🔸প্রবন্ধ
✍ মিঠুন রায়🔹ত্রিপুরা🔹
🔰উনিশ শতকের বাংলায় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি অক্ষয় কুমার দত্ত।বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি।তিনি একাধারে সাংবাদিক,প্রাবন্ধিক আবার সাহিত্যিকও।
প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রবন্ধের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁর রচনায় সর্বপ্রথম পরিপূর্ণতা লাভ করে।তাঁর সমস্ত লেখাই ছিল গুরুগম্ভীর তথ্যনির্ভর ও জ্ঞানগর্ভ।
শিক্ষাবিদ অক্ষয় কুমার দত্ত নবদ্বীপ শহর থেকে পাঁচ মাইল উওরে চুপী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৮২০ সালের ১৫ই জুলাই।পিতা পীতাম্বর দত্ত পুলিশ - ইন্সপেক্টর ও মাতা দয়াময়ী দেবী গৃহিণী।কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়।ঐ সময় সেখানকার শিক্ষক হার্ডম্যান জেফ্রয়ের কাছেই গ্রীক্,ল্যাটিন,জার্মান,ফারসি সহ নানা ভাষা শেখেন।পিতার আচমকা মৃত্যুতে লেখাপড়াই খানিকটা বাধা আসে।স্কুল জীবনের ইতি টেনে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।
ঈশ্বর গুপ্তের সাথে পরিচয় হলে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার কাজ শুরু করেন।কিছুদিন বাদেই তও্ববোধিনী সভার সহ-সম্পাদক হন।পরবর্তী সময়ে তও্ববোধিণী পাঠশালায় অক্ষয় কুমার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেন।কুসংস্কার ও অন্ধত্ববাদে বিশ্বাসী ঘরকুনো বাঙালিদের অজ্ঞতা দূর করে মননে বিজ্ঞান চেতনা গড়ার লক্ষ্যে তিনি বিদ্যাদর্শন নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।তাঁর একাজে সহযোগিতা করেন প্রসন্ন কুমার ঘোষ।একসময় অক্ষয় কুমারকে তত্ত্ববোধিণী পত্রিকার সম্পাদক পদে মনোনীত করা হয়।তাঁর প্রচেষ্টায় পত্রিকাটি নতুন রূপ পায়।সাহিত্য,বিজ্ঞান,দর্শন,সমাজতত্ত্ব,ইতিহাস,ভূগোল সহ নানা বিষয়ে পত্রিকায় নানা প্রবন্ধ প্রকাশ হতে থাকে।ঐসময় তিনি প্রাচীন পাঠক্রম এর পরিবর্তে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন পাঠক্রম চালু করার উপর গুরত্ব আরোপ করেন।তিনি শিশুশিক্ষাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন।দুই থেকে ছয় বছর পযর্ন্ত শিশুদের প্রথম পর্বের শিক্ষা।মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পর্বের শিক্ষা হবে ছয়-সাত থেকে চৌদ্দ -পনের বছর পযর্ন্ত।তৃতীয় পর্বের শিক্ষা মানে পনের-ষোল থেকে বিশ-বাইশ বছর পযর্ন্ত।তিনি উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানকে যুক্ত করতে আগ্রহী ছিলেন।বিজ্ঞান প্রসারের জন্য নিজের সম্পত্তির অর্ধেক দান করেন।তত্ত্ববোধিণী পত্রিকার সম্পাদক থাকার সুবাদে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উৎস সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর গভীর পরিচয় ঘটে।একদিকে তিনি যেমন হোমারের ইলিয়াড,এলিড,জয়সের Science Dialogue প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন,অন্যদিকে তেমনি প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র সমূহ আয়ত্ত ছিল তাঁর।
কাব্য রচনার মধ্যে দিয়েই অক্ষয় দত্ত সাহিত্য অঙ্গনে পদার্পণ করেন।মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেরণায় তিনি বাংলা প্রবন্ধ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।চারুপাঠ,ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়,বাহ্যবস্তর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার প্রবন্ধ সমূহ যেমন-বারি বিজ্ঞান,জ্যোতিষ,প্রাণীবিদ্যা,পদার্থবিদ্যা,উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত।তাঁর লেখা "ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়"গ্রন্হটি সুপ্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখক হেম্যান উইলসনের গ্রন্থ অনুসারে রচিত।এই গ্রন্হে তাঁর প্রখর বিদ্যাবুদ্ধি বিচার,উপন্যাস চাতুর্য,অসামান্য শাস্ত্রজ্ঞান এবং প্রবল স্বদেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়।
বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন।'বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা '-নামক প্রবন্ধে তিনি সংস্কারযুক্ত মনোভাব নিয়ে বিধবাবিবাহের সপক্ষে বিবিধ যুক্তি তর্কের অবতারণা করেন।তিনি সমাজসংস্কার মূলক আন্দোলনে বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন।অক্ষয় কুমার দত্ত,মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অন্যান্যদের সাথে ব্রাক্ষ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন।ব্রাক্ষ্ম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হিন্দু হলেও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও শিল্প কলার প্রাধান্য মেনে নেবার মানসিকতা তার মধ্যে ছিল।তিনি বীজগণিতের সূত্রের মাধ্যমে দেখিয়ে দেন যে,মানুষের বাসনা পূরণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা নিস্প্রয়োজন।নারীশিক্ষার প্রসার,বিধবা বিবাহ,বাল্য বিবাহ ও বহুবিবাহ নিরোধ প্রভৃতি সমাজসংস্কারমূলক কাজে তিনি উদ্যোগী হন।স্বদেশী মনোভাবাপন্ন অক্ষয় দত্ত উইলিয়ম গর্ডন ইয়ং -এর দেওয়া চাকরি,শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর-এর পদ তিনি গ্রহণ করেন নি।কলকাতায় নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে অক্ষয় কুমার ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনি ভালোবাসতেন প্রকৃতিকে।উদ্ভিদপ্রেমিক ছিলেন।আমেরিকা ও ইউরোপের নানা স্হান থেকে দুর্লভ বৃক্ষচারা সংগ্রহ করে তিনি তাঁর বাসভবনে শোভনোদ্যান নামক সুন্দর একটি বাগান তৈরি করেন।বাগানের প্রত্যেকটি তরু,গুল্ম ও লতার বিজ্ঞানসন্মত নাম,প্রজাতি ও তার স্বরূপ সংক্ষেপে বর্ণনা করেন।এমনকি নিজের বাড়িতে ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও গড়ে তুলে ছিলেন।
বাংলা গদ্য সাহিত্য রচনায় বিদ্যাসাগরের পরেই স্হান অক্ষয় কুমার দত্তের।গদ্য রচনার স্বার্থে তিনি একটি পরিচ্ছন্ন গদ্যশৈলী আয়ত্ত করেন।অধ্যাপক পরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন -"অক্ষয় কুমার এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমবয়সী এবং প্রায় সমকালেই সাহিত্য জগতে আবিভূত হয়েছিলেন।যে জাতীয় রচনা বাংলা ভাষায় দীর্ঘকাল বিদ্যাসাগরী রীতি বলে খ্যাতি অর্জন করেছেন সে জাতীয় লেখক কিন্তু আসলে অক্ষয় কুমার।"
পরিশেষে বলা যায়,বিজ্ঞানমনস্ক অক্ষয় কুমারের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে একটা কাহিনী উল্লেখ করা প্রয়োজন।গভীর রাত।এক তিনতলা বাড়ির ছাদে স্বামী -স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলছে।যুবকটির অপরাধ,তিনি স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী নন।এই গভীররাতে বাড়ির ছাদে বসে তিনি এক খগোল-যন্ত্র নিয়ে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন।জ্যোতিবিজ্ঞান তাঁর প্রাণের বিষয়।বিরক্ত হয়ে স্ত্রী ছাদে উঠে এসেছেন আজ।এমন লোক কে দেখেছে,যে দুই প্রহর-আড়াই প্রহর রাতে স্ত্রীর শয্যা ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে!এতো সামান্য বিড়ম্বনা নয়!উওরে যুবকটি শান্ত কন্ঠে বললেন,-"এমন লোকের স্ত্রী এরূপ কথা বলে,তা যে আরও বড় বিড়ম্বনার"।এই যুবকটি হল অক্ষয় কুমার দত্ত।বিজ্ঞান,গণিত,,ভূগোলের ক্ষেত্রে তিনি অসংখ্য পরিভাষা তৈরী করেছেন।দ্বিশততম জন্মবর্ষ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে এই মহামানবকে নতুন করে জানার।প্রকৃতঅর্থেই তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞান আন্দোলনের পথপ্রদর্শক।
1 Comments
বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এই আলোচনা যথার্থই সময়োপযোগী উপস্থাপনা।
উত্তরমুছুন