
যাদবপুর - যার নাম করলে প্রথমেই মনে পড়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। উৎকর্ষতার নিরিখে দেশে এবং বিদেশে যার স্থান সামনের সারিতেই।তবে শুধুমাত্র এটুকু বললে আরও অনেককিছুই না বলা থেকে যায়,যাদবপুরের হাজারো ইতিহাস চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।এই যাদবপুরেরই অন্যতম একটি ব্যস্ত রাস্তা সুলেখা মোড়।সকাল থেকে সন্ধ্যা ব্যস্ত মানুষদের ভিড়ে প্রতিনিয়ত পদপিষ্ট হয় সুলেখা মোড়ের প্রকৃত ইতিহাস।একদা যে ইতিহাস এখানে সর্বক্ষণ কথা বলতো,যে সুলেখা মোড়ের নাম কালের প্রভাবে জড়িয়ে পড়েছিল স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে আমরা হয়তো তার খোঁজ রাখি না।
স্বদেশী আন্দোলন,ইতিহাসের পাতা বলছে সময়টা উত্তাল।লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ এবং তারই সূত্র ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের লেলিহান অগ্নিশিখায় সমগ্র বাংলা তখন পুরোদমে জ্বলছে,বাতাসে বারুদের গন্ধ তখনও টাটকা।অন্যদিকে ইংরেজ সরকারের অত্যাচারও মাত্রাছাড়া।স্বাধীনতাকামী মানুষদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ব্রিটিশ পুলিশের সংঘর্ষে নতুন করে উতপ্ত হয়ে উঠছে দেশীয় রাজনীতি।একসময় শুরু হলো সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ।পুলিশি জুলুমের মুখে বন্ধ হলো ' যুগান্তর ' পত্রিকার অফিস।এখানেই শেষ নয় মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হলো ' সন্ধ্যা ' পত্রিকার সম্পাদককে।এমন সময় কলম ধরলেন ' সঞ্জীবনী ' পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র।১৯০৫ সালের ১৩ জুলাই দেশজুড়ে চলা অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে দেশবাসীকে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সামগ্রিক ' বয়কট ' - এর আহ্বান জানালেন তিনি।এতেই আগুনে পড়লো ঘি - ইংরেজ সরকারের দমননীতির গ্রাফ আরও ঊর্ধ্বমুখী হলো।কিন্তু অন্যদিকে ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষ তখন স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য উদ্বেল।স্বাভাবিকভাবেই শুরু হলো বিদেশি স্কুল কলেজ আদালত বর্জন। লক্ষ লক্ষ ছাত্র - ছাত্রী প্রথাগত পুঁথিভিত্তিক বিদ্যাকে বিসর্জন দিয়ে যোগ দিলো স্বদেশী আন্দোলনে।এখানেই থেমে না থেকে এবার শুরু হলো বিদেশি পণ্য বয়কট সঙ্গে চলতে থাকলো স্বদেশী পণ্যের উৎপাদন।আর এর সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে যাদবপুরের ' সুলেখা মোড় ' - এর নাম জড়িয়ে পড়লো স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে।
বাংলাদেশের ' রেশমীনগর ' রাজশাহী।এই শহরেরও ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস।লক্ষণাবতি আর মহাস্থানগড়ের গৌরব আজও বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের গর্বের শহর রাজশাহী।এখানেই জন্ম ননীগোপাল এবং শঙ্করাচার্য - এই দুই ভাইয়ের।জন্মের পর থেকেই পাল্টে যাওয়া সময়ের সাক্ষী ছিল এই দুই ভাই।লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ হোক বা স্বদেশী আন্দোলনের উন্মাদনা সবকিছুই স্পর্শ করছিলো তাদের।বদলে যাওয়া সময়ের মধ্য দিয়েই পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির আলোর রেখাটুকু বোধহয় দেখতে পেয়েছিল তারা,স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁচ স্পর্শ করেছিল তাদেরও। ননীগোপাল ও শঙ্করাচার্য যোগ দিলেন স্বদেশী আন্দোলনে।তবে শুধু বিদেশী পণ্য বয়কটের মধ্যেই থেমে থাকেনি তাদের লড়াই একইসঙ্গে তারা শুরু করলেন স্বদেশী পণ্য উৎপাদন।আর এই এই তালিকায় প্রথম নাম হলো ' সুলেখা কালি।' ননীগোপাল এবং শঙ্করাচার্যের হাত ধরেই প্রথম তৈরি হলো ' সুলেখা ওয়ার্কস লিমিটেড।' এই কোম্পানি পরে চলে আসে কলকাতায়।প্রথমে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট এবং তারও পরে যাদবপুর।
১৯৩৪ থেকে জয়যাত্রা শুরু হয় সুলেখা কালির যা স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও অব্যাহত। এতদিনে ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে ' সুলেখা ওয়ার্কস লিমিটেড " - এর।পশ্চিমবঙ্গ সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যে সুলেখা এখন একটি পরিচিত ব্র্যান্ড।যা আমাদের সবার অজান্তে ইতিহাসের পাতায় নথিভুক্ত করে ফেলেছে যাদবপুরের সুলেখা মোড়ের নামও।
0 Comments