
শিপ্রাদি
আমি যখন ১১/১২ ক্লাসে অর্থনীতি নিলাম,তখন শিপ্রা ঘোষ আমাদের পড়াতে এলেন। কালো,স্বাস্থ্যে সমুজ্জ্বল চেহারা।সুগঠিত দাঁতের সারি,শিক্ষক সুলভ ঢিলেঢালাভাব ও নিজের প্রতি অযত্ন কোথাও নেই। একেবারে বিদ্যুৎ এর মতো ঝলমল করতেন। ক্রমে আমি জানতে পারি তিনি খ্যাতিমাণ অভিনেতাও নাট্যকার ও কবি এমন একজনের শ্যালিকা,যিনি আমাদের মতো যারা সত্যজিৎ রায়ের অন্ধ ভক্ত,তাদের উপাস্য। এঁর নাম বাংলার সবাই জানেন, তাই অপ্রয়োজনীয় বলে উহ্য রাখলাম। আমি জানতাম ইনি এক কাল্ট পত্রিকা এক্ষণের সম্পাদক ও বটে, এবং সেই সূত্রে শিপ্রাদির কাছে এক্ষণের সব সংখ্যা আছে ।
সেই লোভেই আমার শিপ্রাদির বাড়ি যাওয়ার শুরু। সেই সময় এই অপূর্ব মহিলা আবার আমাদের কয়েকজন কে প্রাইভেট এ পড়াতে শুরু করেন।
ফলে,আমার পোয়াবারো হল।
আমরা তখন যেখানে থাকতাম,সেখান থেকে পনেরো মিনিটের মত হাঁটলেই শিপ্রাদির বাড়ি যাওয়া যেত। ফলে, তাঁর বাড়ি যাওয়া আমার নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়ালো। ক্লাস সেরে, আমি সোজা চলে যেতাম শিপ্রাদির বাড়ি। বিকেলের চা বা কফি, তার সাথে বিপুল পরিমাণ জলখাবার সেখানেই হোতো। অসামান্য রান্নার স্বাদ। যা, এখনো মুখে লেগে আছে। আস্তে, আস্তে অন্যরাও আসতো। পড়াশোনা শুরু হতো। কে শিপ্রাদির সবচেয়ে কাছের মানুষ,তা নিয়ে স্বভাবতই নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো,কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে যখন আলোচনা সাহিত্য, নাটক, সিনেমার দিকে গড়াতো, তখন কেউ আমাকে এঁটে উঠতে পারতো না। কারণ,বয়স অনুযায়ী,আমি ছিলাম সবচেয়ে যাকে বলে,এঁচড়ে নয়, একেবারে কলা গাছেই পাকা। আমার বয়স তখনও কুড়ি হয়নি, তার মধ্যেই আমার সমগ্র রবীন্দ্রনাথ পড়া হয়ে গেছে, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় দেখা হয়ে গেছে। জীবনানন্দ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। অনুবাদে পড়েছি, মনতালে, কোয়াসিমোদো, এলিয়েট,মায়াকভস্কী, আকমাতোভা,গডফ্রিড বেন,পস্তেরনাক। সিনেমায় আমাদের ত্রয়ী ছাড়াও, বার্গম্যান,গোদার, ত্রুফো, কিউব্রিক,কুরোসাওয়া, ওজু,পোলানস্কির সাথে পরিচয় হয়েছে।বাংলা সাহিত্যের গদ্যের মহারথীরা, এমনকি কমলকুমার ও অপঠিত নেই। মনে আছে, আমার উনিশ বছরের জন্মদিনে এই শিপ্রাদিই আমাকে অন্তর্জলি যাত্রা উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর বিপুল সংগ্রহ থেকে,হাতে তুলে দেন সিলভিয়া প্লাথ অথবা গিরিশ কারনাড়ের হয়বদন। মোহন রাকেশের নাটক দেখতে তিনিই আমাদের নিয়ে যান পদাতিক এ, মনি কাউল এর ছবি দেখতে নিয়ে যান সরলা রায় মেমোরিয়াল এ। সে এক অন্য পশ্চিম বাংলা।সবে তিন, চার বছর হোলো বামফ্রন্ট সরকারে এসেছে। চারপাশে নতুন সংস্কৃতির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। কি উৎসাহ মানুষের,নতুন নতুন কত চর্চা। সাহিত্যে,সিনেমায়, থিয়েটারে নতুনের কেতন উড়ছে পত পত করে।
এই মানুষটি, সেই সন্ধি সময় যোগ্য ও অভিজ্ঞ মাঝির মতো,আমাদের মন পবনের নাও বেয়ে নিয়ে চল্লেন, বোঠে ধরে রইলেন শক্ত হাতে। আজ আমি যা কিছুই হতে পেরেছি, তাতে আমার পরিবার ছাড়া আমার প্রাণপ্রিয় দিদির সহযোগিতা ছিল সর্বাধিক।
বাহিরের উত্তেজনা, উচ্ছলতা, চাপল্যের তলায় তলায়, যে অন্তঃশীলা মননের ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছে,তার অমলিন ধারায় তিনিই আমাকে প্রথম স্নান করান।
তোমাকে নমস্কার।
0 Comments