
ওরে ব্যাটা চাষার ব্যাটা
আমাদের মধ্যে যারা মহানগরে থাকি,তারা ট্রেনে যাবার সময় অথবা হাইওয়ে দিয়ে গাড়িতে যাবার সময়,দেখি যে দুপাশে ধান রোয়া,লাঙল চালানো,ধান ঝাড়া ইত্যাদি চলছে।আজকাল অবশ্য গোরু দিয়ে হাল চষা ইত্যাদি বন্ধ হয়ে গেছে,ট্রাক্টার,টিলারই বেশি দেখা যায়।একসময় বাংলা ছবির বাঁধাধরা সিন্ ছিল বলদে চাষ হচ্ছে,পুকুর পাড়ে লজ্জাশীলা গাঁয়ের বধূ, বটের ঝুরি ধরে দোল খাওয়া হাপপেন্টুল শোভিত বালক,ব্যাস গ্রাম এসট্যাবলিস্ট হয়ে গেল,সেসব সুখের দিন আর নেই।
মানে আদতে গ্রাম নিয়ে ছবি করাই তো বন্ধ।একসময় শুনতে হত," মশাই,ওসব আপনাদের ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাপার,গাঁ এর মানুষ বুঝতে পারবে না। গ্রাম বেসড্ গল্প ভাবুন "আর এখন শুনি" সেকি,আপনার ভিলেজ বেসড্ স্টোরি নাকি? ও বাবা,ওসব
ইন্টেলেকচুয়াল স্টোরি,মাল্টিপ্লেক্স এর অডিয়েন্স রিলেটই করবে না"...
কিম্ আশ্চর্যম্।
তাই,আমরা যারা শহরে থাকি,চাষীর জীবন ইত্যাদি নিয়ে লিখতে হলে ভীষণ ঘেঁটে যাওয়া অবস্থায় থাকি।
আমার অবশ্য কপালে দেশের নানা জায়গায় নানান ধরনের চাষার ঘরে ঘুমোনোর কপাল হয়েছে। মিজো, হরিয়ানভী,বিহারি,তামিল,মারাঠা,সাঁওতাল, মোংপা,বোরো কাচারি,রিয়াং,কারা নেই তার মধ্যে!
এমনকি পোড়া বাংলার অতীতের লালপতাকা ওড়া ঘরেও এই অধম রাত্রিবাস করেছে। নিধুবাবু বলেছেন "নানান দেশের নানান ভাষা" সেই নানান ভাষা নিজের কানে শুনেছে।তাই এই বিষয় আমার যাকে বাংলায় বলে "এক্সপিরিয়েন্স" সেটা বেশ ভালোভাবেই আছে।তাই,গুরুগম্ভীর বিষরের অবতারনা না করে দুটো মজার গালগল্প শোনাই,একটা হরিয়ানায় আর একটা অসমে।
হরিয়ানায় ঘটনাটা অনেক দিন আগের,তখন আমি একটা বিজ্ঞাপনের অফিসে চাকরি করি।আমরা একটা হরিয়ানার বিদ্যুৎ প্রকল্পের ছবি পেলাম।আমি এক্সিকিউটিভ,আর আমার এক শ্রদ্ধেও দাদা পরিচালক।
হিসারের কাছে,একটা বড়সড় গ্রামে এক চাষীর বাড়িতে আমাদের থাকবার বন্দোবস্থ।গ্রামে ঢুকেই দেখলাম একটি বিলাতী মদ্যের দোকান,তাতে স্কচ শোভা পাচ্ছে,আর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বি এম ডাব্লিউ।চকিতে উপলব্ধি হোলো" এ গেরাম,সে গেরাম নয়গো"...যাই হোক প্রচন্ড খাতির যত্নে দুদিন কাটাবার পর,এক সন্ধ্যার শুটিং থেকে ফিরে উঠোনে আলাপচারিতার আসর বসলো,বাড়ির কত্তার বাপ নিজে আলাপে বসেছেন,তাই সকলেই তটস্থ।আমার পরিচালক মশাই নিতান্ত অভদ্রের মতো বুড়ো কত্তাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন" আপলোগ কো মাহিনা মেঁ কিতনা রোজকার হোতা হায়"...ভদ্রলোক কিছু মাত্র অপ্রতিভ না হয়ে অম্লান বদনে উত্তর দিলেন"কেয়া বাবু,হামলোঁগ গরীব আদমি হ্যাঁয়,মাহিনে মেঁ তকরিপন চার লাখ হোগা"...সহসা উঠানে নীরবতা নেমে এলো। চার লাখ!! তখন উনিশো সাতাশি সাল,আমার মাসিক বেতন সাড়ে চার হাজার টাকা,আর এই সাদা পাগড়ির বুড়োর রোজগার চার লাখ! নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল,আমার পরিচালক মশাই অস্ফুটে বললেন," মা,মাগো,আমি বাড়ি যাবো।"তারপর "কত কত বোতল রাম হবে,কত কত বোতল" বলতে বলতে স্থানত্যাগ করলেন।অনেক কষ্টে আমাকে বোঝাতে হল যে,আজ ওঁনার মা'র প্রয়াণের দিন,তাই উনি শোকপালন করতে গেলেন।
পরের ঘটনাস্থল অসম। সন দুজার চার।বোরো কাচারি দের গ্রামে কাজ করছি।এ গ্রামের চাষী হরিয়ানার চাষী নন,দু বেলার খানা যোগাড় করতে ঘাম ছুটে যায়, পাহাড়ের ঢালে জুম চাষ করেন একবার তাঁদের ক্ষেতের ছবি তুলতে গেলাম,না গেলেই বোধহয় ভালো হত। পাহাড়ের গায়ে খাড়া পথ সোজা তিন কিলোমিটার উঠে গেছে।তাই দিয়ে বোরো মেয়েরা পিঠে বাচ্ছা নিয়ে তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছে। আর আমরা,ক্যামেরা,সাউন্ড মেশিন,আলো ইত্যাদি নিয়ে অতি ধীরে ধীরে আঁকড়ে বাঁকড়ে উপরে উঠে,কুকুরের মতো হাঁফ ছাড়ছি,এমন সময় পেছন থেকে মহিলা কন্ঠে উচ্চকিত হাসি শোনা গেল। ফিরে দেখি যে আমাদের ক্যামেরা কেয়ারটেকার যাদব বিষম সংকটে পড়েছে,প্রায় উঠে এসেছিলো চূড়োয়,এমন সময় এক বিশাল,ব্যাদড়া পাহাড়ি ছাগল,তার পথ আগলে ধরেছে। যাদবের কাঁধে ক্যামেরা ব্যাগ,হাতে ছাতা,পা টিপে টিপে সে উঠছিলো,ছাগল ব্যাটা খাড়াই এর মুখে এমন জায়গায় এসে সিং পেতে দাঁড়িয়েছে যে,সে না পারে পেছতে,না পারে এগোতে। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে একটা বাচ্ছা মেয়ে মুখ একটা অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ছাগলটাকে তেড়ে গেল, ছাগলটা সার্কাসের শিক্ষিত জন্তুর মতো,পায়ের উপর পাক খেয়ে একছুটে উপরে উঠে এলো,আর যাদব ও এতক্ষণের টেনশন আর সহ্য করতে না পেরে,ধড়ফড় করে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।
পরিচিতিঃ ১৯৬২ এ জাতক অনিন্দ্য দত্ত। ২৪ বছর ধরে সিনেমার সাথে যুক্ত। ১১ টি সিরিয়াল,৭০ টি ডকুমেন্টারি, ৮ টি টেলিফিল্ম, একটি শর্ট ও অনেক করপোরেট ছবি করেছেন। ঝোলায় আছে২৩ টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সন্মান। ১৩ বছর আগে থেকে মুম্বাই প্রবাসী ও কর্মরত। ছবি করা ছাড়াও কবিতা,গদ্য,প্রবন্ধ, নিবন্ধ,স্মৃতি আলেখ্য ইত্যাদি লিখে থাকেন। একটি বই প্রকাশিত,আর ও একটি প্রকাশিতব্য।
0 Comments