রিঙ্কি বোস সেনের ছোটগল্প



       

          বিপরীতধর্মী

(ক)

রবিবারের দুপুর। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে বারোটা-পৌনে একটা হবে। বসু পরিবারের সবাই তখন খাবার টেবিলে।ছোট পরিবার, কিন্তু পরিবারের প্রতিটি রন্ধ্রে কড়া অনুশাসন। প্রতিটি কাজ এখানে ঘড়ির কাঁটার ধরে করা হয়। সঞ্জয় দিনের বেশিরভাগ সময়টা বাড়ির বাইরেই থাকে, মাঝেমধ্যে শহরের বাইরেও কাটাতে হয় কোম্পানির কাজে।কিন্তু যতই হোক বাড়ির ডিসিপ্লিনের সাথে এতটুকু কোন আপোষ সে হতে দেয় না।উর্মিও এই ব্যাপারে সঞ্জয়ের সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলে।আর তাই তো তাদের ছ'বছরের ছেলে আয়ূষ এত অল্প বয়সেই শিখে গেছে ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করতে নেই, জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক জায়গায় রাখতে হয়, জোরে জোরে হাসতে নেই, বাইরের লোকের সাথে বেশি বকবক করতে নেই, কেউ কিছু দিলে থ্যাঙ্কিউ বলতে হয়, আরও কত কিছু।

বিমলা দেবী হলেন পরিবারের মাথা, অবশ্য শুধু নামেই।পাঁচ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে তিনি এখন অনেকটা জীর্ণ আসবাবের মত বাড়ির জায়গা জুড়ে আছেন।পরিবারের অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটিতে তিনি মৌন থাকাই শ্রেয় মনে করেন।সঞ্জয়ের বাবার রেখে যাওয়া পেনশনের পরিমাণ যে খুব বেশি নয়।তার উপর মাসে ওষুধই লেগে যায় হাজার তিনেক টাকার।শরীর নিয়ে ঝুটঝামেলা তো সারা বছরের গল্প।এমন অবস্থায় নির্বিরোধী হয়ে থাকাই নিরাপদ।

তবে একটা সময় ছিল যখন বিমলা দেবীর মর্জি ছাড়া এই বাড়ির পাঁচিলে একটা কাকপক্ষীও বসতে পারতো না।এতটাই দাপট আর কর্তৃত্ব ছিল তার।কিন্তু সময়ের সাথে সেই রাজপাট আর নেই। সংসারের এটাই নিয়ম। নতুন আসবে, পুরনোকে সরে যেতে হবে।বিমলা দেবীও সরে গেছেন,উর্মি যখন এলো। এখন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই একমাত্র উপায়।
__'আপনার ভাত দেখুন, ঠিক আছে না আরেকটু দেবো?'
উর্মি খাবার পরিবেশন করতে করতেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।রোজ দেয়।বিমলা দেবীর ভাতের পরিমাণ এতদিনে উর্মির বুঝে যাওয়া উচিত। বোঝে না তা নয় কিন্তু ঐ কেজো ভঙ্গিতে একবার জিজ্ঞেস করা আর কী! বিমলা দেবীও কেজো ভঙ্গিতে উত্তর দিতে শিখে গেছে।আর তাই বাদপ্রতিবাদে না গিয়ে বলে দেয়, 'নাহ! ঠিক আছে'।উর্মির অবশ্য উত্তর শোনার সেরকম কোনো তাগিদ থাকে না।ভাতের ডেকচি'টা টেবিলের মাঝখানে রেখে সে খেতে বসে যায়।আজকেও তার কোনো ব্যতিক্রম হল না।

পরিবারের অনুশাসন মাফিক খাবার টেবিলে সবাই নীরবতা বজায় রেখেই খাচ্ছে।এই নিয়ম একসময় বিমলা দেবীই শুরু করেছিলেন। এখন ছেলে সঞ্জয়, অভ্যাসের বশে এটাই লাগু রেখেছে, এমনকি ছ'বছরের ছেলেটাকেও অক্ষরে অক্ষরে অভ্যাস করিয়েছে।তবে বিমলা দেবীর আজকাল মনে হয় নিয়ম ভাঙারও একটা নিয়ম থাকা দরকার বোধহয়, তানাহলে কখনো কখনো কিছু কথা গলার কাছে এসে বড্ড চাপ সৃষ্টি করে।এই আজ যেমন করছে।ভাতের দানাগুলো থালার এদিকসেদিক নাড়ছে আর ভাবছে, বলবে? বলাটা ঠিক হবে?
__'বলছিলাম উর্মি.....'

শব্দদুটো বলেই একটু হাল্কা বিষম খেলো বিমলা দেবী।উর্মি বড় বড় চোখে তাকালো।আয়ূষ আস্তে করে জলের গ্লাস'টা এগিয়ে দিল ঠাম্মির দিকে।
__'মা, খাবার সময় কী দরকার কথা বলার? খেয়ে নাও তারপর নাহয় বোলো'।
সঞ্জয় গম্ভীর গলায় বলল।বিমলা দেবী জল খেয়ে গ্লাস'টা নামিয়ে রেখে আয়ূষকে দেখে একটু হাসলো, আয়ূষও হাসলো।
__'হুম, পরেও বলা যেতো কিন্তু ততক্ষণে....বলছিলাম আজ দেড়টা থেকে উৎসব চ্যানেলে গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমা'টা হবে।তোর মনে আছে সঞ্জু, তোর বাবা তোকে সিনেমা হলে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে এনেছিল, তুই খুব আনন্দ পেয়েছিলিস?'__
সঞ্জয় খাওয়া থামিয়ে কয়েক পলক বিমলা দেবীর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল।উর্মিও একইভাবে তাকিয়ে।আয়ূষের বুক ঢিপঢিপ করছে ভয়ে।

__'হ্যাঁ মনে আছে, তো?'
সঞ্জয়ের প্রশ্ন।বিমলা দেবী কিছু একটা বলতে যাবে উর্মি তাকে থামিয়ে দিয়ে,
__'মামনি তুমি কি আয়ূষের জন্য বলছ?'
বিমলার চোখেমুখের অভিব্যক্তিতে উত্তর খুঁজে নিল উর্মি।
__'কীভাবে বল তুমি মামনি? এইভাবে তো ছেলেটা স্পয়েল হয়ে যাবে!'
__'আমিও তাই ভেবেছিলাম, সঞ্জুর বাবার উপর রাগও করেছিলাম।কিন্তু সে বলেছিল এই সিনেমা যে সে সিনেমা নয়, বুঝতে পারলে অনেককিছু শেখার আছে, আর বুঝতে না পারলেও কোন দোষ নেই, নিখাদ আনন্দ দেবে এই সিনেমা....সবার দেখা উচিৎ, বাচ্চা বুড়ো সবার'।

কয়েক মুহুর্তের জন্য চারপাশ পুরো চুপ, শুধু থালার উপর হাত চলার শব্দটুকু ছাড়া। তারপর উর্মিই বলল,তবে খুব চিবিয়ে চিবিয়ে,
__' দ্যাখো মামনি, তোমার সময় তুমি আর বাপি কীভাবে ছেলে মানুষ করেছ আর এখন আমরা কীভাবে আয়ূষকে তৈরি করব এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। আর যে সিনেমার কথা বলছ, আমি জানি, ছোটো বেলায় আমিও দেখেছি, বাট এখন এইসব কন্টেন্ট খুব ইররেলিভেন্ট।এখনকার বাচ্চাদের এইসব ভালোও লাগবে না আর ট্রুলি স্পিকিং কাজেও লাগবে না....এনিওয়ে আয়ূষের ব্যাপারটা মামণি, আই থিঙ্ক, তোমার আমাদের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।আর এমনিতেই ছোটবেলায় কীসব জিনের গল্প শুনিয়েছিলে তুমি, তারপর তো জানই আয়ূষ কেমন ফ্যান্টাসির ওয়ার্ল্ডে ডুবে থাকতো।এইগুলো একদম ঠিক নয় ফর হিস সাইকোলজিক্যাল ওয়েলবিং। প্লিজ মামনি আর নয়'।  

এরপর বিমলা দেবীর আর কিছু বলারও থাকে না।চুপ করে যেতেই হয় বিশেষ করে যেখানে ছেলেও চুপ করে শুনে গেল সব।আসলে সঞ্জয়ের বাবার চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়ির ছবিটা'ই পাল্টে গেছে।বিমলা দেবীর জীবন'টা তো পুরো মাত্রাতেই পাল্টে গেছে।সঞ্জয়ের বাবার কথা মনে পড়তেই একরাশ অভিমান আর অভিযোগ বিমলা দেবীর দুচোখকে ভরিয়ে দিল।কেউ যাতে বুঝতে না পারে তাই চট করে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখমুখ মুছে নিল।কেউ সেরকম বুঝতে পারলো না, ছ'বছরের আয়ূষও নয়।মা-বাবার কড়া অনুশাসনে সে তখন চুপচাপ খাবার শেষ করতে ব্যস্ত।

(খ)

শ্যামলীর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো।গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো। সত্যি! তিলে তিলে সংসার গড়ে তুলে, ছেলেকে কষ্ট করে মানুষ করে, তাকে লায়েক বানিয়ে পছন্দ মত বউ এনে যদি নিজের অস্তিত্বটাই অপাংক্তেয় হয়ে যায় সকলের কাছে তাহলে এর চেয়ে দুঃখের কিছু হয় না। অথচ এইরকম উদাহরণ আশেপাশে কত দেখছে শ্যামলী। কষ্ট হয় খুব, কিন্তু কী আর করবে ও। নিজের নিজের কপাল, নিজের নিজের জীবন। কেউ কারোর কষ্ট নিতে পারে না। ওই হা-হুতাশটুকু করা ছাড়া।

আর নেওয়া যাচ্ছিল না সিনেমা'টা।বড্ড কষ্টের।টিভি'টা তাই বন্ধ করে দিয়ে রিমোট'টা পাশে রেখে শ্যামলী সোফায় পিঠ এলিয়ে দিল।মুহুর্তের মধ্যেই হিয়া ছুটে এলো, এসেই শ্যামলীর হাত'টা ধরে,
__'মা, চল তো বনি কিছুতেই ঘুমোচ্ছে না, খুব বায়না করছে তোমার কাছে ওই আলিবাবা চল্লিশ চোর গল্পটা শুনবে...আমি কত গল্প শোনালাম, ব্যাটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে, ঘুম নেই...উনি আলিবাবাই শুনবেন'।
শ্যামলী একগাল হেসে,
__'তা তুইই শুনিয়ে দে না আলিবাবার গল্প'।
হিয়া চোখ পাকিয়ে, ভেঙচি কেটে,
__'হুঁ! তোমার নাতি আমার কাছ থেকে শুনবে তবে তো, উনি সাফ বলে দিলেন 'তুমি ঠাম্মির মত পারো না বলতে'...নাও নাও ওঠো, যাও শুনিয়ে দাও তাতে যদি একটু ঘুমোয়, আমি ততক্ষণে ছাদের জামাকাপড় এনে গোছাই, রান্নাঘরও ওলঢাল পড়ে রয়েছে, তোমার ছেলে আবার আজকে আগে চলে আসবে, এসেই তো আবার টিফিন টিফিন করে চিল্লোবে'।

কথা শেষ করেই হিয়া শ্যামলীকে সোফা থেকে টেনে তুললো।তারপর বনির ঘরের দিকে নিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে,
__' শোনো বনি ঘুমিয়ে গেলে, তুমি পাশটাতেই শুয়ে পোড়ো, আমি বাইরে ডিভানে শুয়ে পড়ব, এমনিতেই আমার কাজ কখন শেষ হয় তার ঠিক নেই।আর বলছি আজ সন্ধ্যে লুচি ঘুগনি করব ভাবছি, তুমি শুধু একটু ময়দা'টা মেখে দেবে?'
শ্যামলী মুচকি হেসে,
__'দেবো।'
__' দেখো তোমার ছেলে না আবার বলে বসে, 'শাশুড়ি'কে ভালো মানুষ পেয়ে কাজ করাচ্ছ?'__
খিলখিল করে হেসে বলল হিয়া। শ্যামলী দু'হাতে হিয়ার মাথাটা ধরে, 
__' তুই আমাকে শাশুড়ি আর ভাবলি কবে?....যাহ! তোর কাজগুলো সারগে, আমি দেখি দাদুভাই কী বলছে'।
হিয়া একগাল হেসে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।শ্যামলী সেইদিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো, লোকে বলে, 'সিনেমা কখনোই বাস্তবের মত হতে পারে না, কারণ সিনেমায় কল্পনা থাকে আর কল্পনা সবসময়ই সুন্দর, বাস্তবের মত কুৎসিত নয়'.... কথাটা বোধহয় পুরোটা ঠিক নয়, কারণ কখনো কখনো বাস্তব সিনেমার চেয়েও বেশি সুন্দর হয়, বেশি স্বস্তির হয়।সবাই বিমলা দেবী হয় না কারণ কিছু যে হিয়াও হয়।

             গল্পকার রিঙ্কি বোস সেন 

0 Comments