অনুরঞ্জনা ঘোষনাথের গল্প


নলেন গুড়

কালবেলা টবের গাছে জল দিচ্ছিল অনুপমা।বেশ শীত শীত লাগছিল,ঘরের থেকে একটা হালকা চাদর গায়ে দিয়ে এল সে।সকালের ডিমের কুসুমের মত কাঁচা হলুদ রঙের রোদ এসে ব্যালকনির গাছগুলোকে উজ্জ্বল সবুজ রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে,আর এক অবর্ণনীয় অনুভূতি অনুপমার মনের ভেতর ছড়িয়ে যাচ্ছে অনেকটা একটা কাঁচের গ্লাসে এক বিন্দু জলরং পড়ার মত। নাঃ! শীত তাহলে পড়েই গেল।শীত এলেই মনটা নেচে ওঠে ওর।শীত মানেই তো বিশ্রী গরমের প্যাচপ্যাচে ঘাম আর বর্ষার ক্যাতক্যাতে কাদা থেকে মুক্তি, আর পাতে প্রিয় সবজির ভিড়,কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় তার নলেন গুড় আর তা দিয়ে তৈরি সন্দেশ।এমনিতে মিষ্টি প্রিয় নয় একদমই - কিন্তু নলেন গুড়ের সন্দেশ এর কথা অবশ্য একদমই আলাদা।গতবার পঁচিশে ডিসেম্বরের ছুটিতে ওরা মানে অনুপমা, ওর বর ও ছেলে আর বরের দুই বন্ধু ও তাদের পরিবার সমেত মন্দারমনি গিয়েছিল।ফেরার পথে পাঁচলিটারের খালি মিনারেল ওয়াটারের বোতলে করে খাঁটি নলেন গুড় নিয়ে এসেছিল ওরা ফিরতি পথে রাস্তায় বিক্রি হচ্ছিল।গাড়ি চলাচলের পথের ধারে খোলা জমিতে কাঠের জ্বালে ইঁট দিয়ে তৈরি  বিশাল একটা লম্বাটে উনুনে বিরাট একটা অ্যালুমিনিয়ামের আয়তাকার পাত্রে খেজুর রস ফুটছে, একটা বাঁশের মাথা চিরে এক ফুট মত একটা কাঠের লম্বা টুকরো লাগিয়ে খুন্তির মতো করে নিয়ে একটা লোক সেই রসটাকে মাঝে মাঝে নাড়ছে।লোকটা বলল যে রাতে খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয় আর ভোরবেলা সেই রস সংগ্রহ করে নিয়ে এসে জ্বাল দিয়ে নলেন গুড় বানানো হয়,"তবে শীতের মরসুমে এই গুড় হয়,সারা বছর এমন জিনিসটা পাবেন নাই বাবুরা"।

লোকটা খেজুর রস আর নলেন গুড় নিয়ে বকবক করেই যাচ্ছিল সবার সাথে।অনুপমা কিন্তু মন দিয়ে লোকটাকে দেখছিল।লোকটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে খুব গরিব।সারাগায়ে খড়ি ওঠা,কালো রঙের মানুষটার গায়ে খড়ি উঠে উঠে কেমন ধূসর বর্ণের চেহারা হয়ে গেছে আর চুল উস্কোখুস্কো,খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর নোংরা পোশাক-আশাক। পাশে ছিল তার বউ আর দুই ছেলে মেয়ে।বাচ্চা মেয়েটির গায়ে একটা শতচ্ছিন্ন সোয়েটার আর তার থেকে একটু বড় ছেলেটার গায়ে লালরঙের একটা হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি থাকলেও গরম জামার বালাই নেই।নলেন গুড়ের দাম শুনে সবাই যখন দরদাম করছিল,তখন লোকটা বলল " বাবুরা অনেক টাকা দাদন দিয়ে কয়েকটা গাছ ইজারা নিয়েছি কিন্তু যতটা খাটনি হয় লাভ ঠিকঠাক তার কিছুই হয়না,এই টাকা দিয়ে দুবেলা-দুমুঠো পেট ভরাও যায়না। " অনুপমা বলল "থাকো কোথায়?"পিছনে একটা ঝুপড়ি দেখিয়ে বলল "এখন এখেনেই থাকি গো দিদিমনি আর বছরের অন্যসময়ে ঐদিকের গেরামে ঘর আছে ওখানে থাকি"।"এত ঠান্ডায় এই মাঠের ভিতরে? "অনুপমার প্রশ্নের উত্তরে লোকটা বলল, "কি করবো গো দিদিমণি ভোরবেলা যে হাঁড়ি নামাতে যেতে হয়,নয়তো দেরি হয়ে যাবে যে,রস মোটা হয়ে গেলে গুড়ের আর এই স্বাদ পাবেনি"।অনুপমা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে "তোমাদের ঠাণ্ডা লাগে না? "লোকটা হেসে বলল "সারাবছর মাঠে কত কষ্ট করে চাষ করিগো দিদিমণি,তাই বউ বাচ্চার মুখে ঠিক করে অন্ন যোগাতে পারি না,এই শীতের মরসুমে একটু লাভের মুখ দেখি,তাও দাদনের টাকা বেড়ে যাওয়াতে আমাদের মত গরিব চাষিরা দেনার দায়ে ডুবে যাচ্ছি, পেটের দুবেলা ভাতের জোগাড় যাদের হয়না তাদের আবার ঠান্ডা-গরম?? আমরা কি আর মানুষ আছিগো দিদিমণি? আমরা তো মরে বেঁচে আছি,আমরা তো সব এক একটা ভূত গো দিদিমনি!"

সেবার সকলের নলেন গুড়ের স্বাদ ও গুণমানের প্রভূত প্রশংসা করলেও  অনুপমার মিষ্টির বদলে কেমন যেন একটু নোনতা নোনতা স্বাদ লেগেছিল গুড়টায়! গরিব মানুষের রক্ত,ঘাম,কান্না মিশে ছিল যে তাতে! যতবার সে হালকা খয়েরি তরলটা পাঁচলিটারের বোতল থেকে ঢালছিল ততবার খালি লোকটার কথা মনে পড়ছিল- সত্যিই তো তারা কি আর সত্যিকারের বেঁচে আছে?একে কি বেঁচে থাকা বলে?মানুষের বাঁচার জন্য ন্যূনতম যে চাহিদাগুলো প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন- খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান-তার কোনোটাই তো তারা ঠিকঠাক পায়না।

আর এবার তো করোনা অতিমারিতে সারা বিশ্বই অচল হয়ে গেছে। লক্ষ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।সাধারণ মানুষই বেকার হয়ে গেছে,চরম অর্থকষ্টে ভুগছে আর দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী এই সকল মানুষদের তাহলে কি হাল হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।এইতো সেদিন অনুপমার কথা হচ্ছিল কেষ্টর সঙ্গে।কেষ্ট  অনুপমাদের পাড়ায় সবজির নতুন ফেরিওয়ালা।বাচ্চা ছেলে -এই সতেরো আঠারো বছর বয়স,করোনার জন্য হওয়া লকডাউন-এর মাঝামাঝি থেকে সবজি বিক্রি করছে।বেশ ভদ্র ও মিষ্টি ব্যবহার।

কথায় কথায় অনুপমা জানতে পারে যে কেষ্টর বাড়ি লক্ষীকান্তপুর লাইনে,ও  ইলেভেনে পড়ে,ওর বাবা গ্রামের ছোট চাষী।বাবা,মা, ঠাকুমা আর একটা ছোট বোন নিয়ে সংসার। ওখানে জীবন কষ্টে সৃষ্টে মোটামুটি কাটত। কিন্তু এই করোনা সবকিছু গোলমাল করে দিলো।একেইতো বাবা গতবার আলু চাষ করে তেমন দাম পায়নি  বলে ওদের আর্থিক অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল।ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, দালালদের অত্যাচার তো রয়েছেই তার মধ্যে করোনা ও আম্ফানঝড়ের তান্ডবে সব শেষ হয়ে গেল।এখন গলা অবধি দেনা বাবার।কেষ্টর বাবা ভেবেছিল এবছর চাষের ফসল বেচে সে ধার শোধ করবে।  কিন্তু লকডাউনে সব বাজার বন্ধ থাকায় ঘরের ফসল ঘরেই পচল তার ওপর ঝড়ে ঘরদোরও ভেঙে পড়ল।অগত্যা কেষ্ট সংসারের হাল ধরতে শহরে কাকার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছে।কাকা একটা লেদ কারখানায় কাজ করত,কিন্তু করোনায় তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাকা এখন একটা ঠেলাগাড়ি জোগাড় করেছে,তাতে করে সবজি বেচে তাই দিয়ে কাকা ভাইপো কোনরকমে দু'মুঠো খাবার জোগাড় করছে।কেষ্ট বলেছিল অনুপমাকে "জানিনা বৌদি আগামী দিনগুলো কেমন দেখবো ? বাবাকে বোধহয় এবার ক্ষেতমজুরিই করতে হবে। আমার আর বোধহয় পড়াশোনা হবে না।"  অনুপমা বলেছিল "কেন তোমাদের তো অনলাইন ক্লাস চলছে,তাই না? "

উত্তরে কেষ্ট হেসে বলেছিল "দু'বেলা দু'মুঠো ভাতেরই জোগাড় হয় না,এন্ড্রয়েড ফোনের কথাতো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা বৌদি। দুঃখ হয় আমিতো তবু মাধ্যমিক পাস করেছি হয়তো টেনেটুনে উচ্চমাধ্যমিকও পড়ে বেরিয়ে যাব কিন্তু আমার ছোট বোনটার পড়াশোনা বাবা আর চালাতে পারবে না,ওকে হয়তো শহরে কোন বাড়িতে কাজে দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কোন বাড়িতে দেব? বেশিরভাগ লোকেরই তো কাজ নেই। শহরেরই এই অবস্থা,তাহলে আমাদের গ্রামের   কি হাল কি আর বলবো!আমাদের অবস্থা শহরে থেকে আপনারা কল্পনাও করতে পারবেননা বৌদি "।সত্যি!হয়তো সচ্ছল উচ্চপদস্থ অফিসারের সংসারের গৃহিণী অনুপমার পক্ষে সবটা অনুমান করা সম্ভব নয়,তবু সে বলে নয়,বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যখন সারা পৃথিবীটারই অবস্থা টালমাটাল,ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি মাইনাসে চলে গেছে তখনই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর পরিস্থিতি তো সকলেই অল্পবিস্তর বুঝতে পারছে।

"তাহলে তোমরা কি করবে? কি করে এই ভীষণ বিপদ থেকে তোমরা বেরোবে কেষ্ট? এই দেনা থেকে মুক্তির উপায়?" 
"হাল ছাড়লে তো হবে না,কিছুতো একটা সকলে মিলে করতেই হবে।আমাদের মত গরিব মানুষের কথা তো কেউ চিন্তা করে না বৌদি,তাই আমাদের লড়াইটা আমরাই সকলে মিলে লড়বো- দলবেঁধে একসাথে। আর কদিন বাদে দেশে ফিরে যাব।দেখি তখন গিয়েই কিছু একটা ব্যবস্থা করব।" অনুপমার উত্তরে কেষ্ট বলেছিল।   
অনুপমা মনে মনে ওকে আশীর্বাদ করে বলেছিল- তাই যেন হয়,তোমরা সকলে খেয়ে পড়ে বাঁচো এটাই চাই আর মুখে বলেছিল- "সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে পড়াশোনাটা আবার শুরু করো কিন্তু"
-"হ্যাঁ বৌদি নিশ্চয়ই" হেসে জবাব দিয়েছিল কেষ্ট।

"কোথায় গো? আজ চা দেবে না?" কর্তার হাঁকে সম্বিত ফিরল অনুপমার। "হ্যাঁ,এখনই দিচ্ছিগো"- বলে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। ডাইনিং টেবিলে বসে চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দিতে দিতে কর্তামশাই বলে ওঠেন " শীত পড়ে গেল,কি বলো? গতবারের শীতে মন্দারমনি থেকে আনা সেই নলেন গুড়টা! আহা! কি অপূর্ব স্বাদ ছিল তাইনা?এক্কেবারে খাঁটি"।অনুপমা চায়ে চুমুক দিতে দিতে কোন জবাব দিলনা শুধু অন্যমনস্ক ভাবে বলল "হুঁ "।

লেখিকা অনুরঞ্জনা ঘোষ নাথ
কালিদাস পতিতুন্ডি  লেন, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 



















1 Comments