꩞ কবিতা ও বিপ্লব ꩞


                       ꩜ প্রবীর দে🔸কলকাতা🔸




🔵কবিতা ও বিপ্লবের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক তা  অত্যন্ত নিবিড় এবং সে সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরতার ।বিপ্লব কবিতার অন্যতম উৎস ।অপর  দিকে কবিতা বিপ্লবের ধারক ও বাহক।বিপ্লব ছাড়া কি কবিতা হতে পারে না?অবশই হতে পারে।কাব্য সাহিত্যের উৎস বা বিষয়বস্তু তো ভিন্ন ধরনের হতে পারে–আধ্যাত্ন চেতনা,প্রকৃতিপ্রেম,মানবপ্রেম,বিশ্বপ্রেম, বিরহ,রোমান্স,স্বদেশ প্রেম,আরও কত কি। কিন্তু  বাংলা কবিতার তিনটি যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে  আমরা দেখতে পাই, উত্তর আধুনিক যুগে এসে বিপ্লবের সাথে কবিতা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ।

কবিতা হল কবির উপলব্ধিজাত এক বিশেষ
শিল্প ভাবনার বহিঃপ্রকাশ যা কবির বাস্তবতা বোধের উন্মোচন। কবিতা মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, কবিতা মানুষকে প্রতিবাদী হতে সাহায্য করে,কবিতা চিন্তাকে জাগ্রত করে,প্রেরণা দেয়।
আর সাধারন অর্থে বিপ্লব হল রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন যেখানে জনগণ বিদ্রোহ করে জেগে ওঠে । বিপ্লব সেখানে সংস্কৃতিগত,অর্থনীতিগত, সামাজিক , রাজনৈতিক, পরিবর্তন সাধন।
কিন্তু বিপ্লব শব্দটির ব্যাপক অর্থ অনুসন্ধানে যদি একটু মন দি তবে কবিতা ও বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য  পারস্পরিক সম্পর্ককে হয়ত বিশ্লেষণ করতে সুবিধা হবে।আর একটা কথা বলে নিই,আমার আলোচ্য বিষয় কিন্তু শুধু বাংলা কবিতাতেই সীমাবদ্ধ।
বিপ্লব হচ্ছে চেতনার নির্মাণ এবং নির্মিত চেতনার সফল বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া,যা স্বল্প সময়ে অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারে কিংবা অতি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। বিপ্লবের সংশ্লিষ্টতা রাজনীতি বা সমাজ সংস্কারের সাথে  অধিকতর জুৎসই হলেও মনোবৃত্তিক কর্মকাণ্ড - ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রেও বিপ্লব ততোটাই কার্যকর এবং জীবন্ত। বিপ্লব ঘটেছে বলেই বাংলা সাহিত্য তার আদি  যুগ ছেড়ে ক্রমান্বয়ে ক্রমঃউৎকর্ষে  উত্তরাধুনিক ও পরাবাস্তবতায় এসে পৌঁছেছে। ১৯০৭ সালে নেপাল রাজদরবারের সংগ্রহশালা হতে মহামহোপাধ্যায়   হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কারই বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বড় বিপ্লব।
প্রাচীন যুগ হতে উত্তরাধুনিক যুগ অব্দি কবিতার পঠন-পাঠনে বাংলা কবিতায়  বিপ্লবের ধারাকে  যদি  ভাগ করি তবে  যে সমস্ত বিপ্লবের ধারা  লক্ষ্য করি সেগুলি হল সামাজিক বিপ্লব, শিল্প ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ,রাজনৈতিক বিপ্লব ধর্মীয় চেতনার বিপ্লব ,দার্শনিক বিপ্লব,কবিতা প্রকাশের ক্ষেত্রে  প্রযুক্তিগত কৌশল বিপ্লব  প্রভৃতি। স্বল্প পরিসরে আমার আলোচ্য শুধুমাত্র  সামাজিক বিপ্লব ও রাজনৈতিক বিপ্লব বাংলা কবিতাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তার অনুসন্ধান।

                        ১

দেশের ভেতরের বা বাইরের ঘটিত সামাজিক বিপ্লব বা রাজনৈতিক বিপ্লব যেমন কবিতাকে প্রভাবিত করে  আবার কবিতার হাত ধরে বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের চেতনা বিশ্বে যে নতুন সমাজপ্রবাহের সৃজন ঘটিয়েছিল, সেই চিন্তাস্রোতের মানবিক আকুতি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ ঘটেছিল। আবার নারী যখন কেবল অন্তঃপুরবাসিনী না থেকে এক কথায় বলতে গেলে অদম্য লড়াইয়ে সমাজের হয়ে কলম ধরে ,সেও এক সামাজিক বিপ্লব। প্রথম মহিলা বাংলা
কবি চন্দ্রাবতীর হাত ধরে কবি হিসেবে নারীর আবির্ভাব কিম্বা মাহমুদা খাতুন,পরবর্তীকালে সুফিয়া কামালের হাত ধরে কবিতায় নারীকে প্রাধান্য দেওয়া–সেইটিও ছিল বড় বিপ্লব,সামাজিক বিপ্লব।
বাংলা কবিতায় সে সব কবি সাম্যবাদী চেতনা ধারণ করে উদ্ভূত বাস্তবতাবোধ,মানবপ্রীতি ও নিগৃহীত মেহনতী মানুষের কথা তুলে ধরেছেন এবং কবিতায় সাম্যবাদী চেতনায় ঐক্যের সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছেন তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই যে লাইনগুলি সবসময় চোখে ভাসে তা হল ..
—‘সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।
কবি কামিনী রায়ের ‘সুখ’ কবিতার উপরোক্ত এই লাইন দুটি আমাদের অবলীলায় সাম্যবাদের সহজ অভিব্যক্তি প্রকাশ হওয়ার কথা বলে দেয়।
আবার মহাসাম্যের বাণী প্রতিধ্বনিত হয় কবি
সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের কবিতায় সমান হউক মানুষের মন,সমান অভিপ্রায়,মানুষের মতো,মানুষের পথ এক হক পুনরায়;সমান হউক আশা অভিলাষ সাধনা
সমান হোক,
                           
                          ২

যুগধর্ম ও সমকালের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো লেখকের চিরকালীন বৈশিষ্ট্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ফ্যাসিবাদীদের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে।এরপর থেকেই  রবীন্দ্রনাথকে আমরা সাম্যবাদী ধারণা নিয়ে কবিতা লিখতে দেখতে পাই। এটা ঠিক রবীন্দ্রনাথ সাম্যবাদী কবি নন। তবু বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ সাম্য চিন্তার উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন এবং সাম্যের আলোয় নতুন যুগ ও জীবনের আবির্ভাব হবে এই চিন্তা তাঁর শেষ জীবনের সৃষ্টিগুলোর মাঝে বারবার প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। তাঁর বেশ কিছু কবিতায় এর প্রমানও মেলে। যেমন: পুরাতন ভৃত্য, দুই বিঘা জমি, এবার ফিরাও মোরে,

                        ৩

এরপর তেজদীপ্ত উচ্ছ্বাস আর বিপ্লবী মন্ত্র নিয়ে কবিতায় বিদ্রোহের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে এলেন  কাজী নজরুল ইসলাম। দুর্দশায় শোষক গোষ্ঠী সর্বদা শোষিতকে শোষণের যাঁতাকলে রেখেছে পিষে; কবিতা সেই শোষণের বিরুদ্ধে সমাজে রুখে দাঁড়িয়েছে। তাই আমরা কবির কণ্ঠেই শুনি-
আমি সেইদিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।
এটা ঠিক তিরিশের দশকে বাংলা কবিতা্য় নভেম্বর বিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছিল ব্যাপক ভাবে  যা কিনা সামাজিক বিপ্লবকে সুচিত করেছিল এবং সে সামাজিক বিপ্লব চেতনা রাজনৈতিক বিপ্লবকে অক্সিজেন  জুগিয়েছিল শুধু কবিতার হাত ধরে।এই বিপ্লবের বাতাবরণেই নজরুল তাঁর সৈনিক বৃত্তি ত্যাগ করে সাহিত্য কর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেন। তাঁর কবিত ,গান এদেশের বিপ্লবকে যথেষ্টই প্রভাবিত করেছিল।নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব পরেছিল তাঁর একাধিক কবিতায় –বিদ্রোহী , সাম্যবাদী,ফরিয়াদ ,আমার কৈফিয়ত ,সর্বহারা, প্রভৃতি ।তাঁর প্রলয়োল্লাস কবিতাটি ভারতে কমিউনিসট পার্টির সৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছিল।
সাম্যবাদী জীবনের চেতনায় ঔপনিবেশবিরোধিতা এবং জাতীয়তাবাদ নজরুলের মধ্যে মহত্ত্বর বোধে চালিত হতে পেরেছে। নজরুল তাঁর কাব্যজীবনের প্রারম্ভ থেকেই হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অভিন্ন বলয়ে স্থাপন করতে পেরেছিলেন। অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলন যখন কতকটা স্তিমিত, তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাতাস তীব্র হয়ে উঠল। নজরুল তখন বাঙালি জাতির সামনে নিয়ে এলেন মানবতাবাদের শাশ্বত বারতা।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/
কাণ্ডারী! বল মরিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’
 তার ভাবনায় সমুন্নত ছিল মানবজাতির ঐতিহ্য।
এও তো এক বিপ্লব যা এসেছিল কবিতার হাত ধরে।

                        ৪

এরপর তিরিশ ও চল্লিশের দশক সময় ধরে সাম্যবাদী চেতনার উৎসারণ-এর ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে দেখা যায়। সেই সময় বিষ্ণু দে, সমর সেন,প্রেমেন্দ্র মিত্র,অরুণ মিত্র, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়,সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস,জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র,সুকান্ত ভট্টাচার্য,   প্রমুখ কবি বাংলা কবিতার ভুবনে মার্কসীয় চেতনার দ্বারা সাম্যবাদের জয়গান গাইলেন।বেশ কিছু
পত্র-পত্রিকা যেমন:অগ্রণী, অরণী, পরিচয়, প্রতিরোধ ও আকাল ইত্যাদি পত্র-পত্রিকা সাম্যবাদের চেতনায় কবিতা প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে  আরম্ভ করল ।
নজরুল পরবর্তী ত্রিশের দশকে এসে সাম্যবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত অন্যতম কবি হচ্ছেন বিষ্ণু দে। বিষ্ণু দে  তাঁর কবিতার উপজীব্যে তাত্ত্বিকাতায় ও প্রকরণে মার্কসীয় সাম্যবাদী দৃষ্টির আলোকপাত করেছিলেন। সেখানে তিনি  মননধর্মী ও বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পনৈপুণ্যের উচ্চমার্গে কবিতাকে উপস্থাপন করেছিলেন। মার্কসবাদী সাম্যের গভীরে আস্থা ও বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমাজের বাস্তবায়নে  ঐকান্তিক প্রত্যয়কে  দৃঢ়ভাবে তাঁর কবিতার দ্বারা উপস্থাপিত করেছেন।
ত্রিশের দশকের শেষ সময়ের আরেক কবি সাম্যবাদী চেতনা নিয়ে কবিতাচর্চায় যিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন যে, আমি রোমান্টিক কবি নই - মার্কসিস্ট, তিনি হলেন কবি সমর সেন।সেই সময়ের তাঁর কয়েকটি কবিতাগ্রন্থ যেমন—গ্রহণ, নানা কথা,খোলা চিঠি, তিন পুরুষ ইত্যাদি। এইসব কবিতাগ্রন্থে সমর সেন সাম্যবাদী চেতনার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন বলা যেতে পারে।

জীবনানন্দ দাশের সময়কেও আমরা একটু দেখে নিতে পারি। রুশ বিপ্লবোত্তর সময় সেটা।বিশ্ব যুদ্ধ একদিকে পুরনো মূল্যবোধগুলির ধ্বংস দেকে আনছিল, অন্যদিকে রুশ বিপ্লব দরিদ্র উপেক্ষিত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন সফল করার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঐ সময় কিছু মানুষের বিশ্বাস এল, মার্কসবাদ জীবনের অন্তঃস্থলে  রহস্যাবৃত অন্ধকারকে আলোকিতও করে  তুলেছে। আবার একদল ছিল মার্কস বিরোধী ।এইরকম ওলটপালট  আবহাওয়ায় আবির্ভূত হলেন জীবনানন্দ দাশ ।স্বপ্নভঙ্গ জাতির যখন মনগত পরাজয় থেকে উঠে দাঁড়াবার জন্য যখন অনুপ্রেরণার দরকার...কবি তখন শোনালেন …” হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…”। হয়ত  তাঁর পরিচয় তিনি রূপসী বাংলার কবি। জীবনানন্দ নিয়ে এলেন নতুন চেতনার জগত।
এরপর এলেন পদাতিক কবি সুভাষ  মুখোপাধ্যায়।   সুভাষ হলেন প্রথম নিঃসংশয় সাম্যবাদী কবি। তিনি ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। রাজনীতিবিদ ও কবির বিরল এক সমন্বয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘পদাতিক’ কাব্যের পাঠককেও তিনি একজন কমরেড ভাবেন বলেই ‘পদাতিক’ কাব্যের প্রথম উচ্চারণ ‘কমরেড’।
কমরেড, আজ নতুন নবযুগ আনবে না?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।
লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা-
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,
কমরেড,আজ নবযুগ আনবে না?


বাংলা কবিতায় বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করব আর  রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর যুগের তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর কথা ভুলে যাব সে সাহস কোথায় ...।
হ্যাঁ ,তিনি হলেন  বিপ্লবী কবি ,গণজাগরণের কবি, সমাজতন্ত্রের আদর্শের কবি ,যিনি চে গুয়েভারার মতো বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। সাম্যবাদে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। যিনি নজরুলের মতোই তার কাব্যে উচ্চারণ করে গেছেন অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সংগ্রামের শব্দমালা। যিনি বিপ্লব ও গণমানুষের মুক্তির পক্ষের সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন বারবার। লড়াকু সৈনিকের মতো কাজ করেছেন প্রলেতারিয়েত জনগোষ্ঠীর ও কৃষক-শ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার প্রত্যয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা কবি।
                           
                        ৫

সাতচল্লিশোত্তর কালে বাংলা কবিতা বিকশিত হয়েছে  অমোঘ গতীতে  ভিন্ন মাত্রায়। বাংলাদেশের কবিতায় মুখ্যত যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের জীবনসংগ্রাম-দেশপ্রেমের ছবি, মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামের ছবি । পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় সেখানে দেখি আবার চেপে বসেছে অনন্বয় আর অসঙ্গতির কর্কট-ছোঁয়া।সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলায় রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে কবিতা প্রগতিশীলতার প্রধান হাতিয়ার রূপে এগিয়ে আসে।পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে  বিষ্ণু দে,বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত অমিয় চক্রবর্তী,বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ এবং বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব-শামসুর রাহমান-শহীদ কাদরী-মোহাম্মদ রফিক-নির্মলেন্দু গুন,পরের দিকে মহাদেব সাহা ,রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহ আরও অনেকে এই ধারায় কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের খাদ্য আন্দোলন; মুল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন; ট্রাম শ্রমিকদের আন্দোলন; এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলন; ভিয়েতনামের মুক্তি যুদ্ধের সমর্থনে গড়ে ওঠা সংহতিমূলক গণআন্দোলন –একের পর এক গণ আন্দোলন রাজপথে ফেটে পড়ছিল।১৯৬৭ সালে ঘটল নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান।সত্তরের নকশাল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বিপ্লবকে  কবিতার সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল নিপুণ ভাবে।
কবি মনিভূষণ ভট্টাচার্য দেখালেন তার  কবিতায় এক স্বপ্ন ভঙ্গের মধ্যে দিয়ে  আরেক নতুন স্বপ্ন নির্মানের গল্প। স্বপ্ন যেখানে জীবনকে অতিক্রম করে।

নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতায় আবার শোনা গেল…
রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই তীব্র ঘৃনা আর জেহাদ-
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ...
এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না ......
কবিতা এখানে এসে বিপ্লবের সাথে  যেন মিশে গেছে ... নবারুন ভট্টাচার্যর কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে বলতেই পারি-    কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না .....।।  কবিতা সশস্ত্র ,কবিতা স্বাধীন , কবিতা নির্ভীক।। এ সময়ে  একটু অন্য ফরমে  সামাজিক প্রতিবাদকে কবিতায় রূপ দিতে আমরা দেখতে পাই শক্তি-সুনীলের কবিতায়।
                   
                        ৬

উত্তরকালে, ষাট-সত্তর-আশির সময়খণ্ডে,উভয় বাংলার কবিতাকেই এলো নতুন এক আন্তর্জাতিক চারিত্র্য। ল্যাটিন আমেরিকা আর আফ্রিকার মুক্তিকামী কবিতাবিশ্ব প্রবলভাবে প্রভাবিত করল বাংলা কবিতাকে। নিম্নবর্গের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে লেগে উঠল ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকার শিল্প প্রেরণায়।
আশির দশকে বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এত বেশি উচ্চকিত হয়ে ওঠে যে কবিতা হয় স্লোগান নয় শরীরী প্রেমের মধ্যে ডুবে থাকে। কিন্তু স্বৈরাচার পতন এবং একই সময়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সোভিয়েত পতনের কারণে কবিতা যেন দিকহারা হয়ে পড়ে। এসময়ে নব্বই দশক আবার নানা রঙিন
পুষ্পে পল্লবিত হয়ে বাংলা কবিতার চেহারা পালটে দেয়। বাংলা কবিতা মুক্তি লাভ করে কেন্দ্রমুখিনতা থেকে।বহুভাষিকতা আর বহুচেতনার সমন্বয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ।এসময়ে লিটল ম্যাগাজিনগুলো বৈপ্লবিক ভূমিকা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। এই সময় থেকেই কবিতা যেমন বিকেন্দ্রিত হয়েছে তেমনি বৈচিত্র্যও লাভ করেছে।
একবিংশ শতকে এসে কবিতায় বিপ্লব আর সেভাবে দানা বাঁধতে পারে নি ।এ হল রাজনীতি-বিমুখতার কাল। এর মধ্যেও কবিতা  রচিত হয়েছে,কবিতা যে   হচ্ছে না তা নয় ,এই দ্বিতীয় দশকে যারা কবিতা লিখছেন, তারাও এই রাজনীতি বিমুখতার ভেতরেই নিজেদের কবিতাকে তৈরি করে নিচ্ছেন। তবে জয় গোস্বামী, শ্রীজাত, সুবোধ সরকার,
মন্দাক্রান্তা সেন, ফরহাদ মাজহার,
আকবর আলি খোন্দকার ও আরও অনেকের কবিতায় আমরা সামাজিক প্রতিবাদ দেখতে পাই।
তবে এই দুই দশকে কবিতায় ঘটে  গেছে অন্য এক বিপ্লব। টেকনোলজির বিকাশ কবিতাকে এনে দিয়েছে  মানুষের হাতের মুঠোয়। কবিকে এখন আর প্রতীক্ষা করতে হয় না দীর্ঘ সময়কাল, কখন ছাপানো হবে, কখন পৌঁছাবে পাঠকের হাতে, কখন কেউ এসে বলবে, “খুউব ভালো লাগলো কবি”।একটা কবিতা লিখে কবি আর কী এমন চায় — নাই অর্থ, নাই প্রতিপত্তি — শুধু কেউ যেন কানে কানে বলে — ভালো লাগল, খুব ভালো লাগল। সেই দুটি কথা শোনার জন্য আজ আর প্রতীক্ষার প্রয়োজন নেই ।এও এক মহা বিপ্লব । সেই জন্যই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পা ফেলে  আমরা সম্মুখীন হয়ে পড়েছি এক মহা বৈশ্বিক পরিবেশের। কবিতা  তাই আবার নতুন কোন বৃহৎ সামাজিক ও  রাজনৈতিক বিপ্লবের সুচনা  করতে চলেছে ...এ কথায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
পরিশেষে বলি , কবিতা বিপ্লবের সাথে  সংশ্লিষ্ট যে কোন শিল্প- সংস্কৃতি- সাহিত্য ,কোন না কোন শ্রেনী স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে। এটা  যেমন শোষক বা শাসকের জন্য সত্যি, তেমনই নিপীড়িত মেহনতি মানুষের জন্যও সত্যি।শ্রেনি সংরামের বিকাশের এক একটা স্তরে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটা  খুব আশু কর্তব্য হিসাবে সামনে চলে আসে,তখন
শিল্প–সাহিত্যকেও সেই বিশেষ স্তরকে ছুঁয়ে ,এমনকি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়।বিপ্লব তো বিভিন্ন মুখি ,তাই বিপ্লব চলবেই আর কবিতাও তার হাত ধরে প্রবাহিত হবে অনন্তকাল ধরে।


কৃতজ্ঞতা---
১.বিপ্লব ও বাংলা কবিতা----সম্পাদনা ,ফাল্গুনী দে, দে পাবলিকেশন্স
২.এই সময় ও জীবনানন্দ --সম্পাদনা, শঙ্খ ঘোষ,সাহিত্য একাডেমি
৩.bn bangla pria.org৪.এম মঙ্গলধ্বনি ওয়ার্ডস ডট কম
৫.জয়ন্ত চৌধুরী--ফিরে দেখা-সত্তর দশকের কবিতার খন্ড আলোচনা ,অনুষ্টুপ
৬.শঙ্খ ঘোষ----কবিতার মুহুর্ত,অনুষ্টুপ
৭.নজরুল রচনা সমগ্ৰ
৮.www.porobas .Com
৯.www.shodhadanga.flintiff .com
১০.অলোক বিশ্বাস -নয়ের দশকের কবিতা সম্বন্ধে।কবিতা ক্যাম্পাস
১১.সব্যসাচী দেব সম্পাদিত ---সমর সেন নানা কথা,অনুষ্টুপ
১২.সুবীর  রায়চৌধুরী সম্পাদিত--বিষয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়----দেজ পাবলিশিং
@ প্রবীর দে সংরক্ষিত
(৭.৪.২০১৯  তারিখে কলকাতার শহীদ সূর্য সেন ভবনে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে   বাংলা কবিতা  ও বিপ্লব  শীর্ষক বক্তৃতার অনুলিপি )






0 Comments