
লখার স্বপ্ন
মাথায় খড়ের বোঝা নিয়ে জোর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে ঝপ্ করে মাটির মস্ত উঠোনে বোঝাটা ফেলেই চিৎকার করে ডাকতে থাকলো লখার বাপ।
--অ --লখার মা,আমি এইসে গেচি। ভাত বাড়।
বলেই মাথার গামছা খুলে পুকুর ঘাটে যেতে গিয়েও থমকে গেল কার্তিক হালদার।কার্তিক ঠাকুরের মতন চেহারা ছিল এককালে।বাপে নাম রেখেছিল কার্তিক। ভরা বর্ষায় মাঠে কাজ করতে গিয়ে মাথায় বাজ পড়ে মরে গেল বাপটা।সেই থেকেই লখার বাপের ওপর এসে পড়ে পাঁচ ভাইবোনের সংসার।মাঠে ঘাটে হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে কার্তিক পানা চেহারা আজ ধূসরবর্ণ।
--অ-- লখার মা,কতা কইচিস না কেনে? কি হইচে?
--তোমার বড় ব্যাটা জিদ ধরতেছে। কলকেতায় পড়তে যাবে বলতেছে।
লখা মানে লক্ষ্মণ হালদাররা তিন ভাইবোন। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় মনোযোগী লক্ষ্মণের দুচোখ ভরা স্বপ্ন।অনেক-অনেক দূর সে পড়াশুনা করবে।কলকাতা বড় শহর।সেখানে কত নামকরা লোক থাকেন।কত কবি,কত সাহিত্যিক,কত বিশিষ্ট নাট্যকার,কত গানের জগতের লোক।তাদের কথা স্কুলের দেবতোষ মাস্টারের কাছে শুনে শুনে বড় হয়েছে সে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটা ছোট্ট গ্রামে যেখানে লাইটপোস্ট বসেনি এখনও কঞ্চি বাঁশের বেড়ার ঘরে ভাঙা তক্তপোশের ওপর বসে বসে রাত জেগে লম্ফ জ্বেলে দেবতোষ মাস্টারের কাছ থেকে আনা গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ,কত উপন্যাস,প্রবন্ধ চোঁ চোঁ করে পড়ে ফেলেছে সে।লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে ফেলেছে কত কবিতা। কাউকে দেখাতে পারেনি। পাছে সবাই হাসাহাসি করে।
--না না লখার মা,ও কে জানায় দাও ওসব জাগায় পড়তি যাতি হবিনি। বুকটা টনটন করে ওঠে লখার বাপের।লখার মাকে সায় মেনে বলতে থাকে
--বল্ দিকিনি লখার মা। এ কেমন আবদার?বড় ছাওয়াল। কোতায় বাপের সাতে বাদায় যাবি,হাতে হাতে ঢ্যাঁড়শ তোলবি,হাটে যাবি,সংসারের দুটো আয়পয় বাড়বে,ছোট বোনটা মাথায় মাথায় বাড়তেচে, তার বে দিতি হবি।তা না করে খালি খালি পড়াপড়া কেন রে হে? অত নেকাপড়া করতি ট্যাকা লাগেনি? অত তোর বাপ পাবে কোতায় ভাববিনি?লখার মাও তার বাপের কথায় সায় দেয়।
রাতে দাওয়ায় খেতে বসে লখার মা গিরিবালা লম্ফর আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলে
--একখান পেস্তাব দিই লখার বাপ।লখাকে এই বেলা একটা বে দাও। যা হোক আমাদের হাড় জুড়োয়।বে দেলেই দেকো ওর মাতা থিকে পড়ার পানা ভুত প্যালাবে। আর ঘরে বৌ আলে আমারো এট্টু বেশ্যাম হবে। বলেই জুলজুল চোখে লখার মা লখার বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে যায় প্রস্তাব টা লখার বাপ খুব ভালো ভাবে গ্রহণ করেছে।
--সেই ভালো। তাইলে কেষ্টা ঘটক কে ডাক করাই।
পাশের ঘর থেকে বাবা মায়ের কথোপকথন লখার কানে গেল। খুব অসহায় বোধ হল তার। খুব কষ্ট পেল। এ কেমন পরিবারে তার জন্ম ?তার ঠাকুরদার বাবা,তার ঠাকুরদা,তার বাবা পূর্বপুরুষরা সবাই এই একভাবে রোদে পুড়ে,জলে ভিজে মাঠে কাজ করেছে।একটু অন্যরকম ভাবে বাঁচার স্বপ্ন কেউ দেখেনি।তার ভাইটাকেও লেখাপড়া না করিয়ে সব্জি জমিতে চাষাবাদের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। বোনটা সবে পনেরো বছর ছেড়ে বিয়ের জন্য বাড়ছে সে। ছোট থেকেই দেখেছে গভীর রাত থেকে তার মা ঘুম থেকে উঠে ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে যখন গোলায় তোলে মায়ের নরম মুখখানা পুড়ে কষ্টিপাথর এর মতো হয়ে যায়। খুব কষ্ট হয় লক্ষ্মণের।এ ভাবে সে বাঁচতে চায় না। স্কুলে দেবতোষ মাস্টারের মুখে খেয়া কাব্যগ্রন্থ থেকে কৃপণ কবিতা পাঠ শুনে বিভোর হয়ে থাকতো সে।বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মায়ের কাছে বাবার পরিশ্রমের গল্প আবার তার কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। মাধ্যমিকে ভালো ফল করার পর থেকেই সে অন্যরকম ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
--লখা রে,এবার বন্ধ কর দিকিনি বই পড়া। অত পড়ে কি হবে টা কি? বাপের সাতে মাঠে কাজ করলি তো বাপটা এট্টু বাঁচে। বলেই চলে গিরিবালা।
লখা ভাবে তার বাঁচার কথা কেউ ভাবে না। সে বাঁচতে চায়।তার মাথার ভেতর কিলবিল করে দেবতোষ মাস্টারের কথা,রবীন্দ্রনাথ,শেক্সপিয়ার,পল গ্যঁগা,ম্যাক্সিম গোর্কি,বুদ্ধদেব বসু আ-র-ও অ-নে-কে।
--এ লখা, লখা রে---এ---
মায়ের চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসে সে।আকাশ এখনও পরিষ্কার হয়নি।
--কাল অনেক রেত অব্দি লম্ফ জ্বালায় রেকে কি করতেচিলি?সব ত্যালটুকুন শ্যাষ কইরে দিলি বাপ? আজ সন্দেয় আলো ছাড়া থাকবি।রেশানে কম কম তেল দিচ্চে। মা বকেই চলেছে।
--যা বাপের সাতে বাদায় যা। সেতায় মেয়ে রা ঢ্যাঁড়শ তোলতেচে।পাহারা দিবি, বাপের সাতে হাটে বেচি দিয়ে বাড়ি আসবি।হাটের ব্যাপারিরা তর বাপকে ঠকায় দ্যায়। তারপর লখার মাথায় হাত রেখে মা বলে ---বাপটার পাশে থাকলি সংসারের এট্টু আয়পয় হয়। নে নে যা খড়খড়ি উটে পড়।
বাবার পিছনে পিছনে লখা চলে বাদায়।বাবা বলে চলে কোন ফসলের বাজার দর কত।লখার কানে বেজে চলে দেবতোষ মাস্টার...
"যতবার আলো জ্বালাতে চাই
নিবে যায় বারেবারে
আমার জীবনে তোমার আসন
গভীর অন্ধকারে
যে লতাটি শুকায়েছে মূল--
কুঁড়ি ধরে শুধু,নাহি ফোটে ফুল---"
0 Comments