লক্ষ্মণ দাস ঠাকুরার প্রবন্ধ



জাতীয় শিক্ষানীতির চালচিত্র ও শিক্ষার্থীরা

বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এসেছে বা আনা হচ্ছে তাকি ধারাবাহিকতা ঐতিহ্যের পথ ধরে হচ্ছে নাকি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে-সে প্রশ্ন আজ বড় করে দেখা দিচ্ছে। এই সময় ও চাহিদাকে যেন অন্য খাতে প্রবাহিত করানোর একটা দুর্দমনীয় প্রয়াসও চলছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ও বাজেট পর্যালোচনা করলে তার আভাস পাওয়া যায়। ২০১৩-১৪ সালে শিক্ষাখাতে ব্যয় ছিল ৪.৭৭% যা জিডিপির ০.৭১% সেটাই ২০১৭-১৮ সালে ৩.৪০% যা জিডিপির ০.৪৪%, ২০১৯-২০ সালে ৩.৪০% যা জিডিপির ০.৪৫% (বাজেটে প্রাথমিক বরাদ্দ)। ২০১৮-১৯ মানব সম্পদ দপ্তর -'হায়ার এডুকেশন ফান্ডিং এজেন্সি' (এইচইএফএ) বিলে  কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তার আর্থিক দায়-দায়িত্ব পুরোটাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন। এই প্রকল্পে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারীভাবে ১০ বছর মেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা করে দেবে, সুদটুকু সরকার প্রদেয় বাকিটা প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে অর্থাৎ পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের উপরেই বর্তাবে। 

বিদ্যালয় স্তরে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সর্বশিক্ষা অভিযান অর্থাভাবে কতখানি নিম্নগামী। ইউএন রিপোর্ট বলছে প্রতিবছর ২.১ মিলিয়ন ৫ বছরের নিচের অপুষ্টিতে মারা যায় অথচ শিশু কেন্দ্র থেকে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত মিড ডে মিলে বরাদ্দ কমছে। ৬০০০ মডেল স্কুল আজও অধরা। ২০১৫-১৬ সালের মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর বরাদ্দ ৫০ হাজার কোটি চাইলেও এ পর্যন্ত মোট ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়নি। গত তিন বছরে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ ১১,১৫৬ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে পঁয়ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র চালু ছিল তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে ১ লক্ষ ৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় মাত্র একজন শিক্ষক আছেন। মহারাষ্ট্র ১৩৯০৫ টি বিদ্যালয় কুড়ি জনের কম শিক্ষার্থী। ছাত্রাল্পতায় উড়িষ্যা, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গের অনেক সরকারি ও সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত স্কুল বিপন্ন। অথচ রাজস্থান সরকার ২২৫ টি বিদ্যালয়কে বেসরকারিকরণের উৎসাহ যোগাচ্ছে। পিপিপি মডেল চালু করছে। মধ্যপ্রদেশ সরকার ১৫০০০ টি বিদ্যালয়কে রুগ্ন দেখিয়ে দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছে। সারাদেশে ১০০ জন শিশুর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে দেশের ৯.৫৭% আর আমাদের রাজ্যে ৫.৪১%। সারাদেশে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের গড় ৫.৪১% আর আমাদের রাজ্যে ৩.০৭ %। এরকম এক শিক্ষার চালচিত্র ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'হায়ার এডুকেশন  ফান্ডিং এজেন্সি '- মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তর কানারা ব্যাঙ্কের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষাকে বাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে চাইছে। যেখানে আমাদের দেশের ২০১১ সালের জনগণনায় এ দেখা যাচ্ছে ১২১ কোটি জনগণের মধ্যে ৩৪কোটি মানুষ নিরক্ষর। আজ ভারতবর্ষের জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। এপ্রিল -২০ হতে আবার জনগণনা শুরু  হলে তখন আমাদের কাছে ছবিটা আরো পরিষ্কার হয়ে যেত। ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইনে বলা হয়েছে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী সব শিশুদের বিদ্যালয়ে আনতে হবে কিন্তু সে কাজ আমরা আজ পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারিনি। অথচ ২০২০ সালের জাতীয়  শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে। যেটি ৪৮৪ পাতার রিপোর্ট। যত আইসিডিএস এবং প্রাইমারির ওয়ান ও টু-কে ৩ বছরের প্রাক-প্রাথমিক (প্রি-প্রাইমারি) এবং আরো দু বছর যোগ করে মোট পাঁচ বছর হবে ভিত্তি স্তর (Foundational stage)। তারপর , ৪, ৫ হবে অর্থাৎ তিন বছর হবে প্রস্তুতি স্তর (Preparatory stage), সিক্স,সেভেন,এইট আরো তিন বছর হবে মধ্যস্তর ( Middle stage), নাইন থেকে টুয়েলভ -চার বছর হবে মাধ্যমিক স্তর (সেকেন্ডারি স্টেজ) তাহলে দাঁড়ালো ৫-৩-৩-৪, বোর্ডের পরীক্ষা থাকবে না। শেষ চার বছরে চারটি সেমিস্টার পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার সময়  শিক্ষার্থীরাই ঠিক করবে। ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি ঠিক করে দেবে সেমিস্টার পরীক্ষা কিভাবে হয় এবং কোন কোন বিষয়ের উপর হবে, তবে সেই পরীক্ষা অবশ্যই কেন্দ্রীয় ভাবে পরিচালিত হবে। গত দু'বছর যাবৎ মেডিকেল ভর্তির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় জয়েন্ট পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। কাগজে বেরিয়েছে দু'বছরে এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে প্রচুর কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে এবং ১৪ বিলিয়ন কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। তাহলে একথা অনুমান করাই  যেতে পারে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি মারফত পরীক্ষা পরিচালিত হলে কত ধরনের কোচিং সেন্টার খোলা হবে এবং সাধারণ বাড়ির ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে দেশে ত্রি ভাষা সূত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের তিনটি ভাষা শিখতে অনেকখানি সময় চলে যাচ্ছে তার ফলে বিষয় শিক্ষার সাধারণ শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।

বিশ্ব বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হচ্ছে, যথা- গবেষণামূলক, শিক্ষামূলক ও স্বয়ংশাসিত  বিশ্ববিদ্যালয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর সমস্ত কলেজগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে এবং নিজে নিজেই ডিগ্রি প্রদান করতে পারবে এবং একেকটি ডিগ্রী বিক্রির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষা খাতে খরচ কমানোর জন্য massive open online course চালু করার জোর প্রয়াস চলছে। তার ফলে কম্পিউটারের সাহায্যে ঘরে বসেই ব্যাপকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। ফল স্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এত বড় বড় বাড়ি ও শিক্ষকসহ পরিচালনার খরচ বহন করতে হবে না। সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থা কেন্দ্রীকরণ হলে গণতান্ত্রিকতার মাধ্যমে পরিচালনার পরিসমাপ্তি ঘটবে। কেন্দ্রীয় শিক্ষা আয়োগ হতে যার মাথায় থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জনসেবামূলক আগামী দিনে আর থাকবে কিনা সেই প্রশ্ন আজ বড় করে দেখা দিয়েছে। 

ইউনেস্কো বলছে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক মিলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ কোটি ৩৫ লক্ষ। কিন্তু  বিদ্যালয়ের DISE এর হিসাব বলছে (১৩ +৯) কোটি =২২ কোটি। ভারতবর্ষের মোট শিক্ষকের ১৮.০৩ % প্রাথমিক শিক্ষক ও ২০% হল মাধ্যমিক স্তরে। এই বিরাট অংশকে বাজারী ব্যবস্থার মধ্যে ধরতে চাইছে। জাতীয় শিক্ষার নামে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়করণ করে নানা ভাষাভাষীর বৈচিত্র্যপূর্ণ এই দেশে এক ছাঁচে ফেলতে চাইছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয়- "...জাতীয় ভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তবে প্রশ্ন উঠিবে শিক্ষা সম্বন্ধে জাতীয় বলতে কি বুঝায়।'জাতীয়' শব্দটার কনো সীমা নির্দেশ হয় নাই। হওয়াও শক্ত। কোনটা জাতীয় এবং কোনটা জাতীয় নহে শিক্ষা সুবিধা ও সংস্কার অনুসারে ভিন্ন লোকে তাহা ভিন্ন রকম স্থির করেন। "

    প্রবন্ধকার লক্ষ্মণ দাস ঠাকুরা
সুকান্তপল্লী, কালনাগেট, পূর্ব বর্ধমান


















0 Comments