
কিছু কথা কিছু না'কথা
‘মাস্টারি, দাদা আজব চাকরি..’ এই গানটা অনেকের মুখে মুখে কয়েকবছর আগেও ঘুরে বেরিয়েছে।অনেকেই এই গানটা শুনে কষ্ট পেয়েছেন, কেউ বা নিছক মজা পেয়েছেন। কিন্তু এই মাস্টারির সমান্তরালে আরেকটি জীবিকা খুব জনপ্রিয় অথবা বলা যায় অনেকের কাছে একটা মজবুরি, এবং সেটি হল প্রাইভেট টিউসন।এই প্রাইভেট টিউসন একটা ধন্যবাদহীন জীবিকা, অর্থাৎ থ্যাঙ্কলেশ জব।যদি এখন মনে হচ্ছে সবটাই নির্ভর করছে টাকার উপর। যদি আপনি লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউসন পড়ান তাহলে আর যাই হোক কোন দিন মর্যাদা পাবেন না।সেই জোকসের মত ইদুর, বিড়াল, ব্যাঙে খাওয়া পায়েস বা মিয়ানো বিস্কুট দেওয়া তেঁতো চা আর মাসের শেষে ছুঁড়ে দেওয়া টাকা তুলে বাড়ি আসা, মাঝখানে অবশ্য ছাত্র বা ছাত্রীর মায়ের একটা আড়চোখ এড়ানোর কৌশল শিখতে হয়, শিখতে হয় কিভাবে মুখ বন্ধ করে অপমান সহ্য করা যায়।
এই অধমকে অবশ্য চাকরি পাবার আগে এই জীবিকাকেই অবলম্বন করে বেশ কয়েকটা বছর বাঁচতে হয়েছিল। তবে একটাই সুবিধা ছিল, বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয় নি, নিজের বাড়িতে বসে থেকেই ছাত্র বা ছাত্রীর একটা প্রবাহ পেয়েছিলাম। সেই সমস্ত ছাত্র বা ছাত্রীদের নিয়েই কয়েকটি অভিজ্ঞতা এখানে ভাগ করে নিলাম।
ঘটনা ১
বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা।এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি মেয়ে আমার কাছে টিউসনে ভর্তি হয়।নাম বলছি না, সারনেম ছিল মুখার্জী।মাধ্যমিকের পর এলেভেনে ক্লাসে ভর্তি হয়।একমাস পড়ার পর বেশ কয়েকদিন কামাই করে। আমি বাড়িতে ফোন করে কারণ জিজ্ঞেস করবার চেষ্টা করেও জানতে পারি না।এদিকে রথের মেলা আরম্ভ হয়।আমাদের বাড়ির থেকে চারশ মিটারের মধ্যে একটি রথের ভালো মেলা বসে। আমি আর মিসেস একসন্ধে বেলা মেলা দেখতে বেরিয়ে একটি আননোন নম্বর থেকে ফোন পাই। রিসিভ করতেই শুনি ওদিক থেকে এক ভদ্রমহিলা খুব রেগে রেগে বলছেন,‘এটা কি স্যারের নম্বর, আমি মুখার্জীর মা বলছি। আপনার বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন, খুব দরকার।’
উনি খুব দরকার বললেও আমি খুব একটা পাত্তা দিইনি। বেশ আস্তে আস্তেই বাড়ি ফিরতে আরম্ভ করি। বাড়ি ফেরার রাস্তাতে দেখি উনিও ওনার হাসবেণ্ড দাঁড়িয়ে আছেন।দুজনকেই চিনি, কারণ ওনারা প্রথমদিন কথা বলবার সময় এসেছিলেন। আমি আসতেই ভদ্রমহিলা খুব উত্তেজিত ভাবেই বলে ওঠেন, ‘আপনার কি পড়ানোর কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, যখন খুশি ডেকে নিচ্ছেন।’
স্বাভাবিক ভাবেই আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে উত্তর দি,‘মুখার্জী তো আজ দু সপ্তাহ হল পড়তেই আসেনি।’ –কি মিথ্যা কথা বলছেন, এই তো বিকালের দিকে আপনি ফোন করে আগে পড়ানোর কথা বললেন।
আমি এক্কেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি বললাম! কখন?’
–এই তো দুপুর আড়াইটের সময় ফোন করলেন।
শেষের কথাগুলো বলবার সঙ্গে সঙ্গে উনি আমাকে ফোনটা বের করে দেখালেন। আমিও দেখলাম রিসিভ কলে লেখা আছে, ‘ইংলিশ স্যার।’
এবার আমি একটু কঠিন হয়ে বলে উঠলাম,‘নাম্বারটা বলুন।’
ভদ্রমহিলা নাম্বারটা বলতেই আরো কঠিন ভাবে জবাব দিলাম, ‘এইটা আমার নম্বর নয়।’
স্বভাবতই ভদ্রমহিলা রেগে উঠলেন। এমন ভাবে কথা বলতে আরম্ভ করলেন, যেন আমি মিথ্যা কথা বলছি। আমি সেই সময় তিনটে ফোন নম্বর ব্যবহার করলেও সে বিশেষ নাম্বারটি কোন মতেই আমার ছিল না। কিন্তু ভদ্রমহিলা কিছুতেই বুঝতে চাইছিলেন না। আমার কথা শুনে শেষকালে ভদ্রলোক কথা বলা আরম্ভ করলেন। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ওনাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলে ঐ নাম্বারে স্পিকার অন করে ফোন করতে বললাম। উনি ফোন করতেই ও’প্রান্ত থেকে উত্তর এল,‘বলুন, আমি স্যার বলছি।’
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ পড়া ছিল?’
-হ্যাঁ এই তো ছাড়লাম।ওপ্রান্ত থেকে উত্তর এল।
এবার ভদ্রমহিলা ফোনটা নিয়ে ফোন করে যেই বললেন, ‘আমি এখন ইংলিশ স্যারের বাড়িতেই এসেছি।’ সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে গেল।
উনি ব্যপারটা বুঝে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন। আসলে সেই ছাত্রী মুখার্জী, ইংলিশ স্যার নাম দিয়ে ওনার ভদ্রলোকের নামটি সেভ করে রেখেছিল।স্বাভাবিক ভাবেই ফোন করলেই ভেসে উঠত, ‘ইংলিশ স্যার কলিং।’ আর মেয়েটি আমার কাছে পড়তে না এসে তার ইংলিশ স্যারের কাছে চলে যেত। এর পরবর্তী ঘটনা আর বলছি না। তবে যেদিন পড়তে এসেছিল মা বাবা মেয়ে তিনজনের এক্কেবারে ..... তবে মেয়েটি কিন্তু এর পরেও আমার কাছে আরো দুবছর পড়েছে, এবং আরো অদ্ভুত ঘটনা হল, আমার বিষয়ে এইটি ফাইভ পারসেন্টের উপর নম্বর পেয়েছিল।
ঘটনা ২
বি.এড পড়বার সময় স্যাররা প্রায়ই বলতেন,‘ছা্ত্র ছাত্রীদের সাথে যতটা সম্ভব বন্ধুর মত ব্যবহার করতে হবে।’ আমি সেটা সব জায়গাতেই চেষ্টা করতাম। টিউসনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বেশি করে হত। এই প্রসঙ্গে একটি সমস্যাতে পড়ে যাই। আমার নামেই আমাদের টাউনশিপে আরেকজন পড়াতেন। তবে ওনার বিষয় অন্য ছিল। কিন্তু উনি ছাত্রদের সাথে সিগারেট শেয়ার করতেন। অনেকেই দুজনাকে গুলিয়ে ফেলত। এই বিষয়ে একটি ঘটনা শেয়ার করব।ছাত্রটির বাড়ি ছিল বাঁকুড়া জেলায়। কি নাম ছিল এখন ভুলে গেছি।ধরে নিলাম ছিল কমল। ওখানকার একটি মিশন থেকে মাধ্যমিক পাস করে আমাদের শহরে এসে ভর্তি হয়েছিল। ছেলেটি প্রথম থেকে খুব ভালো পড়াশোনা করত, সেই সঙ্গে মৌখিক ব্যবহার খুব ভালো ছিল। শহরে তখন টিউসনে আমার খুব নাম। সারাদিন ব্যাচের পর ব্যাচ পড়িয়ে যাচ্ছি। ট্যাস্কের ফাইল পর্যন্ত তৈরী করতে হয়েছিল।একদিন সন্ধের দিকে এই রকম একটি ব্যাচ পড়াচ্ছি, এমন সময় সেই ছেলেটি আসে। দরজা খুলতেই আমাকে দেখে বলে ওঠে, ‘দাদা, একটা সমস্যাতে পড়ে গেছি, বাবা বাংলা স্যারের জন্যে পেমেন্ট দিয়েছিল, কিন্তু সাইকেল করে আসার সময় টাকাটা কোথায় পড়ে যায়। তুমি আমাকে একটু ধার দেবে, আমি স্যারকে আজ দেবো বলেছিলাম, স্যার খারাপ ভাববেন।’
আমি পড়াচ্ছিলাম। কোন কথা না ভেবে ছেলেটিকে বিশ্বাস করে টাকাটা দিয়ে দি।এরপর ছেলটি তার নিদিষ্ট দিনে পড়তে আসে। আমি পড়াই, আমাকে পেমেন্ট দেয় যেমন দেবার। কিন্তু সেই নেওয়া টাকাটার কোন খবর পাইনা। আমি টাকাটার কথা বললেই ছেলেটি এক গাল হেসে উত্তর দেয়, ‘দেবো দেবো, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।’ কয়েকদিন পর ঐ ব্যাচের আরেকটি ছেলে বলে, ‘দাদা, কমল কিন্তু খুব বাজে ছেলে হয়ে গেছে। তোমার এখান থেকে বেরিয়ে প্রতিদিন মাঠে বসে সিগারেট খায়।’ চমকে উঠলাম। ক্লাস টুয়েলভের স্টুডেন্ট সিগারের খায়! সোজা ওর বাবাকে একদিন ফোন করে সবকিছু জানাতেই ওর বাবা আমার ওপর একটু মনোক্ষুন্ন হলেন। বিশেষ করে সেই টাকা নেওয়ার ঘটনাটাতে তো আরো রেগে গেছিলেন। পরে শুনেছিলাম আমার কাছ থেকে ওরকম মিথ্যা কথা বলে টাকা নিয়ে বন্ধুদের সাথে একটা সিগারেটের পার্টি হয়। আর আমি বোকার মত টাকা পড়ে যাবার গল্পতে বিশ্বাস করে অনেক মাস চুপচাপ থাকি ।
ঘটনা ৩
টিউসনের লাইনে পেশাগত শত্রুতা একটা চরম নিন্দনীয় ঘটনা। এক শিক্ষক প্রায়ই অন্য শিক্ষকের নামে ব্যাচের মধ্যে বদনাম করে, খারাপ কথা বলে। স্বীকার করতে দোষ নেই এক সময় আমিও এই পথে চালিত হয়ে ছিলাম। পরে বুঝলাম এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তবে যে ঘটনাটার বর্ণনা করব এটি এই জাতীয় সমস্ত ঘটনার উপরে। আমার মিসেস ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।এখানে এসে টুকটাক টিউসনও আরম্ভ করতে হঠাৎ করে সংখ্যাটা বেশিও হয়ে যায়।এই অবস্থা অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয় আমার পাড়াতে একজন টিউটর আছেন। বহুদিন ধরে পড়াচ্ছেন। আমি যখন ছাত্র তখনই ঐ দাদা টিউসনটাকেই জীবিকা করে নেয়। কোন রকম চাকরির চেষ্টা করেননি। পরে বুঝলাম চাকরি পেতে গেলে একটা স্কুল মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়গত শিক্ষার প্রয়োজন, এবং এটা না থাকা মানে আপনি শুধু টিউটর হবেন, চাকরি পাবেন না। পাড়ার এই টিউটরদাদা খুব বেশি বিষয় পড়াতো না। বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, ইতিহাস, পৌর বিজ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,শিক্ষাবিজ্ঞান এই সব বিষয় ক্লাস নাইন থেকে এক্কেবারে এম.এ ক্লাস পর্যন্ত। অবশ্য ওনার পড়ানোর পদ্ধতিটা ছিল খুব সুন্দর। ছাত্র বা ছাত্রী কোচিং সেন্টারের কাছের একটা মাঠে কিছু সময় আড্ডা মারল, আর দাদা চায়ের দোকান থেকে আড্ডা মেরে ঢুকলেন, সবাইকে একটা করে বই খুলে দিয়ে কিছু সময় সেন্টারে বসলেন। ছা্ত্র ছাত্রীদেরকে ওনার ঘুরতে যাওয়ার গল্প শোনালেন, একটু শিক্ষিকা বউয়ের গল্প শোনালেন, (ভদ্রমহিলাও ওনার ছাত্রী ছিলেন, পরে স্কুল শিক্ষিকার চাকরি পান।) তারপর উনি নিজে আড্ডা মারতে বেরিয়ে গেলেন। কিছু সময় পরে এসে বললেন, ‘ যা বাড়ি চলে যা।’ অবশ্য উনি প্রতি বছর খুব ঘটা করে সরস্বতী পূজা ও টিচার্স ডে পালন করেন। ডিজে জ্বালিয়ে নাচ হয়, দেদার ফূর্তি হয়।এসব কথাগুলো মিসেসের এক ছাত্রের মুখে শোনা। ছেলেটি এসব দেখে ওনার কাছ থেকে ছেড়ে মিসেসের কাছে এসে ভর্তি হয়।ওকে দেখে আরো কিছু ছাত্র ছাত্রীও ভর্তি হয়, তাতেই ভদ্রলোকের রাগ হয়ে যায়। একসন্ধে বেলা উনি আমার বাড়ি এসে রীতিমত হুমকি দিয়ে বলেন, ‘এখানে বসে আমি যে সব সাবজেক্ট পড়াই সেগুলো পড়ানো যাবে না। তোমার সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে।’
সেদিন কোন একটা কারণে জিজ্ঞেস করতে পারিনি, ‘আচ্ছা, সম্পর্ক ভালো থাকলে আমি ও কি মঙ্গলগ্রহে জমি কিনতে পারবো?’ তবে সেই ভালো সম্পর্কটা আমি নিজেই নষ্ট করে দি।
0 Comments