অশোক অধিকারীর প্রবন্ধ



হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা

বীন্দ্রনাথের গানের লাইন মনে এল।শিশুর অন্তরের ছেলেমানুষটির খোঁজ কবিই রাখতেন।তাই ছায়াঘেরা শাল মহুয়া আর পলাশের বনবীথিকায় শিশুর মুক্তির যে আনন্দ তাতে তাঁর চিরকালের ছাড় ছিল।নিজের ছোট বেলার যে বিধিনিষেধ,পরিবারের বড়দের থেকে দূরে থেকে শৈশব কাটানো,বাইরের মুক্ত পরিবেশে মিলে না যাওয়ার বারণ তা কবির মনে বাইরের জগতের প্রতি এক অনায়াস টান নিয়েই ধরা দিত। সেই যে,“দোতলার একটি ঘরের মেঝেতে খড়ি দিয়ে গোলমতো একটা দাগ কেটে একজন চাকর বলত,খবরদার,এই দাগের বাইরে যেও না,তাহলে বিপদ হবে।এই বলে সে দিব্যি বেরিয়ে যেত,আর ভয়ের চোটে ছোট্ট রবি বসে থাকত দাগের মধ্যে।” কিন্তু ছোট্ট  রবির বাইরের জগতের প্রতি যে আগ্রাসী খিদে তা তাকে এই গণ্ডির মধ্যে থেকেই সচকিত করত। রবি দেখতঃজানলা দিয়ে তাদের বাড়ির পাশে একটা পুকুরে পাড়ার লোকের স্নান করা দেখে তার কত সময় কেটে! একটা বুড়ো বটগাছ ছিল,সেটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই দিন গেছে। আর দিনযাপন সে আর বলতে নেই। জামাকাপড়ের কোনো বালাই নেই। শীতকালেও দুটি সুতির জামাই যথেষ্ট ছিল।তার পকেট নেই। এখন যা ভাবাই কষ্টসাধ্য। এখন এমনও দেখা যায়, জামাই নেই শুধুই পকেট। রবির পায়ে সাধারণ চটি। জমিদার বাড়ির ছেলের ছোটবেলার এই বাহুল্যবর্জিত জীবন থেকেই একটি দর্শনের জন্ম নিয়েছে এভাবেই যে,না চাইতেই যা পাওয়া যায় তাতে পাওয়ার আনন্দ টাই মাটি হয়ে যায়।ছেলেবেলার এই জীবনকে বিস্তর বাধা নিষেধের মধ্যে অতিবাহিত করা থেকেই তাঁর সেই উপলব্ধিতে পৌঁছানোঃ “প্রকৃতির এই শিক্ষালয়ের একটা অঙ্গ পর্যবেক্ষণ আর একটা পরীক্ষা, এবং সকলের চেয়ে বড় তার কাজ প্রাণের মধ্যে আনন্দ সঞ্চার” (লীলা মজুমদার)। 

বিশ্বব্যাপী কোভিড পরিস্থিতিতে তামাম বিশ্বের ডাকা বুকো ডানপিটেরা এখন গৃহবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। স্কুল বন্ধ। অনলাইন সুবিধা যার আছে তারা নিজের পড়াশোনা কিছুটা হলেও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাকিরা! স্যর,ম্যাডামদের মুখ ব্যাদানও তারা ভুলতে বসেছে।এ এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছোটরা।পুজো যদিও বা এল তাতেও হাজার আইন ফাইনের কড়াকড়ি। ফুচকা,আলুকাবলি আর আইসক্রিমের দৌরাত্মি নেই। কত আর ফেলুদা,নন্টে-ফন্টে কিংবা পাণ্ডব গোয়েন্দা দিয়ে চলবে। স্মার্টফোনে বেশি কথা বললেই মায়ের বকুনি আর দিদির গার্জেনগিরি।সে এক বিদিবিচ্ছিরি ব্যাপার। মনে পড়ল,রেয়েস মেহিয়ার কথা। বছর দুই আগে মেক্সিকো সীমান্ত পেরিয়ে দুই সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে যে মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে আমেরিকায় ঢুকে পড়েছিল।ধরা পড়ার পর সীমান্ত পুলিশ তাদের আলাদা আলাদা শরনার্থী শিবিরে নিয়ে গিয়েছিল।মেয়েকে কাছে রাখার অনুমতি পেলেও ছেলে স্যামিকে কাছে রাখার অনুমতি পায়নি মা রেয়েস।পরে যখন তারা ছাড়া পেল, মা রেয়েস ছোট স্যামিকে কোলে তুলে নিতে গেল তখন এতদিন পরে মাকে দেখে চিনতেই পারলনা স্যামি।মায়ের কোল ছাড়িয়ে সে চলে গেল। তাই দেখে মা’র কী কান্না! আমাদের ছেলেমেয়েরা দীর্ঘসময় স্কুল বিহীন থাকায় যদি নিজের নিজের প্রিয় স্যর বা ম্যাডামদের দেখে এ জাতীয় ঘটনার শিকার হয় তবে তা কষ্টে! বিচ্ছন্নতা আমাদের শুধু শারীরিক ভাবে বিপন্ন করে তাই না।মানসিক ভাবেও আমাদের বিচ্ছিন্ন করে। যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর। লকডাউন একদিন উঠবে। সবাই যে যার অবস্থানে ফিরবে। কিন্তু যে সার্বিক ক্ষতি সে করে দিয়ে গেল যা সামলাতে আমাদের আরও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। 


শিশু কিশলয়ের শিক্ষিত হবার নানা উপাদান থাকলেও মূলত তিন শিক্ষক তাকে সেই উপাদান সরবরাহ করে।১.বিশ্ব প্রকৃতি ২.জীব ও জড় বস্তু ৩.মানুষ।এখানে বাঁধা ধরা প্রাতিষ্ঠানিকতার কথা এলই না। প্রকৃতিই তার শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করতে পারে।অথচ আমাদের শিশু কিশলয়ের দল সেই পরিবেশের দিকে পিছন করে যান্ত্রিক সর্বস্বতার ধুয়ো তুলেছে।তার কারণ অবশ্যই আমাদের সর্বগ্রাসী বিজ্ঞতা!বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তার আপন গতিতে শালীনতা বাড়িয়েছে। আমরা বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ রচনা লিখে নম্বর তুলেছি আর কাজে কম্মে বেশি বেশি অবিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছি। শিশুকে মুক্ত করার যে প্রাঙ্গন তার ধারে কাছে ঘেঁষতে দিই না। সমূহ বিপদের সম্মুখীন সে কারণে আমাদের প্রজন্ম।রবীন্দ্রনাথ যেখানে সত্য,“আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে,এখানকার এই প্রভাতের আলো,শ্যামল প্রান্তর গাছপালা যেন শিশুদের চিত্তকে স্পর্শ করতে পারে।কারণ প্রকৃতির সাহচর্যে তরুণ চিত্তে আনন্দ সঞ্চারের প্রয়োজন আছে।বিশ্বের চারিদিককার রসাস্বাদ করা ও সকালের আলো,সন্ধ্যার সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করার মধ্য দিয়ে শিশুদের জীবনের উন্মেষ আপনার থেকেই হতে থাকে।....আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল যে শান্তি নিকেতনের গাছপালা পাখিই এদের শিক্ষার ভার নেবে। আর সেই সঙ্গে কিছু মানুষের থেকেও এরা শিক্ষালাভ করবে”(বিশ্বভারতী)। শিশুর শৈশবের চপলতা এখানেই প্রাণ পায়।আবার প্রকৃতির অভ্যন্তরেই যে জীব ও জড় বস্তুর অবস্থান তাকে হাতে স্পর্শ করে ঘ্রাণ নিয়ে তার মধ্যে জন্ম নেবে অনুভূতি। ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবে শিশু কিশলয়। প্রকৃতি তখন তার সহজ পাঠ।এখনকার শিক্ষার সঙ্গে যার কোনো তুলনা চলে না।এখন বেশিরভাগ টাই কৃত্রিমতায় মোড়া। মনে প্রাণে একটি যান্ত্রিক রোবটে পরিণত হচ্ছে সে।শিশুর শৈশব মাঠে মারা যাচ্ছে।শরীর ও মনের বিকাশের জন্য শিক্ষার মুক্ত বাতায়ন তার আবশ্যিকতার মধ্যে পড়ে।শিশুর মধ্যে অনুভূতির জন্ম হলে সে বিকাশক্ষম হয়ে ওঠে। অখণ্ড পূর্ণতার দিকে তার যাত্রা শুরু হয়।বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জীবনের একটি গল্প আছে। মেঘনাদ সাহা তখন নেহাতই ছেলেমানুষ। একবার সরস্বতী পুজোর দিনে মেঘনাদ স্নান- টান সেরে স্কুলে সরস্বতী পুজোয় পুষ্পাঞ্জলি দিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। পুজোর পুরোহিত মেঘনাদকে ডেকে বললেন,তোর আগে বামুনের ছেলেরা অঞ্জলি দেবে তাই লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়া।মেঘনাদ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলেন।এ ঘটনা তিনি বড় হয়ে সভা সমিতিতে যখনই বলতেন কেঁদে ফেলতেন।মেঘনাদের কথায়,জীবনে আর কোনো দিন পুষ্পাঞ্জলি দিতে যাইনি।অথচ সেই মেঘনাদ সাহা যাঁর আকাশচুম্বী প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত হয়ে ছিল গোটা বিশ্ব। সরস্বতীর বরপুত্র বলে যে কথা চালু আছে,মেঘনাদ ছিলেন তাই। শিশুর জীবনের এ জাতীয় বাস্তবতা দিয়েই তৈরি হয় তার মূল্যবোধ। সামাজিক স্তরে নানা ঘটনার পারম্পর্য দিয়েই গাঁথা যায় জয়ের মালা। কিশলয়ের মহীরূহ হওয়ার পেছনে ছোটো ছোটো দুঃখ ব্যথার অনুভূতি তার অজান্তে খেলে যায়।   
           
এ করোনা মহামারী কালীন সময়েও তো আমরা ছোটদের মধ্যে অনেক দায়বদ্ধতার নজির লক্ষ্য করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি।যখন দেখিনিজের কন্যাশ্রীর টাকায় চাল আলু কিনে স্কুলে পড়া মেয়ে দুর্গতদের হাতে তুলে দেয়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে নিজের জন্মদিন পালনের রান্না করা খাবার নিরন্নদের মুখে তুলে দেয়। কিশলয়ের অর্থ যদি কচিপাতা হয়,তবে এদের কি বলব! 
ঐ যে,কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতায় আছে,“ছোট যে হয় অনেক সময় বড়োর দাবি দাবিয়ে চলে/রেখা টেনে ছোটর গতি বড়ো যে জল গাবিয়ে চলে।” কিশলয়ের সার্থকতা এখানেই। এও এক চর্চার মধ্য দিয়ে শিশুর ভেতর গড়ে ওঠে।যা তার বাকি জীবনটা গড়ে দেয়।   
           
নরেন(নরেন্দ্রনাথ দত্ত) তখন বিদ্যাসাগর মশাই প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের ছাত্র।একদিন ক্লাশে ভূগোলের মাষ্টারমশাই নরেনকে একটা প্রশ্ন করেন। সঠিক উত্তর দিলেও মাষ্টারমশায়ের মনে হল উত্তরটা নরেন ভুল দিয়েছে। তাকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। নরেন উত্তর ঠিক দিয়েছে বলে দাবী করায় তার ওপর বেদম বেত্রাঘাত চলতে লাগল। যন্ত্রনাদগ্ধ নরেন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গিয়ে মা’র কাছে ঘটনাটি জানালে মা ভুবনেশ্বরী ছেলেকে বললেন,“বাছা যদি ভুল না হয়ে থাকে , তবে এতে কি আসে যায়?ফল যাই হোক না কেন,সর্বদা যা সত্য বলে মনে করবে, তাই করে যাবে।অনেক সময় হয়ত এর জন্য অন্যায় বা অপ্রীতিকর ফল সহ্য করতে হবে।কিন্তু সত্য কখনও ছাড়বে না।” বিবেকানন্দ বলতেন,“.....আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি মায়ের কাছে ঋণী।” তবেই না তিনি বিবেকানন্দ হতে পেরেছিলেন। এখন তার ঠিক উল্টোটাই আমরা প্রত্যক্ষ করি! অন্ধ পুত্রস্নেহে মা কি নির্মল চিত্তেই না সন্তানকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন! শিশুর রোল মডেল হয়ে মা'ই তো পারেন তাকে কিশলয়ের মর্যাদায় মহিমাণ্ডিত করতে।এক অসহায়তা তাদের গ্রাস করেছে।শৈশবের বিচ্ছিন্নতা তার উপশম নয়।
            
এবার থামার পালা। ‘কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয়/যৌবনের শ্যামল গৌরবে’শুধু কাব্য লেখায় শোভিত অক্ষরমালা হয়ে আমাদের চিত্তের শুশ্রুষা নয়। একটি ধারাবাহিকতা।সেই ধারাবাহিকতায় আমাদেরও একটি দায়িত্ব আছে। ফিরিয়ে দিতে হবে তার নিজস্ব আকাশ। যাতে সে গাইতে পারে,"কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে।”

  লেখক অশোক অধিকারী
      রামরাজাতলা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ
















0 Comments