সমাজ বসুর গল্প




অঙ্ক মিলে গেছে

কাল হতেই খবরটা হৈ হৈ করে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। বাণীপুর এলাকার ক্লাস ফোরের দু দুটো ছেলে গায়েব। একেবারে কর্পূরের মত উবে গেছে,রাজা আর ভোলা। ওইরকম ডানপিটে আর মাথায় গোবর পোরা দুটো ছেলে দিনের আলোয় কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে,কারো মাথাতেই আসছে না। শান্তশিষ্ট,বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে ওরা নয়। তথাকথিত সুবোধ বালকও নয় যে ভয় কিংবা লোভ দেখিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। বরং এই রাজা আর ভোলার জ্বালায় পাড়ার সবাই অতিষ্ঠ। এদের কোন্ ছেলেধরা ধরবে?অথচ এইরকম দুটো ডাকাবুকো ছেলে কিনা রীতিমত হারিয়ে গেল! এই দুঃসংবাদে পাড়ার কিছু মানুষ,যাদের হাড়ে বাতাস লাগত,তারাও যেন স্থির থাকতে পারছিল না। হাজার হোক সন্তান ব'লে কথা।
       
রাজা আর ভোলা,বাণীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা। অবশ্য সেজন্য তাদের কোন হেলদোল নেই। আক্ষেপও নেই। ষান্মাসিক পরীক্ষায় ছয় বিষয়ের চারটেতে লাল কার্ড দেখেও তাপ উত্তাপ নেই। স্কুলে এবং বাড়িতে কড়া শাসনেও তাদের শায়েস্তা করা যাচ্ছে না। এখন অভিভাবকদের একটাই চিন্তা, কিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে তারা হাইস্কুলে প্রবেশ করবে। সপ্তাহের প্রথমেই বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। বাংলা ও ইংরেজির পর সেই আগামী সোমবার অঙ্ক পরীক্ষা। এইসময় সবাই যখন নাওয়া খাওয়া ভুলে অঙ্কের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক এখনই কিনা এই কান্ড। ছেলেদুটো কোথায় কি করছে কে জানে?
    
এমন দুঃসময়ে পাড়ার সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাজা আর ভোলার বাবা দিব্যি বাজার ঘুরে ঘুরে শাকসবজি মাছ কিনছেন। মানুষ এত পাষাণ হতে পারে? তাও আবার সন্তানের পিতা। পুত্রশোকে রাজা দশরথের প্রাণ বিসর্জন হয়েছিল। অথচ ছেলেদের প্রতি মায়া মমতা দূরে থাক, কপালে চিন্তার ভাঁজটুকু পর্যন্ত নেই। এমন খোলা মনে ঘুরে বেড়াতে আগে কখনো দেখা যায়নি তাঁদের। ওদিকে রাজা আর ভোলার মায়েরা বুকে পাথর বেঁধে সংসারের হাল টানছেন। আড়ালে চোখের জল ফেলছেন আর তা আঁচলেই মুছে নিচ্ছেন।

রবিবারের সকাল। বাজারে অনেক লোকের সমাগম। বহু মানুষ এই ছুটির দিনটায় সারা সপ্তাহের বাজার সারেন। শাকশব্জি তো পথেঘাটে পাওয়া যায়, তাই মাছের বাজারেই ভীড় বেশি। আর বিভিন্ন রকমের মাছও ওঠে।

---মাস্টারমশাই আপনি কি শুনেছেন, আপনার স্কুলের ক্লাস ফোরের রাজা আর ভোলার গত দুদিন ধরে কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকার এক ভদ্রলোক,বাণীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অঙ্ক শিক্ষক ফটিক বাবুকে প্রশ্ন করলেন।
     
- হ্যাঁ শুনেছি। আমার ক্লাসের সবচেয়ে পাজি আর মাথামোটা দুজন রাজা আর ভোলা। কত বুঝিয়েছি,ওরে অঙ্ক না মেলাতে পারলে জীবনে কোথাও কোনদিন দাঁড়াতে পারবি না। মেরেধরেও কোন কাজ হয়নি। গার্জিয়ানদেরই কোন মাথাব্যথা নেই, আমার কি? জানতাম এমনটা হবে। হয়তো অঙ্কের ভয়েই বাড়ি থেকে পালিয়েছে গবেট দুটো। পরীক্ষা শেষ হলেই আবার সুর সুর করে ফিরে আসবে বাছাধনেরা। কোন খবর পেলে আমায় জানাবেন। এই বলে সাড়ে সাতশ গ্রাম কাতলা মাছের পেটি নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন ফটিক বাবু।
      
আজ অঙ্ক পরীক্ষার দিন। সকাল সাড়ে ছটায় স্কুলের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। একে একে সব ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। ঠিক সাতটায় পরীক্ষা শুরু হবে। ক্লাসরুমের দরজা খোলাই ছিল। ক্লাসরুমে ঢুকে সকলেই বিষ্ময়ে হতবাক।  রুমের দুই কোণের চেয়ারে (টেবিল সহ) বসে আছে রাজা আর ভোলা। কারো মুখে কোন কথা নেই। শান্তনু তো ভূত ভূত বলে ধপাস করে মেঝেতে পড়েই গেল। দুএকজন স্যার আর মালি এসে শান্তনুর চোখে মুখে জল দিতেই সে উঠে বসল।
রাজা আর ভোলার হারিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে না ভাবতেই অঙ্কের প্রশ্নপত্র চলে এল। নিমেষের ভেতর সবাই যে যার মত প্রশ্নপত্রে ডুবে গেল।

আজ রেজাল্ট বেরনোর দিন। হেডস্যার কিছুক্ষণ পরেই রেজাল্ট তুলে দেবেন সবার হাতে। একরাশ ভয় বুকে নিয়ে হেডস্যারের আসার পথে  চেয়ে আছে সবাই।
       
ক্লাসটিচার ছাড়াও আরও অন্যান্য টিচারদের নিয়ে হেডমাস্টার মশাই আসতেই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা উঠে দাঁড়াল। চেয়ারে বসে সবাইকে তিনি হাতের ইশারায় বসতে বললেন।
     
পাঞ্জাবিতে চশমার কাঁচটা মুছে,সবার হাতে রেজাল্ট তুলে দেবার আগে তিনি মুখ খুললেন-- আজ বড় আনন্দের দিন। চতুর্থ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় সকলেই উত্তীর্ণ। সবাই পেয়ে গেছে প্রাইমারি ছেড়ে হাইস্কুলে যাওয়ার ছাড়পত্র। কিন্তু রাজা আর ভোলাকে নিয়েই ছিল আমার যত দুশ্চিন্তা।এই ছেলে দুটো অঙ্কে ভীষণ দুর্বল। ভূতকে ভয় না পেলেও, অঙ্কে ওদের যমের মত ভয়। আর সেই অঙ্কের ভূত তাড়ানোর জন্য অঙ্ক শিক্ষক ফটিক বাবু,রাজা আর ভোলার অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে পরীক্ষার চারদিন আগে ওদের নজরবন্দী করে রেখেছিলেন। এই চারদিন ছেলে দুটোকে ভালমন্দ খাইয়ে, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অঙ্কের দিকটা ঘষে মেজে তৈরি করে দিয়েছেন। ফটিক বাবুর আদর্শ আর সততায় আমি মুগ্ধ। গর্বিত। তাঁর নিরলস উদ্যম আর চেষ্টায় ছেলেদুটো অঙ্কের গন্ডি পেরোতে পেরেছে।মাস্টারমশাই শিক্ষাক্ষেত্রে যে অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা অবশ্যই অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে অনুকরণীয়।
         
পরিশেষে ফটিক বাবুর অবদানের জন্য তাঁকে বিশেষ সম্বর্ধনা জানানোর কথাও তিনি ঘোষণা করলেন। এছাড়াও জাতীয় শিক্ষকের স্বীকৃতির জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদনের অভিপ্রায়ও জানালেন।
       
হেডস্যারের কাছ থেকে রেজাল্ট হাতে নিয়ে রাজা আর ভোলা চোখ বড় বড় করে দেখল, এই প্রথম অঙ্কে তারা পাশ নম্বর তুলেছে। হঠাৎ ফটিক স্যারের হাতের ছোঁয়ায়, দুজনেই তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। তারপর হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল--স্যার,আমরা এই প্রথম কয়েকটা অঙ্ক মেলাতে পেরেছি। আর কোনদিন অঙ্কে ভয় পাব না। দুষ্টুমিও করব না। মন দিয়ে লেখাপড়া করব। কথা দিলাম। দুজনের কান্নায় ভেজা প্রতিশ্রুতিতে ফটিক বাবুর চোখেও তখন জল।

  সাহিত্যিক সমাজ বসু 
 মিলন পার্ক, গড়িয়া, কলকাতা























0 Comments