সুমিত রায়ের গল্প


এ কেমন স্বাধীনতা!

রিয়ম ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সকালে প্রাইভেট টিচার পড়ানোর পর স্কুল-স্কুল থেকে ফিরেই আবার প্রাইভেট, তারপর বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে স্কুলের পড়া তৈরি করা। এই হল ছোট্ট রিয়মের দৈনিক রুটিন। অপেক্ষায় থাকে কবে ছুটি পাবে। সপ্তাহে একদিন রবিবার ছুটি-তাও আবার সেদিন নাচের ক্লাস, ড্রয়িং ক্লাস, গানের ক্লাস...। 
         
দাদার কাছে শুনেছে,সামনে আগস্ট মাসের ১৫ তারিখে সব ছুটি। স্কুলে পড়াশোনা হবে না। টিউশন স্যার আসবেন না পড়াতে। কি মজা! আনন্দে যেন রিয়ম ফুলেফেঁপে উঠছে। রিয়মের সেই রাতে ,ঘুমের মধ্যে অনেক স্বপ্ন এসেছিল। অনেক ছবি এঁকেছিল মনের খাতায় কল্পনা শক্তির সাহায্যে। ভেসেছিল পড়ার জগৎ থেকে অন্য এক জগতে। এক এক করে যেন সব সাজিয়ে রেখেছে,কালকে স্কুল থেকে ফিরেই এক এক করে সব খেলা খেলবে বন্ধুদের সাথে।
           
আজ ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস। আজ সকালে রিয়মকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাবা-মা দুজনই নিজেদের স্কুলে চলে গেলেন। বাবা-মা দুজনেই স্কুলে চাকরি করেন।  ফেরার পথে তারা স্কুল থেকে রিয়মকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। এতক্ষণ রিয়ম স্বাধীনতার ছুটির আনন্দেই ছিল। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণ পর বাবা যখন বলল, রিয়ম তাড়াতাড়ি খেয়ে-বই নিয়ে আসো।তখন থেকেই মার কাছে রিয়মের শুরু হলো ঘ্যানর ঘ্যানর! বাবার কাছে পড়তে বসবেন না রিয়ম। বাবার কাছে সে কোন কথা বলতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই রিয়ম বাবাকে ভয় ভয় চোখে দেখে আসছে। যত আব্দার মার কাছে। মা রিয়মকে ভাত খাইয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাবার কাছে পড়তে বসালেন। বাবা একটির পর একটি পড়া পড়িয়েই চলছেন, কারণ- আজ তার স্কুল বন্ধ।
           
এদিকে রিয়মের বিরক্তির শেষ নাই। বারবার কোনো না কোনো অজুহাতে মার কাছে গিয়ে বাবার বিরুদ্ধে নালিশ করে আসছে। পড়ায় মন না বসায় বারবার ভুল করছে, সহজ কিছু পড়া- এতে বাবা আরো ক্ষেপে গিয়ে ছেলেকে খুব বকাবকি করতে থাকে। কিন্তু রিয়ম কি করবে? তার তো পড়ায় মন নাই! সে আগে থেকেই অনেক খেলার প্রোগ্রাম করে রেখেছে-আজ পড়া থেকে ছুটি ভেবে। বন্ধুরা বারবার বাড়ির গেটের কাছে এসে ফিরে যাচ্ছে। বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি জানাচ্ছে। রিয়মের মন পড়ার ঘর থেকে চলে গেছে খেলার মাঠে। এদিকে বাবার বকাবকির মাত্রা বেড়েই চলছে রিয়মের উপর।
            
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে স্কুল আজ বন্ধ হওয়ায়- বাবা ভাবছেন ছেলেকে আজ নিজের মতো করে পড়াবেন। কিন্তু ছেলে এদিকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ছুটি ভেবে- বন্ধুদের সাথে অনেক নতুন খেলার প্রোগ্রাম করে রেখেছে। বাবা তার কড়া শাসনে ছেলের স্কুল ছুটিতে - স্বাধীনভাবে খেলার অধিকারকে দমিয়ে রাখলেন। ছেলেকে যখন বাধ্য করলেন পড়তে-তখন ছেলে গালভর্তি চোখের জলে কান্না শুরু করে বলে ওঠে,'আমি চাইনা এরকম স্বাধীনতা দিবস! এ কেমন স্বাধীনতা দিবস! আমি খেলতে পারবনা বন্ধুদের সাথে স্বাধীনভাবে, পারবোনা মাঠে গিয়ে গঙ্গাফড়িং ধরতে। অন্য দিন তো খেলতেই পারিনা,সারাদিন স্কুল-পড়া-স্কুল আর পড়া।
            
দাদা বলেছিল আজকে আমরা সবাই স্বাধীন হয়ে থাকবো। কিন্তু কই? বাবা তো দেখছি উল্টো! স্বাধীনতার নামে ছুটি পেয়ে পড়াতে বসেছে, আমার স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে।'
মার আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে  রিয়ম বলতে লাগলো,'ভালো লাগে না বাবাকে! শুধু সারাদিন বলে পড়-পড়। কবে যে পড়াশোনার অত্যধিক চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনভাবে মনের সুখে খেলে বেড়াবো। মাঠে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ঘুড়ি ওড়াবো, গুলি ডান্ডা খেলব বন্ধুদের সাথে-চুপি চুপি রতন দাদুর বাড়ি থেকে আম পেড়ে খাব বন্ধুদের সাথে, মাঠের এককোণে বসে। সব যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বিকেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে- রামধনুর রঙের বাহারে মেঘেদের আবির খেলা দেখব। সবটাই যেন আমাদের শৈশব থেকে ছিনিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে এখন টিভির ভেতরে।'

গল্পকার সুমিত রায় 
সুভাষনগর, ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি 






















0 Comments