আনোয়ার কা আজব কিসসা : বাউন্ডুলে রোমান্টিকের আত্মানুসন্ধান
বুদ্ধবাবুর হৃদয়ে সম্ভবত দুর্মর কিছু বাসনা আছে, সেগুলো বারংবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও অবুঝ শিশুর মতোই হৃদয়ের একূল-ওকূল, দুকূল জুড়ে বানভাসি হয়,সিনেমায়। সিনেমায় তাঁর স্বপ্নের গায়ে লুটোপুটি খায় চাঁদের আদর,বন্দী কিছু কবুতর অকারণ ডানা ঝাপটায় এটা জেনেও যে, কলকাতা-কেন্দ্রিক এই নগর সভ্যতা আর পুরুলিয়ার ওই বিস্তীর্ণ প্রান্তর আসলে কোনোদিনই মিলবে না।সে যতই স্পেনীয় সিনেমাটোগ্রাফারের (ক্যামেরায় Diego Romero) হাতে সবুজ ও শূন্যতা মায়াময় হয়ে উঠুক না কেন!দর্শক দ্বিধাগ্রস্ত হবেন এই মিলনে,কারণ আদপেই তাদের বুকে কোনো লালন বাস করে না!কিন্তু ওই যে, বুদ্ধবাবু নাছোড়। বুদ্ধদেব বাবুর ছবি দেখলে মনে হয়,গ্রিক পরিচালক থিও অ্যাঞ্জেলোপউলস ধর্মতলায় হঠাৎ এসে পড়েছেন ও তুমুল ট্রাফিকে নাজেহাল। অথবা,তারকোভস্কি পৌষ মেলার জনসমুদ্রে বেমালুম পথ হারিয়ে ফেলেছেন।বলতে দ্বিধা নেই,এই ছবিটায় বুদ্ধবাবুর রোমান্সের পেয়ালা যেন উপচে পড়ছে... তিনি যেন পর্দায় গান গাইছেন,"কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...মনে মনে"!আর তাই অজস্র সোনালি মুহূর্তের অপচয়,অসংখ্য উচ্চকিত অভিনয়, অকারণ দীর্ঘ প্রলাপের ভিড় ঠেলে এই ছবিটা মনে কোথায় একটা দাগ রেখে যায়...হারানো স্বপ্নের দাগ।বৃদ্ধ পক্ষীরাজের শেষ উড়ানের বার্তা সেখানে ঘোষিত হয় জীর্ণ গ্রামাফোনে।আর গল্পের মহম্মদ আনোয়ার মুখোমুখি হয় তার শৈশবের।
প্রথমে গল্পে আসা যাক্...ছবির শুরুতেই পরপর দুটো শট্ ধরিয়ে দেয়,ছবির মেজাজ কেমন হতে চলেছে।কলকাতার কোনো এক গলিতে এক ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কাজ করে মহম্মদ আনোয়ার, পাগলাটে-বাউন্ডুলে-বোকা কিন্তু সৎ একজন মানুষ।সে গোয়েন্দাগিরির সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না,প্রকাশ্যে এসে পড়ে -যদিও এই ধরণটি নিছকই পরিচালকের খ্যাপামি।বাস্তবে এরকম হয় না।এই আনোয়ারের একমাত্র বন্ধু একটা জানোয়ার,লাল্লু নামের একটা কুকুর। মানুষের সমাজে সে প্রায় প্রত্যাখ্যাত।যদিও তার বাসায় পাশের ঘরের মেয়ে নাফিসা (অমৃতা চট্টোপাধ্যায়)স্পষ্টতই আনোয়ারের প্রতি অনুরক্ত।কিন্তু আনোয়ার তা জানে না।আনোয়ার ভবঘুরে হলেও,বাসায় ফেরার,ভিটেয় ফেরার,শৈশবে ফেরার,প্রেমে ফেরার একটা তুলকালাম অসহায় পিছুটানে ভোগে।আনোয়ারের চারপাশের সমাজ আসলে তারই মনের প্রতিফলন,বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবিতে যেমন হয় আর কি!ফলে অনেক চরিত্রেরই আচরণ খামখেয়ালি, খ্যাপাটে, অসংযত অথবা, অদ্ভুত।সেখানে এক সময়ের জঠরে ভেদবমির মতো উঠে আসে আরেক সময়,এক সময়ের বালুচরে খুলে যায় অন্য সময়ের 'জানালা'!সময় নিয়ে খেলা একপ্রকার ছেলেমানুষী,কিন্তু এই গল্পের আনোয়ার ও যে আসলে তাই, বড্ড মন-কেমন-করা এক ছেলেমানুষ, ভালো-মানুষ।আনোয়ারের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে,যে কোনো কেস্ হাতে নিলেই সে প্রাইভেট ডিটেকটিভের কোড্ অফ কন্ডাক্ট বা,এথিকস্ শিকেয় তুলে,ভুলে গিয়ে,নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। তার এই অহেতুক ইমোশ্যনালি অ্যাটাচড্ হয়ে পড়ার বিদঘুটে স্বভাবের জন্যই সে স্বরচিত বেদনার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। একসময় হারানো একজনকে খুঁজতে গিয়ে (পঙ্কজ ত্রিপাঠী),সে শৈশব খুঁজে পায় আর মজে যায় নিজস্ব স্মৃতি-রসে। তার জীবন থেকে লুপ্ত প্রেমিকা আয়েশা হিন্দুয়ানির লোকায়ত প্রাচীর তুচ্ছ করে, শিমুলতলার ধু-ধু মাঠে ব্লাউজ নামিয়ে বুক মেলে দাঁড়ায় নিঃসঙ্কোচে ('মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' ছবিতেও সম্ভবত এরকমই একটি দৃশ্য ছিল) ।বেচে দিয়েও ছিনিয়ে নিয়ে আসে সে,তার প্রিয় পোষ্যকে।তাকে নিয়েই পাড়ি দেয় দিকশূন্যপুরে,যেখানে সে খুঁজে পায় হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া-খনিজ।
কিন্তু এই ছবিতে প্রচুর অসঙ্গতি বড়ো চোখে লাগে!রাতের কলকাতায় মাতাল আনোয়ার যখন কুকুরটাকে নিয়ে বেরোয়,তখন কিছু অসুখী মানুষ রাস্তার পাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।পায়খানা না হওয়া,যৌন মিলনের সুযোগ না পাওয়া,অনিদ্রায় ভোগা তিন নর-নারীর উচ্চকিত কান্না কুৎসিত শোনায়।বুদ্ধবাবু ভুলে যান্,এমন দৃশ্য থিও-র ছবিতে কখনওই এতো চড়া ও বিশৃঙ্খল হতো না!আরেকটি দৃশ্যে আনোয়ার তার কেসের প্রোটাগনিস্টের ছবি চাইলে,ক্লায়েন্ট (অভিনয়ে সোহিনী পাল) গোয়েন্দাকে সাদাকালো একটি আদ্যিকালের ফটো ধরিয়ে দেয়।কেন? আরেক ক্লায়েন্টের বাড়ি পেমেন্ট আনতে গেলে নাম না বললেও তিনি মি.আনোয়ার বলে সম্বোধন করেন তাঁকে!কাঠামোগত দিক দিয়ে আর্ট ফিল্মের শরীরে গোয়েন্দা গল্পের আত্মা অন্তত বাংলা ছবিতে ভয়াবহ! ফলে রহস্য বা গোয়েন্দা গল্পের পক্ষে অনুকূল সিরিয়াসনেস্ এই সিনেমায় নেই, কারণ এই গল্পটা আসলেই এক মানুষের নিজেকে খোঁজার গল্প - অন্যদের খুঁজতে খুঁজতেই যে নিজেকে খুঁজে পাবে। আনোয়ারকে তার এক কেসের সন্দেহভাজন প্রায় আচমকাই নিজের বাসায় নিয়ে যায়।লোকটি সমকামী।তার গোটা ঘরে একটা আলমারি,দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ও নেই,অথচ ঝকঝকে সুন্দর পেইন্ট করা গোটা ঘরের সব দেওয়ালে।এই ব্যাপারগুলো কিন্তু যথেষ্ট অস্বস্তিকর ও অবাস্তব।আবহ সঙ্গীত ও সেই দৃশ্যে নেই যে, পরিবেশগত ত্রুটি পরিবেশনায় ভুলিয়ে দেবেন পরিচালক!বিশুদ্ধ হিন্দি বলা ভবানীপুরের এক বৃদ্ধার বাড়ির দেওয়ালে মা সারদার ছবিও অবাস্তব!তার চেয়েও বড়ো কথা,ওই বয়সে তিনি বাড়িতে একা থাকলে তাঁর ঘর-দোর অত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার কথাই নয়। ছবিতে সংলাপ বলার ধরণে প্রায় প্রতিটি চরিত্র অতিনাটকীয়, উচ্চকিত।তার কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষা ও বাচনরীতি ব্যবহার করা হয়েছে উদ্ভটভাবে।সবাই শুদ্ধ হিন্দিতে,নাটকীয় বাচনে কথা বলে(যেমন আনোয়ারের প্রতিবেশী নাফিসা),এতে করে দৃশ্যগুলির বাস্তবতা বারবার বিঘ্নিত হয়।আবার এমন কিছু সংলাপ ও আছে যেগুলো আসলে আনোয়ার বলছে না (যেমন সুধার বাড়িতে,তার বাবার সমকামিতা নিয়ে বলতে গিয়ে),সে কেবল ভাবছে।ফলে,স্থান-কালগত ঐক্যও নষ্ট হয়েছে কিছুটা।বিশেষত যখন কিষানগঞ্জ থেকে আসা,গরীব চাষা লোকটা হোটেলে এক প্লেট তরকারি আর হাফ তালা ভাত নিয়েও বলে,"আউর চাউল লুঙ্গা সাহাব !"
এবারে আসা যাক্,কিছু ভালোলাগার জায়গায়।ব্রিজের ওপর আনোয়ারের অতীত-প্রেমিকা আয়েশার (অভিনয়ে অপূর্ব,নীহারিকা সিংহ)অনুসরণে ক্যামেরার বিভঙ্গ মন কাড়ে।প্রথমে ক্যামেরা মেয়েটির পায়ে পায়ে সোজা চলে,তারপর আনোয়ারের চোখ অনুসরণ করে এগিয়ে আসে ভিন্ন কোণ্ থেকে।ছবিতে কয়েকটি দৃশ্যে অনেককিছু ঘটে একসাথে।এক্ষেত্রে ক্যামেরার মুভমেন্টও দারুণ।রেস্টুরেন্টের দরজায় দুই রণ-পা,এক ফকির,এক রূপান্তরকামী পরপর আবির্ভূত হয়।খুুুবই চিত্তাকর্ষক দৃশ্য,এবং একেবারেই দর্শককে অমনোযোগী হতে দেয় না।মুসলমান পাড়ার গলিতে ছাগলে ছাগলে লড়াই ও মাথা ঠোকাঠুকির ঘটনাটাও তাই।আবার দাম্পত্য অনিশ্চয়তায় ভোগা অনন্যার(ছবিতে অমলের স্ত্রী) চরিত্রটির ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে ঘটে যায় প্রথমে একটি আত্মহত্যা,তারপরই পার্কের ভিতর থেকে রাস্তার দিকে একটা ফুটবল সজোরে ফেন্সিংয়ে এসে লাগে।পরপর কতগুলি মানুষ চলে যায়।এরই মধ্যে চরিত্রটির মোবাইলে ফোন্ আসে।অর্থাৎ সারাক্ষণই কিছু না কিছু ঘটছে এবং তা এনগেজ করে রাখছে দর্শককে।অনেকগুলি দৃশ্যেই এই ঘটনা ঘটে।আবার কম্পোজিশনের চমকও আছে।শিমুলতলার শূন্য,ধূসর ল্যান্ডস্কেপে একটা লম্বা দৃশ্য অনেকক্ষণ ধরে চলে। একটা আকাঁ-বাকা মেঠো পথে এক ফেরিওয়ালা, একজন দইওয়ালা,এক বাউল ও দুই বাজনদার নিজ-নিজ গন্তব্যে যাত্রা করে,পেশার তাগিদে।কম্পোজিশনে দৃশ্যটি সার্থক,কিন্তু মানতেই হবে এখানে তা পারম্পর্যে কিছুটা অনাবশ্যক।অবশ্য পরিচালক নিজের মতন করে যুক্তি সাজিয়ে নেন, কারণ একটু পরেই ওই পথ ধরেই নেমে আসবে আনোয়ার এবং তার কুকুর।আর এখান থেকে শুরু হবে তার আত্মানুসন্ধানের শেষ খেলা।একপ্রকার খেলা-ভাঙার-খেলা ও বটে। উদাসী মেঠো পথে তার চোখের সামনে দিয়ে যারা সাইকেলে চলে যায়, আমরা জানতে পারি ওরাই আনোয়ারের বাবা-মা।এই স্মৃতির গভীরে ডুব দেবে বলেই আনোয়ার নিজের মোবাইল ফোনটা ফেলে দেয় পাখিওয়ালার কলসিতে।আমরা ভুলে যাই,আনোয়ার স্মৃতি থেকে মায়া-খনিজ উত্তোলন করছে। বয়েসী গাছের গায়ে ফসিল হয়ে যাওয়া সাইকেল,আমাদের ফিরিয়ে আনে বাস্তবে।ফের অতীতের কোলে মাথা রাখে আনোয়ার, যখন এক পোড়ো ভিটেয় এক কিশোর তার নিদ্রালস হাতে তুলে দেয় গ্রামাফোন রেকর্ড আর ক্যামেরা গ্রামাফোনের চোঙের মধ্যে দিয়ে ধরে শিশুকে ঘুম পাড়াতে সচেষ্ট আনোয়ারের মায়ের নৃত্যরতা রূপ, সুখস্মৃতি!আনোয়ার তার কুকুরটিকে নেশার ঘোরে একবার জিজ্ঞেস করেছিল,এই তুই হিন্দু না মুসলমান রে?তারপর নিজেই স্বগতোক্তি করেছিল,বলেছিল আমি যে কি তা আমি নিজেই জানি না।আনোয়ার এরকম অনেক কিছুই জানে না।অথবা বলা যায়, প্রত্যাখ্যান করে।তাই চাকুরীর দায়িত্ব নিয়ে এসেও,সে অনায়াসে সব ভুলে চলমান পাখি-বিক্রেতার কলসে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পেরেছিল তার মোবাইল... যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।এই বেপরোয়া বাউন্ডুলেমির জন্যই আমাদের আনোয়ারকে ভালো লাগে।আর ছবিটা আনোয়ারের চোখ দিয়ে সমাজের অনেক অসঙ্গতি,অবিচার, স্বেচ্ছাচার,মিথ্যাচার, উদাসীনতার প্রতি নির্লিপ্তির সাথে চেয়ে থাকতে চেয়েও,গল্পের নায়কের স্বভাব-মতোই জড়িয়ে পড়ে বারংবার। পরিচালকের সত্তরোর্ধ্ব বয়সের এই সিনে-রোমান্স,এই ছবিতে অন্তত তাঁর অসংখ্য দ্বিধায়, হঠকারিতায়, পাগলামি আর উদাসীনতায় কোথাও যেন তাঁর সাম্প্রতিককালের অন্যান্য ছবির থেকে একটু বেশি ভালো লেগে যায়।অমলের চরিত্রে ('ডাকঘর' ভুললে চলবে না)পঙ্কজ ত্রিপাঠির ছোট্ট উপস্থিতি বা,অভিনেত্রী ফারুখ জাফরের মেজাজি অভিনয় সেই দুঃসাহসী নৌকার পালে হাওয়া জুগিয়ে দেয়।হ্যাঁ দুঃসাহস বই কি!তা না হলে যখন সাত বছর সময় লাগে সিনেমাটা রিলিজ্ করতে আর আমাদের পর্যন্ত সাত বছর বয়স বেড়ে যায়,দুনিয়ার ইতিহাস-ভুগোলই বদলে যায়,তখনও পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এমন নাছোড় জেদে,তাঁর 'স্বপ্নের দিন' আঁকড়ে থাকেন কী করে?ছবিটা শেষ হবার পরেও অনেকক্ষণ মনে থেকে যায়, বদ্ধ ঘরে মদের ঘোরে, একা আনোয়ার স্ট্রিপটিজের খেলাচ্ছলে ছুঁড়ে দেয় তার পোশাক আর ঘনবসতিপূর্ণ কলকাত্তা ছেড়ে সেই পোশাক সোজা উড়ে গিয়ে পড়ে কোন অচেনা ধু-ধু প্রান্তরে,কোনো একলা কিশোরের অপেক্ষায়।এইখানেই বুদ্ধবাবুর ছবির মহিমা,তিনি পর্দায় কিছুক্ষণের জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়ের সীমানাটাকে বড়ো করে দিতে পারেন।
0 Comments