একটি আ-খোলা চিঠি ~ অন্তরা দাঁ এর মুক্তগদ্য


একটি আ-খোলা চিঠি
অন্তরা দাঁ

তোমায় একটি চিঠি লিখতে চেয়েছিলাম ঠাকুর,২৫ শে বৈশাখ ভোররাতে। এখন তো জানো দিনরাত্তিরের কোনো আলাদা রুটিন নেই, একটানা যতিচিহ্নবিহীন চলছে জীবন। মানুষ সারাজীবনে যা কাজ করে তার জন্য হাঁফিয়ে ওঠে, অকাজের জন্য মাথা কুটে মরে, অথচ দ্যাখো অকাজগুলো যখন নাগালের ভেতর সারিসারি দাঁড়িয়ে, কাজ খোঁজার মস্ত ফিকির তখন! যা আমরা অকাজ বলে ভাবি, মানুষ যে তার জন্যই বুক ভরে শ্বাস নেয় গো! এই দ্যাখো, ইনিয়েবিনিয়ে নিজের কথাই বলছি শুধু, তোমার কথা শুনি, বলো? রবিবাবু... 
ইসসস! কী আস্পর্ধা দ্যাখো মেয়ের! নাম নিচ্ছে কেমন!খুব সাধ হয় জানো  সেই স্বদেশী যুগ, জোড়াসাঁকোর বাড়ি, চন্দননগরের ঘাট, বাগান,সব সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি ! এখনকার সেসব নয় মশাই, তোমার দুটি চোখ দিয়ে! এমন কোমলমতি পুরুষ , আদ্যান্ত রোমান্টিক, শৌখীন, কবিতা লিখিয়ে মানুষ তুমি,সব বাঙালি মেয়েই যে মনে মনে তোমার গলায় মালা দিয়ে বসে আছে, সে আর বলতে ! তুমিই তো শিখিয়েছ,

'দেবতারে  প্রিয় করি 
প্রিয়রে দেবতা '

আমি বললেই দোষ হলো বুঝি? ঝড়ের রাতে যে মেয়ে গীতবিতান বুকে করে শুতে যায়,তাকে চেনার তোমার কোনো দায় না থাক, তার তো আছে!মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মতো ফ্রিল দেওয়া কনুইহাতা ব্লাউজ আর ধনেখালির খড়কে ডুরে শাড়ি আটপৌরে করে পরে, শ্বেতপাথরের রেকাবিতে করে, সাদা তালশাঁস, জামরুল, গোলাপখাস আম ফালি ফালি করে কেটে, সাজিয়ে তোমার সামনে রাখা মেগগ্নি কাঠের টেবিলের ওপর রাখি। আর পাথরের গেলাসে বেলের পানা। তুমি খোঁপায় জুঁইফুলের গোড়ে দেওয়া ভালোবাসো বুঝি, আর চওড়া করে কাজল পরা? 
ফলসা রঙের শাড়ি যে তোমার বেশ ভালোলাগে তা জেনেছি,আর ফ্রন্ট লক্স কাটা...ওই যে লিখেছিলে—

'এক গুছি চুল বায়ু উচ্ছ্বাসে কাঁপা 
ললাটের ধারে থাকে যেন অশাসনে 
ডাহিন অলকে একটি দোলনচাঁপা 
দুলিয়া উঠুক গ্রীবাভঙ্গির সনে '

দোলনচাঁপা টাপা চাপ হয়ে যাবে, দেখি এমনি চাঁপা যদি পাওয়া যায়, কিম্বা হেয়ার একসেসরি, অনলাইনে খুঁজে দেখতে হবে। আর ওই যে বলেছিলে, 

'যেমন আছ তেমনি এসো 
আর কোরোনা সাজ '

যেমন আছি, তেমনই গ্রহণ করা যায়? কাওকেই?  বুদ্ধির প্রসাধন দিয়ে যদি না তাকে মেজেঘষে উপযুক্ত করে তুলি!ওসব পুরুষমানুষের কথার কথা !বাগানে দেখা হবে বুঝি, ছাদের বাগানে? জলসায়? সেই ধুতি আর কালো গলাবন্ধ  চাপকান পরে? কাঁধ অবধি চুল? সেই দুটি স্বপ্নালু চোখ! 
হাজার হাজার মেয়ের হার্টথ্রব? উফফফফফ! ভাবনাতেই তাঁর একী শিহরণ, একী শিহরণ! যত কবিতা লিখেছ তুমি, প্রিয় মানুষটির সাথে দেখা হওয়ার সময়টুকু বেশিরভাগই সন্ধেবেলা, তা বেশ গো, আমারও সেই সময়টিই সবচাইতে পছন্দ! তাই হবে প্রিয়! 

'কাঁচল পরি আঁচল টানি  আঁটিয়া লয়ে কাঁকনখানি 
নিপুণ করে রচিয়া বেণী বাঁধিবে কেশপাশ '

কাঁকন আর নূপুর যে তোমার পছন্দের অলঙ্কার, সে আমি খুব বুঝেছি! কাঁকন পরেই আসবো অভিসারে, নূপুরের ঝুমঝুম শব্দে যদি জানাজানি হয়?! নারীর সব সাজ সব আভরণ যে নিরাভরণে পরিপ্লুতি পায়, সে কেন বোঝনা তুমি! প্রিয়মিলনের জন্য জোৎস্নারাতই ভালো, বেশ একখানা সোনার থালার মত চাঁদ উঠবে, শিরীষডালের ফাঁকে কিশোরী  সন্ধ্যাতারাটি যুবক চাঁদের জন্য অপেক্ষা করবে, এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের হাতে হাত, চোখে চোখ... কেমন হয়? রবি? আমার পায়রার মতো দুরুদুরু বুকে যে কী হয় তোমায় লিখতে লিখতে, তুমি জানোই না! তুমি ফুলমালা ভালোবাসো, আমি যে তোমার জন্য প্রতিদিন বিনিসুতোয় মালা গাঁথি, আমার অক্ষরমালা কন্ঠে নেবে না প্রিয়? আমি গান গাইতে জানিনে,  তুমি আমায় গান শোনাবে? পাখিরা যখন নীড়ে ফিরবে, পশ্চিমদিকচক্রবালে সূর্য হেলে পড়বে, পৃথিবীর সব নদী যখন ধানসিড়ি হয়ে যায়, সব আলো মেখে নেয় শান্ত ঠোঁট, তুমি আমায় শোনাবে চিরদিনের সে গান,সে সুর? আমি ময়ূরকণ্ঠী ব্লাউজ আর দূর্বাশ্যামল আঁচল, মানে কী মস-গ্রীণ? তেমন কনট্রাস্টই তোমার ফেভারিট ? অমন করে হেসো না ঠাকুর, কত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি, একবারও ভাবলে না? কী করি, আমার তো তোমার মতো অমন চিরনবীন মন নেই গো, তবু ইমন ভূপালি বাজে আমার বুকের ভেতর অহরহ তোমার জন্য। বীণা বাজাতে শিখিনি, তুমি আমার জীবনজুড়ে বাজিয়েছ প্রাণ, আমি সে সুরে বিবশ, আমি প্রাণের বীণায় সমর্পিত। 
আজ সমস্তদিন তোমার সাথে যাপন, তোমার সাথেই খেলা, কেউ না জানুক, তুমি জানো ঠাকুর, এ প্রেম সব্বোনাশা, ঘরবার এলোমেলো করে দেয় এ ভালোবাসা! তবু কী আর করি বলি বলো?  

'একই অস্ত্রে হত হলো মৃগী ও নিষাদ '
যুবনাশ্ব। 

তুমি আমার নিষাদ হও প্রিয়তম। 
ওই দ্যাখো সকাল হয়ে এলো, পূব আকাশে লালচে আভাস, আমার অভিসারের সময় ফুরিয়ে আসছে গো, আজ আবার মেঘ মেঘ করছে কেমন! 
এখন রাখি আমার কলম, তবে এ চিঠি এখনি তোমায় পাঠাবো না, সন্ধেকালীন প্রসাধনে রজনীগন্ধার যে আতরটুকু লেগে থাকে আমার স্তনসন্ধির মাঝে, সেই সুগন্ধি মাখিয়ে  পাঠাবো তোমায় বাইশে শ্রাবণ, বাদল বাতাসের খামে, ততদিন একটু একটু করে লিখবো, তুমি পড়বে তো? 

(সবমানুষের জীবনে এমনকিছু চিঠি থাকে যা পৌঁছে দেওয়ার কোন দায় থাকে না, না প্রেরকের, না আর কারোর, এ তেমনি এক প্র‍য়াস।) 

গদ্যকার অন্তরা দাঁ
কাঁটাপুকুর উত্তর, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ




















0 Comments