দ্রৌপদী
গতকাল থেকে স্টার টকিজে দ্রৌপদী ছবিটা আবার শুরু হয়েছে। গত বছর ছবিটা যখন মুক্তি পেয়েছিল, তখন কলকাতায় ছিল না সুমন। কিন্তু সবার মুখে শুনেছে ছবিটা নাকি দারুণ ব্যাবসা করেছে। নাম ভূমিকায় সোহিনীর অনবদ্য অভিনয় আর সেই সঙ্গে দুর্দান্ত সংলাপ, ছবিটার সাফল্যের মূল কারণ বলেই সবাই মনে করে।
আজ শনিবার। অফিস থেকে বেরিয়ে মনে মনে স্থির করে ফেলে সুমন, ইভিনিং শোয়ে ছবিটা দেখতেই হবে।
হলে পৌঁছে সুমন একেবারে থ। একি এত ভীড়! কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টার খুলতে এখনও আধ ঘন্টা। সুমন দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মনে হলো, টিকিটের এই লাইনে যেন শহরের সব রকমের পেশার মানুষ দাঁড়িয়ে। কলেজ পড়ুয়া থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,কেরানি, সেক্রেটারি,গৃহবধূ এমনকি কিছু বেকারও। টিকিটের এত চাহিদা জানলে দুদিন আগে এ্যাডভান্স করে রাখত সুমন। একটা পুরনো ছবির প্রতি মানুষের যে এইরকম আগ্রহ থাকতে পারে সে ভাবেইনি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তিন চারবার ছবির পোস্টারে তার চোখ চলে গেল। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মূল পোস্টারটা যিনি এঁকেছেন, সুমন তাঁর শিল্পীসত্তাকে মনে মনে কুর্নিশ জানাল। ঠিক তার পাশেই দাবার নিখুঁত অলংকরণ। চিত্রকরের আধুনিক চিন্তাধারা আর হাতের কুশলতায়,সব চরিত্রই যেন মহাভারতের পাতা থেকে উঠে এসেছে। সুমনের মত, লাইনে দাঁড়ানো সকলেরই ধৈর্যের বাঁধ ক্রমশ ভাঙতে শুরু করেছে। কাউন্টার খুলতে এখনও মিনিট দশেক বাকি। ঘড়ির কাঁটা যেন আর এগোতেই চাইছে না। সুমন পেছন ফিরে একবার দেখল, লাইন ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। লাইন যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে, কেউ জানে না।
শহরের এই ব্যাস্ত এলাকায় এত সুন্দর একটা প্রেক্ষাগৃহ, কিন্তু সেই সৌন্দর্যে থাবা বসিয়েছে ওই ডানদিকের মোড়ে বস্তিটা। এখান থেকে পরিষ্কার নজরে আসে সবকিছু। বস্তিবাসীদের চালচলন, কর্মব্যস্ততা কিংবা দিনযাপনের ছবি। অনেক পুরনো বস্তি। তাই পুরসভা সাহস করে ভাঙতে পারছে না। একদিকে পুনর্বাসন আর একদিকে ভোটব্যাঙ্ক। এই জোড়া ফলার আক্রমণের ভয়ে পুরসভা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। বস্তির অশিক্ষিত মানুষের অস্তিত্ব এখন আর শুধু বস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই স্টার টকিজের আশপাশের বেশ কিছু দোকানের মালিকানা এখন তাদের দখলে। ফলে,সেইসব দোকানে অভিজাত খদ্দেরের ভীড় কম। হলটা বেশ সুসজ্জিত এবং শীততাপনিয়ন্ত্রিতও, কিন্তু পরিবেশের ধুয়ো তুলে, খুব ভাল ছবি না এলে সম্ভ্রান্ত দর্শক সমাগম হয় না। বন্ধ কাউন্টারের ওপাশ থেকে কিছু মানুষের আলাপ আলোচনার শব্দ আসতেই বোঝা গেল কাউন্টার খোলার সময় হয়ে এসেছে। কানাঘুষোয় সুমন টের পেল,এ ছবি অনেকেরই আগে দেখা হয়ে গেছে। বিষয় পৌরাণিক হলেও, উপস্থাপনায় ছবিটা একটা বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। তা নাহলে কি দ্বিতীয়বারের রিলিজে টিকিটঘরে মানুষ উপচে পড়ে।
হঠাৎ একটা বিশৃঙ্খলা আঁচ করল সুমন। অস্বস্তিটা বস্তির দিক থেকেই দানা বাঁধছে বলে মনে হল তার। গালাগালি, চিৎকার,খিস্তি খেউড় কিছুই বাদ নেই। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সবার নজর সেই দিকে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে,দুজন আধবুড়ো ষন্ডামার্কা গোছের লোক একটা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে। কিছু একটা পাওনার দাবি তাদের। লোক দুটো অভদ্র আর ইতরের মত,ওদেরই মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের প্রতি অশালীন মন্তব্য ছুঁড়েই যাচ্ছে। দু দুটো পাশবিক শক্তির কাছে মেয়েটা হার মানতে নারাজ। ছুটে ঘরের ভেতর চলে যায়। আবার বেড়িয়ে আসে।হাতে ধারালো ছুরি। চোখে প্রতিহিংসার দাউ দাউ আগুন। অসম্ভব মনের জোর আর সাহসে ভর করে চেঁচিয়ে উঠল---
-- জুয়ার নেশায় সবকিছু বিকিয়ে জানোয়ার হয়ে গেছ তোমরা। খবরদার,আর একপাও এগোবে না কেউ। ফল ভাল হবে না। জুয়ায় যে হেরেছে,তার কাছ থেকেই কড়ায়গন্ডায় সবকিছু বুঝে নাও।
মেয়েটার এইরকম আকষ্মিক প্রতিবাদে পিছু হটতে বাধ্য হল তারা। যাবার আগে একটা অমানুষ,তার ঊরু চাপড়ে বলে গেল,দেখি আজ রাতে তোকে কে বাঁচায়!
এত দূর থেকে দৃশ্যটা খুব অবাক করল সুমনকে। মেয়েটার সাহসের কথা ভাবতে ভাবতে খেয়ালই নেই যে কখন্ কাউন্টার খুলে গেছে।
--- দাদা, এগিয়ে চলুন। পেছন থেকে কথাটা সুমনের উদ্দেশে উড়ে এল। সুমন খানিকটা এগিয়ে গেল। এখনও তার সামনে আনুমানিক জনাবিশেক লোক দাঁড়িয়ে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আবার সুমনের মাথায় চাড়া দিতেই তার মনে হল,আজ অবধি সেই জুয়াখেলা,পাশার চাতুরী আর মহাভারতের সব চরিত্রই ঠিক আছে। এমনকি যুধিষ্ঠিরের বাজী পর্যন্ত। শুধু পাল্টেছে দ্রৌপদীরা। এই ধৃতরাষ্ট্র শহরে আজ তারা বস্ত্রহরণ পালায় কৃষ্ণকে স্মরণ করে না। তারা নিজেরাই দুঃশাসনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রবল আত্মবিশ্বাস আর মনোবলে আস্থা রেখে, আত্মরক্ষার বস্ত্র নিজেদের শরীরে জড়িয়ে রাখে। পাশবিকতার কাছে তারা হারে না।
সুমনের সামনে আর মাত্র সাতজন। মানিব্যাগ থেকে সে একটা একশ টাকার নোট বের করল। হঠাৎই সুমনের সামনের লোকটার মুখের ওপর ঝুপ করে কাউন্টারের জানলা বন্ধ হয়ে গেল। টিকিট শেষ। এরই মাঝে কিছু অনলাইনে টিকিট কাটা মানুষ হলের ভেতর প্রবেশ করল। চোখের নিমেষে হলের ডিজিটাল বোর্ডে Houseful জ্বলে উঠল।
টিকিট না পেয়ে দু চারজন হতাশ হলেও,সুমন এতটুকু বিচলিত হলো না। টিকিট না পাওয়ার ক্লান্তি মুছে টিকিটের টাকাটা মানিব্যাগে গুছিয়ে রাখল। তারপর এক অনাবিল আত্মসুখে,হলের ভেতর মহাভারতের দ্রৌপদীকে শ্রীকৃষ্ণের ভরসায় রেখে, নিজের চোখে দেখা এ কালের অন্য আর এক দ্রৌপদীর কথা ভাবতে ভাবতে সুমন বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
এতক্ষণ পর স্টার টকিজের মূল রঙীন পোস্টারটা বড় ধূসর মনে হল তার।
গল্পকার সমাজ বসু
0 Comments