চলচ্চিত্র সমালোচনায় অভিষেক ঘোষ


 





ফিল্ম : 'জোনাকি' (২০১৮)
ভাষা : বাংলা,
পরিচালক : আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত,
অভিনয়ে : ললিতা চ্যাটার্জি, জিম সর্ভ, রত্নাবলী ভট্টাচার্য প্রমুখ ।

  
আপনার ছেলে কি শুক্তো খেতে চায় না ? এরকম প্রশ্ন শুনে যারা বিরক্তি ভ’রে মুখ ব্যাঁকান, তাদের ফের প্রশ্ন করি ? আপনি কি ‘শিল্প’-জিনিসটাকে ভয় পান ? ভয় পান কেন ? শিল্প কি কামড়ে দেবে ? হ্যাঁ । দিতে পারে । চেতনায় । ভোঁতা ইচ্ছেগুলোকে নতুন চেতনা তখন তাড়া করতে পারে । বিষয়টা বোধহয় এখন এই জায়গাতেই এসে দাঁড়িয়েছে । বরাবর ভোঁতা বাঙালি জনাকতক মহামানবের সঞ্জীবনী চেতনা-কে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বলে দাবি করে খুশি হয়ে ছিল । এরপর কেউ যদি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, “ধুস তুমি কিস্যু জানো না” বলে ওঠে, বাঙালির বড্ড আত্মসম্মানে লাগে । অমনি রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ ইত্যাদি বোড়ে গুলোকে সামনে এগিয়ে দিয়ে, নিজেরা তার পিছনে আত্মগোপন করে । “আমরা তো অল্পে খুশি” বলে সাড়ম্বর আত্মপ্রসাদপূর্ণ হাসি হেসে লাভ হয় কিছু ! এই অল্পে খুশি থাকার ফলেই রাজ্যের এই অবস্থা । দেশের এই অবস্থা । শিল্পের এই অবস্থা । অল্পে খুশি থাকলে এদেশে কখনো মেসি-র জন্ম হবে না । আসবে না দ্বিতীয় কোনো ‘রে’ । ঐ ‘ভিঞ্চি দা’-তেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে । শুক্তো খেয়ে ভাবতে হবে, “আমি গর্বিত আমি বাঙালি” ! যদিও শুক্তো-টা মিস্টি ছিল । নতুন ট্রেন্ড । নইলে বাঙালির বাচ্ছা-রা খাবে না । নিমপাতা, উচ্ছে পাওয়া যাচ্ছে না, বা “এই বাজেটে ওসব হয় ?” বললেই হল । কিন্তু ঘটনা হল, শিল্পীর টাকার চেয়ে ভাবনা, সাহস, বিশ্বাস লাগে । প্রকৃতির কথা ভাবুন । প্রকৃতির বুকে শিল্প কত সহজে নিত্য নির্মিত হয়ে চলেছে । আকাশে শারদীয় মেঘের কারুকাজ, জ্যোৎস্নায় পাতার ছায়ায় তৈরি আলপনা, জলাশয়ে বাতাসের অভিঘাতে ঢেউ খেলে যাওয়া অথবা, মশারির আবডালে জোনাকির ওড়াওড়ি (বাকিটা জানতে দ্বিজু রায়ের গানটা শুনে নিন) । এসব তো কতই সহজে রোজ ঘটছে । কিন্তু কি জানেন, ওসব তেঁতো শুক্তো হয়ে গেছে । আপনাদের রুচবে না । তাই যেসব বিদেশি খাবার আপনারা খান নি, তাই ভেঙেচুড়ে মুচমুচে ফাস্ট ফুড বানিয়ে আপনাদের খাওয়ানো চলছে। হ্যাঁ, আদিত্য বিক্রমের দ্বিতীয় সিনেমাটি দেখে এইসব মনে এল । 


যখন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের মৃতদেহটিকে ম্যাটাডোরে তুলে, খই ছড়াতে ছড়াতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন এই একটা-দুটো লোক নতুন অপরাজিতা ফুলের গাছ পুঁতছে। সেই গাছ বাঁচবে কিনা, আপনাদের শিল্প-কে অনুভব করবার চোখ খুলবে কিনা, সেটা অবশ্য আপনারাই জানেন । কেউ সিনেমা বানায় টাকার জন্য, কেউ বানায় চালিয়াতি করার জন্য, কেউ বানায় নিজেকে বোদ্ধা প্রমাণ করার জন্য, কেউ বানায় অপরের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার জন্য, কিন্তু এরা কেউ নিজস্ব অনুভবগুলোকে, সমাজগত আর্তি-গুলোকে প্রকাশ করার জন্য সিনেমা বানায় না । ওরা সবাই অসৎ । মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, নিজেকে প্রকাশ করা । সেটা না করতে পারলে অথবা, না চাইলে সিনেমা-তে ক্রাফ্ট বলে কিছু থাকে না । ঝালমুড়ি বা, দিস্তা খাতার মত বাড়িতে আসে ও ফুরিয়ে যায় । যদি ক্রাফ্ট বলে সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা আদিত্য বিক্রমের এই ছবিতে আছে । সেটা কতটা অর্থপূর্ণ হতে পেরেছে, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে । এলিমেন্ট অফ হরর এখানে স্মৃতির বিষাদ-কণিকা, জোনাকির মত জ্বলে । কমলালেবু এখানে শৈশব থেকে যৌবন - অজস্র অবদমিত ক্ষতচিহ্নের ক্লেদাক্ত গন্ধ বয়ে আনে । তার খোসা ছড়িয়ে থাকে পদচিহ্ন না মেলানো অভিসারের পথে । যতই পোড়াও তবু বারুদ-মুখী ঈর্ষা, বিবেচনাহীন অবজ্ঞা, সংকীর্ণ বিবেকে ফুলঝুরি হয়ে জ্বলতেই থাকবে । পুড়বে এবং পোড়াবে ‘দেখতে চাওয়া স্বপ্নগুলো' । শৈশব সাপের খোলসের মতো পিছনে ফেলে রেখে আসা যায় না সবসময় । বিগতযৌবনা বৃদ্ধার হাসিতে সেই মেয়েবেলা বাঁচে । মায়ের ধমক বাঁচে । জ্বর বাঁচে স্যালাইনে । পোড়া কপাল বাঁচে শরীরের কুঞ্চিত চর্মে । বাসর রাতের গ্লানি বাঁচে ফুলে ওঠা উদরে । অতৃপ্ত অহমিকা বাঁচে পেকে যাওয়া সাদা চুলে । স্থবির জীবন বাঁচে অসার টিউমারে । মনের গহনে যা কিছু অব্যয়, তাই এই ছবিতে ছদ্মবেশে আসে । আর এই ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ আদিত্য বিক্রম-ও কিছু গিমিক আর ওয়ার্ল্ড সিনেমার চেনা ছকে জড়িয়ে পড়েন । কিন্তু তাই বলে তাঁর এই স্বাতন্ত্র্যে ভরপুর ভাবনা মিথ্যে হয়ে যায় না । আমি যা যা ভেবেছি, ঠিক তেমন তেমন করবো, কারো কথায় তা থেকে সরবো না — এই জায়গাতেই এইসব ছবির জমি তৈরি হয় । আমরা আবার একটু স্বপ্ন দেখার মুক্ত পরিসর পাই । পাই পরিচালকের চোখের জানালা আর স্বাধীন চিন্তনের একটু অবকাশ । তাই ধন্যবাদ জানাতেই হয় আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত-কে । জোনাকির ওড়াওড়ি মলিন বিষাদময় দর্শনে ক্যামেরাবন্দি করার জন্য । বিয়ের সানাই, মন্ত্রপাঠ আর পায়রার বকম বকম শব্দ একসাথে মিলেমিশে ঐক্যতান তৈরি করছে, এমনটাই বা শেষ কোন বাংলা ছবি-তে শুনেছেন, মনে করুন দেখি । শেষ কোন বাংলা ছবিতে এমন স্থির ক্যামেরায় দৃশ্যান্তর দেখেছেন, মনে পড়ে ? ছেলেবেলায় যেসব পুরনো দালান, আগাছায় ঘেরা বাগানগুলো দেখে অজানা আতঙ্ক তৈরি হত, এই ছবিতে বড়ো হয়ে যাওয়া সেই ছেলেটির চোখ দিয়ে অব্যক্ত সেইসব অনুভূতিগুলোকে দেখে ও দেখায় আদিত্য । দেখে শ্যাওলা জমতে, দেখে সেই অবুঝ গোঁ আর বড়দের উদাসীনতাগুলোকেও । ধন্যবাদ জানাতে হয়, এরকম ড্যাম্প ধরা দেওয়াল, সজনে ডাঁটার মত আঙুল, শরীরী সন্ত্রাস ও শরীরের ওপর এমার্জেন্সি, যুদ্ধ-পরিস্থিতি দেখানোর জন্য । আক্ষেপ হয় তাদের জন্য, যারা ছবিটা না দেখেই এই রিভ্যিউ পড়বে আর কিছুই না বুঝে আমার ওপরেই রেগে যাবে ।


 “হাওয়া বয় শন শন তারারা কাঁপে / হৃদয়ে কি জং ধরে পুরানো খাপে ? / কার চুল এলোমেলো / কি বা তাতে এলো গেলো! / কার চোখে কত জল কে বা তা মাপে ?” হ্যাঁ, ললিতা চ্যাটার্জি-কে দেখে তেমনটাই মনে হল বটে । ছবিটা দেখতে দেখতে  আফসোস  হয়, আমরা শিল্পের  আতশবাজি দেখার প্রলোভনে মাল্টিপ্লেক্সে যাই আর সস্তা রিমেক অথবা, আঁতলামি, চালাকি দেখে বাড়ি ফিরি, আর 'জোনাকি'-র মতো সিনেমা... হল পায় না - মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে না । খেয়াল করে দেখুন, কোথাও এতটুকু পরিবর্তন ঘটেছে কি?


       আলোচক অভিষেক ঘোষ

0 Comments