চয়ন কুমার রায়ের গল্প


জাল 

মতিলালের চা দোকানটা বাজারের ভিতরে এক কোনে হলেও সকাল সাতটা থেকে বেলা বারোটা অবধি খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকে ।
দুপুরের পর থেকে যত বেলা গড়াতে থাকে কর্মব্যস্ত দোকানটা তত‌ই ঝিমিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বিকেল হয়, সন্ধ্যা নামে।রাস্তা ধারের দোকানগুলো ছাড়া বাজারের ভিতরের অধিকাংশ দোকানের ঝাঁপ সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে চাটাই পেতে পাঁচ -সাত জনের কয়েকটা তাসের মজলিস বসে। সব‌ই যে নির্দোষ তাসের আড্ডা তা হলফ করে বলা যায় না।টাকা পয়সার খেলাও চলে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ওটাই ওদের বিনোদন।
মতিলালের দরমাঘেরা টালির চালের দোকানটাকে দিনের আলোয় যতটা নির্ভেজাল চা'এর দোকান বলে মনে হয়, রাতে তার ব্যবসায়িক চরিত্র ঠিক ততটাই বদলে যায়। মালিকানার‌ও হাত বদল হয়ে যায়। এলাকার স্বঘোষিত অভিভাবক দীনেশের কব্জায় চলে যায় দোকানটা।

দীনেশ চন্ডীতলার এক প্রভাবশালী নেতার ডানহাত। তার মুরুব্বিয়ানার খাতিরে বাজার কমিটিকে যে মাসোহারা গুনতে হয় সেটি নেহাত দুরছাই করার মতো নয়।মন্দ লোকে বলে, তোলা। দীনেশ‌ও তেমন অবিবেচক নয়। ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা বিপদে -আপদে কিছু গচ্ছিত রেখে তার কাছ থেকে প্রায়শঃই টাকা ধার নেয় ।অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গচ্ছিত সম্পত্তি আর উদ্ধার হয় না। এছাড়া ছোটখাটো বেআইনি কাজ সামলানোর দায়িত্ব‌ও দীনেশের। তার লম্বা হাত দিয়ে সব ধরণের প্রশাসনিক জটিল সমস্যা সমাধান এক লহমায় করে ফেলে । অবশ্য তার জন্য অভিযুক্তকে কিছু মালকড়ি খসাতে হয়।

আবছা আলোয় মতিলালের দোকানের পিছন দিকে ছায়া-ছায়া মানুষ -জনকে যাতায়াত করতে দেখা যায়। দোকানের মাঝে একটা পার্টিশন। পেছনে আর একটা দরজা আছে। চা'এর দোকানের আড়ালে ওখানে রাতের বেলায় অন্য একটা ব্যবসা চলে। বন্ধ দোকানটার সামনে বসে ভোলা খাসির ছাঁট দিয়ে তৈরি ঝাল ঝাল ঘুগনি বিক্রি করে। তাসের আড্ডায় মতিলালকে ও দেখা যায়। দীনেশ‌ ও কয়েকজন সাগরেদ পরিবৃত হয়ে একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় বসে সবকিছুর দিকে নজর রাখে।
একটা দামী বিদেশী ব্র্যান্ডের সিগারেট ধরিয়ে দীনেশ হাঁক দেয়, "মতি, আজ ঠান্ডাটা বড্ড বেড়েছে রে। পাঁচ কাপ ইস্পেশাল চা বানা দেখি। "
মতি ঝাঁপ তুলে দোকানে ঢুকে যায়।
কোন এক আড্ডা থেকে কেউ একজন বলে, "আমরা কি হাফ  কাপ করে পাবো না দাদা?আমরা চা খাবো না ?"
"তোরা শালা মাল খেয়ে গা গরম কর। তোদের কথা ভেবে এতো রিস্ক নিয়ে সাপ্লাই দিচ্ছি, বলে কিনা চা
খাবোনা দাদা! "
আর একজন একটা অ‌শ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করে বিকৃত সুরে রসিকতা করে বলে, "...চুল্লু খেয়ে যদি টেঁসে যাই! "সবাই খিক খিক করে হেসে ফেলে।
"তোর চৌদ্দপুরষের তেমন পুণ্যবল থাকলে বর্তে যাবি।দু'লাখ টাকা,  বুঝলি দু 'লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার! ওই টাকাটা পেলে তোর ব‌উ এর একটা হিল্লে হয়ে যাবে।টাকা থাকলে কত শালা ছোক ছোক করবে তোর ব‌উ এর পিছনে।"
আর একপ্রস্থ হাসির রোল ওঠে।
তাস খেলার একটা ঠেকে অনুচ্চ স্বরে গুঞ্জন ওঠে। সঞ্জয় উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
"আমি আজ আর খেলব না।"
সবাই গর্জে ওঠে, "খেলবি না মানে! মামদোবাজি? "
সঞ্জয় মাছ বিক্রি করে। "হেরে গেলে কাল মাল তুলতে পারবো না।"
"টাকা না থাকলে খেলতে বসিস কেন? কোমরের জোর নেই, সখ ষোল‌ আনা! কোন কথা শুনবো না। খেলা শেষ করে তবেই উঠতে পারবি। "
সবজি ব্যবসায়ী মদন মন্তব্য করে, "পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি রেখে ছিল। তুই ও তাই করনা।"
"খবরদার মদনা। মুখ ভেঙে দেব।"

মদনও উঠে দাঁড়ায়। একটা গন্ডগোল বাধার উপক্রম হচ্ছে দেখে দীনেশ হুঙ্কার ছাড়ে , "অ্যা‌ই, থাম তোরা। সঞ্জয় আয়। আমার কাছে টাকা আছে, নিয়ে যা। "সঞ্জয় কাছে এলে বলে, "জানিস নিশ্চয়, খালি হাতে আমি টাকা দিই না ।অসুবিধায় পড়েছিস তাই দিলাম। কাল কিন্তু সোনা দানা কিছুএকটা জমা দিয়ে যাবি। "

মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এমন অনেক সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে দীনেশের ঘরে। সেই সঙ্গে সঞ্চিত হয়েছে বহু মানুষের অভিসম্পাত‌ও।
"ব‌উ এর সোনার গয়না তেমন কিছু নেই দাদা।আমি তো কিছুই দিতে পারি নি। যা রোজগার তাতে সংসার চালাতেই হিমসিম খেয়ে যাই। আমি কথা দিচ্ছি, রোজ কিছু কিছু দিয়ে তোমার টাকা শোধ করে দেব।"
"ওসব পেঁয়াজি ছাড়ো চাঁদু।ওসব মিনমিনে কাঁদুনিতে দীনেশ সাউ এর মন গলে না। যা,তোকে টাকা নিতে হবে না।"
"রাগ করছ কেন দাদা!তুমিই তো আমাদের বল-ভরসা। বেশ, কাল একটা কিছুএনে দেব।"
কথাটা বলল বটে। তবে পারবে কিনা সে বিষয়ে তার নিজের‌ও সন্দেহ আছে। অথচ রোজগার তার মন্দ নয়। শুধু জুয়া আর মদের নেশায় সে আকণ্ঠ ডুবতে বসেছে ।এই অনৈতিকতার চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা তার নেই ।প্রয়োজনে বার বার দীনেশের কাছে হাত পাততে হয় ।তার মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসাদার এরকম অনেক দীনেশের শিকার ।দীনেশের মতো অ্যান্টি সোস্যালরা সমাজের সর্বত্র এমন জাল বিছিয়ে রেখেছে।

পশ্চিমা -ঝঞ্ঝার দাপটে সকাল থেকেই আকাশ জুড়ে সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ের মতো মেঘের সন্তরণ আর মাঝে মাঝে ছেঁড়া ছেঁড়া মলিন সূর্যালোকের লুকোচুরি খেলা চলেছে। বিকেল বেলা ঘন মেঘে ঢেকে গেল, শুরু হল ঝিম ঝিম বৃষ্টি। পূরবীর এখন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাল রাত থেকেই সঞ্জয়ের আচরণে একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিল। ভেবেছিল সন্ধেবেলায় নিশ্চয় একটা সারপ্রাইজ দেবে। প্রতিবছর আজকের দিনে ওরা রেস্টুরেন্টে খায়,সিনেমা দেখে। বিবাহবার্ষিকীর তারিখটা কখনো ভোলে না সঞ্জয়। তাই বিকেল থেকেই সাজগোজের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। ট্রাঙ্ক খুলে বরের পছন্দের শাড়িটা বের করল। ট্রাঙ্ক এর ভিতর থেকে তার গয়নার কৌটোটা বের করে ভাবলো, আজ ব্রোঞ্জের চুড়ি গাছা,গলায় সোনার চেইন আর কানের দুল পরবে।
খুব সুন্দর করে সাজবে সে। গয়নার কৌটো খুলে সে আকাশ থেকে পড়ে। তার কানের দুল জোড়া নেই! ট্রাঙ্ক এর সমস্ত জিনিস বের করে, ছতিচ্ছন্ন করে পাগলের মতো তন্ন তন্ন করে খোঁজে ।তার দুল জোড়া কোথাও খুঁজে পেল না।হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে পূরবী। যেন তার চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে নিরালম্ব ব্রততীর মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। 

অনেকক্ষণ পরে উঠে বসে। সঞ্জয়কেই সন্দেহ হয়। কিছুদিন ধরেই ওর হাবভাব ভালো লাগছে না।
তাছাড়া আজকের দিনটা ওকিছুতেই ভুলে যেতে পারে না।
পূরবীর সন্দেহ হয়, সঞ্জয় নিশ্চিত কোনো সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে।
চটজলদি উঠে দাঁড়ায় সে । নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তাদের সাত বছরের ছেলে হাবলুকে ডাকে। এখনি বাজারে ওদের আড্ডায় যেতে হবে। হয়তো সঞ্জয় কোনো বিপদে পড়েছে!
সন্ধ্যার আঁধারে ,শীতল বাদলা হাওয়া উপেক্ষা করে বাজারের গেটে একটি শিশুর হাত ধরে এক স্ত্রীলোকের ছায়ামূর্তিকে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়।
স্ত্রীলোকটি শিশুটিকে বলে, "হাবলু যাও , তোমার বাবাকে ডেকে আনো। "
শান্ত ও দীপ্ত নারীকন্ঠে সচকিত হয়ে সকলে বাজারের প্রবেশ পথের দিকে তাকায়। শিশুটি, সঞ্জয়ের' কাছে এগিয়ে এসে বলে, "বাবা, চলো।মা ডাকছে। "
সঞ্জয় মাথা নিচু করে বসে থাকে।
স্ত্রীলোকটি দৃঢ়কন্ঠে  বলে, "হাবলু বল্, আমার গলায় শেষ সম্বল সোনার চেনটা আছে। দরকার হলে ওটাও যেন নিয়ে যায়। তবু একদন্ড ওখানে আর বসে থাকা চলবে না। "

তাসের গোছাটা সজোরে মাটিতে ফেলে দিয়ে সঞ্জয় এবার ত্বরিতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর হনহন করে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। এখন ওকে আর কেউ বাধা দিতে পারে না। কোন কটু কথা  বলার কারো সাহস  হয় না।সঞ্জয়ের ব‌উ পূরবীর রুদ্র রূপ দেখে দীনেশ‌ও ভড়কে যায়। তার মুখ দিয়েও কোন কথা বের হয় না।

সাহিত্যিক চয়ন কুমার রায় 
  টিকরহাট, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ






0 Comments