্ত বাবার কোল ঘেঁষে গোঁজ হয়।ছেলেরা হৈ হৈ করে ওঠে।নিবারণ কিছুই বোঝেনা ফ‍্যালফ‍্যাল করে চেয়ে থাকে,ছেলের কষ বেয়ে ঝরে পড়া রক্ত মোছে হাতে।

-কি রে,বল!বল কি করেছিস!

নিবারণ হাতজোড় করে বলে,ও কি কোনো অন‍্যায় করেছে,মানিকদা?ক্ষমা করে দ‍্যান,ও অবুঝ।

-অন‍্যায় কি বলছো নিবারণ!নিরঞ্জন কাকার বাড়ির সবাই সন্ধীপুজোর উপোস করে প‍্যাণ্ডেলে।প‍্যাণ্ডেলের পিছনেই বাড়ি হয়তো ভেবেছে কিছু হবে না।এদিকে বাড়িতে চোর ঢুকেছিলো।তোমার ছেলে সেটা দেখে সোজা বোধনতলা থেকে শাবল নিয়ে চোরের ভাঙা দরজা দিয়েই ঢুকে চোরকে মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছে কিন্তু বোঝেনি বাইরে আরো দুজন ছিলো।কি রে এবার বল তারপর কি করলি।

-শাবল ঘুরায় দিচি বাবা।তারপর মানিককাকা,সতুদাদার নাম নিয়ে জোরে জোরে চিল্লে রাস্তায় নেমেচি কিন্তু প‍্যাণ্ডেলের দিকি আসতি পারলাম না ওরা এমুন তাড়া করলো।

-আরে ঢাকের আওয়াজে কিছু শুনতেই পাইনি প্রথমে তারপর এই প্রত‍্যূষ,কৌশিক ঠাকুর দেখে বাড়ি ফিরছিলি ওরাই ওকে ছুটতে দেখে ধরে সব শুনে সবাইকে ডেকেডুকে আনে।ততক্ষণে অবশ‍্য চোরগুলো পালিয়েছে।

-এখন পুলিশ এসে গেছে অজ্ঞান হওয়া চোরটাকে ধরেছে।নিরঞ্জন কাকা বাড়ি চলো।

নিরঞ্জন সাহা সুশান্তের কাছে আসে।দুহাতে বুকে টেনে নিয়ে বলে,বল তোর কি চাই?তোর ঋণ আমি কি করে শোধ করবো বল!নিরঞ্জন সাহাকে বুকে জড়িয়ে সুশান্ত বলে ওঠে,কি শান্তি পাচ্ছি গো দাদু,কি শান্তি।আর কিচু চাই না।নিরঞ্জন সাহা আলোর মতো মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

-মাণিক করোনা টরোনা যাই হোক দশমীর দিন সবার বিরিয়ানির টাকা আমি দেবো।তুই প‍্যাকেট করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছি দিবি সাথে নিবি এই হীরোকে।

সবাই মিলে আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে।পাড়ার ছেলেরা এগিয়ে এসে নিবারণ কে বলে সুশান্তের জন‍্য ওরা কিছু করতে চায়।কি হলে সুবিধা হয় জিজ্ঞাসা করে।নিবারণ কিছুই বলতে পারেনা।সুশান্ত হাসিমুখে বলে,আমি কবো?

-হ‍্যাঁ বল।

-আমার ভাই বুন মা অনেকদিন ভালো করে খায়না।বাবা যে তাঁতের কলে কাজ করে সেটাও বন্ধ আমায় যদি একটা কাজ দাও।আমি সব কত্তি পারি সব।

নিবারণের হাতদুটোর পাশ দিয়ে আরো দুটো কচি হাত বেরিয়ে আসে যেন।হাত দুটো খুব শক্ত।সুশান্তর পিঠে হাত দিয়ে মানিক বলে,তুই এখন পড় মন দিয়ে সুশান্ত।আর তোর বাবার কাজের ব‍্যবস্থা খুব শিগগিরই হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।এই পাড়ার সবাই মিলে কথা দিলাম তোর মা ভাই বোন পেট ভরে খাবে।যা এবার ঘুমা গে।নবমী,দশমী ঢাকের বোলে নিবারণ পাড়া মাতিয়ে রাখলো।প‍্যাণ্ডেলে এসে হাসিমুখে কাজ করা সুশান্ত সবাই আশীর্বাদ করে গেলো।ছোটো ছোট ছেলেমেয়ে গুলোতো ওকে ক‍্যাপ্টেন আমেরিকা নাম দিয়ে দিলো।একাদশীর দিন যাবার আগে জামা প‍্যান্ট,শাড়ি,খাবারে ব‍্যাগ ভরে উঠলো ওদের।বাসে উঠে সুশান্ত বাবাকে বললো,বাবা আমি কিন্তু এসব পাবো বলি ভালো করে কতা কইনি,মা কয় কতা দিয়ে মনের দুকখো ভুলানো যায় তাই কিন্তু...

-আমি জানিরে জানি।

ছেলেকে বুকের মধ‍্যে নিয়ে নিবারণ মনে মনে মা দুর্গাকে বলে,মাগো ওর মনটা বাঁচায়ে রেখো মা।

লেখিকা সৌমী আচার্য্য
বি-১৩/১১০,কল‍্যানী, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ



















1 Comments