অখিল ঘোষের গল্প



উনিশ ঘরের নামতা 

কীরে দাদাই! গেলি কোথায় রে! বল দেখি..."

এই রে! পিলে চমকে ওঠে আয়ুষের। দাদুভাই এক্ষুণি মুখে মুখে অঙ্ক ধরবে। কঠিন কঠিন অঙ্ক, যেসব এখনও ওদের স্কুলে করানো হয় নি বা টিউশুনিতেও পড়াননি অঙ্কের স্যার। এমনকি অঙ্কগুলির বেশির ভাগই ওদের বইতেও নেই। অঙ্কের ধরণগুলোও নতুন ওর কাছে। দাদুভাইয়ের মতে, অঙ্ক তো নয়, বুদ্ধির পরীক্ষা এসব; বুদ্ধি তোমার কতটা পেকেছে তা-ই একটু যাচাই করা। আর, এগিয়ে তো একটু থাকতেই হবে। বইয়ের অঙ্ক তো সবাই পারে। বইয়ের বাইরের অঙ্ক তুমি কতটা পারছ, তাতেই বোঝা যাবে তুমি অঙ্কে কতটা চৌকস। 

অঙ্ক আয়ুষেরও প্রিয় বিষয় ঠিকই, কিন্তু তাই বলে... 

আর,শুধু 'যাচাই করা' অবধি তো ঠিক আছে, কিন্তু দাদুভাইয়ের যা চাই সেটা, অর্থাৎ চটপট সঠিক উত্তর দিতে না পারলেই হয়ে গেল। "কীরে দাদুভাই! এটা পারলি না! নাঃ, তোর ব্রেন তো ক্রমশ 'ডাল' হয়ে যাচ্ছে দেখছি! আরও ছোটবেলায় যে ইয়েটুকু তোর ছিল..., হবেই তো,খেলাধুলার দিকে ঝোঁকটা ইদানিং বোধহয় বেড়েছে...যার ফলেই...,ঠিক কিনা দাদাই?" কাচুমাচু মুখে কী উত্তর দেবে ভাবতে ভাবতে দু-তিনবার ঢোক গেলে আয়ুষ। তারই মধ্যে লক্ষ্য করে, কখন যেন মা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। আর,মায়ের চোখের চাউনিটা এসময় স্রেফ গলা টিপে দেবার চেষ্টা করে যেন। 

আর ভাল্লাগে না আয়ুষের। সারা বছর ধরে একটুও ফুরসৎ পাবার জো নেই-- টিউশানি, ড্রয়িং, ক্যারাটে, সাঁতার, ট্যালেন্ট সার্চ, বসে আঁক, রিসাইটেশন, এক্সটেম্পো, প্রজেক্ট ওয়ার্ক..., জিভ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। তার ওপর ছুটিছাটায় মামাবাড়ি এসেও যদি একই যন্ত্রণা পোয়াতে হয়, তবে তো......          

ধুস! ছড়ার বইটইগুলো আসলে কোনও কম্মের বই নয়-- মাঝেমধ্যেই মনে হয় আয়ুষের। সব 'বোগাস', নইলে এমন একটা মিছে কথা লেখে কী করে বইতে? বলে কিনা, 'মামাবাড়ি ভারী মজা কিল চড় নাই'! কীসের 'ভারী মজা', আর কীসের 'কিল চড় নাই'! আয়ুষের তো উল্টোটাই মনে হয়। কিল চড় নাই মানে? দেদার কিল চড় আছে। দাদুভাইয়ের অমন 'ব্রেন ডাল' হয়ে যাওয়ার তত্ব, আর মায়ের ওরকম হাড় হিম করা চাউনি, কিল আর চড়ের চেয়ে হাজার গুণ ভয়ঙ্কর। আর মজা? মজা তো আছে বটে। যেমন, মেজমামার আদর, দিদার প্রশ্রয় এসবের মজা তো কম নয়। মাঝেমধ্যে দিদা দাদুভাইকে ধমক লাগান, 'রাখো তো, সারাক্ষণ খালি অঙ্ক অঙ্ক করোনা তো। আয় তো দাদুভাই, বস এখেনে, পড়াটড়া রাখ এখন, ওসব বাড়ি গিয়ে করিস...' অথবা আয়ুষের মাকে বলেন, 'নে নে, নিজের বিদ্যের দৌড়টা একবার দেখিস, তারপর ওইটুকুন ছেলেটার ওপর পড়াশোনার জুলুমবাজিটা করিস...'। মেজমামা যখন দেখে, পড়ার চাপটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে, তখনই নানান অছিলায় ওকে পড়া থেকে তুলে বেড়াতে নিয়ে যায়। এসব আয়ুষ বেশ তারিয়ে তারিয়েই উপভোগ করে ঠিকই, তবে সবই কেমন যেন বিস্বাদ, জলো আর পানসে হয়ে যায়, যখনই 'ব্রেন ডাল হয়ে যাচ্ছে' ইত্যাদি শোনে। তখন মনে হয়, মামাবাড়িটা আদৌ কোনও মজার জায়গা হতেই পারে না। ওর তো ভালই লাগছে না এখন আর মামাবাড়ি থাকতে। মনে হয় আজই চলে যেতে পারলে ভাল হত। কে জানে অন্যদের মামাবাড়ি কেমন হয়। একই রকম হবে না নিশ্চয়। সবার দাদু তো আর আদ্যিকালের অঙ্কের তুখোড় মাস্টার নয় যে, পটাং পটাং করে যখন তখন অঙ্ক ধরবে, আর ঝটপট তার উত্তর দিতে না পারলে অবাক হয়ে আয়ুষের মায়ের দিকে এমনভাবে তাকাবে যে, সেই তাকানোতেই যেন তাঁর মেয়ের প্রতি, মানে, আয়ুষের মায়ের প্রতি প্রশ্ন হয়ে যায়, 'কীরে, কী হচ্ছে এসব? পড়াশোনা করাস না নাকি?' আর মা তো সেই চাউনি দেখে আঁতকে ওঠে। 'একি গুল্লু!('গুল্লু' আয়ুষের ডাকনাম) তুমি এসব পারছ না? এই সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছ না! ব্যাপারটা কী তোমার? দাঁড়াও, এবার বাড়ি যেয়ে নিই, সমস্ত খেলাধুলা তোমার বন্ধ এখন থেকে। ভালই অধঃপতন হচ্ছে তোমার। সব ওর বাবার জন্য। ছেলের পড়াশোনা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই বাবুর! কতক্ষণে আমি ঠেলে ধাক্কিয়ে পড়তে বসাবো, ততক্ষণে...! বলে কিনা পড়বে'খন! এখন তো ওদের খেলার বয়স, ওদের মতন বয়সে আমরা বইয়ের ধারেকাছেও যাইনি। তুমিই বল তো বাবা, সেই সময় আর এই সময় কি এক হল? দুটোর মধ্যে কি তুলনা চলে? এখন কত কম্পিটিশান, কত ইয়ে...

"না না না এ তো ভাল কথা নয়", দাদুভাই মায়ের কথায় প্রবলভাবে সহমত পোষণ করে, "ভাস্করের সাথে তো কথা বলতে হয় দেখছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বড় হতে হবে তো! এখন থেকেই পিছিয়ে পড়লে হবে কি করে?" 

এইসব প্রতিদিনকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। দাদুভাইয়ের মুখে 'কীরে দাদাই! কোথায় গেলি রে! এদিকে আয় তো, বল দেখি...' শুনলেই তাই আঁতকে ওঠে আয়ুষ। 

ছড়ার বইয়ের মামাবাড়ি বলতে বোধ হয় অন্যদের মামাবাড়িকেই-- মানে যেখানে অঙ্কে তুখোড় দাদুভাই থাকে না, তাকে বোঝানো হয়।

আজও বাজারের ব্যাগ হাত থেকে রাখতে রাখতেই হাঁক ছেড়েছে দাদুভাই, 'কইরে, দাদাই...'
প্রমাদ গোনে আয়ুষ।   

"বল দেখি, সাত উনিশে কত হয়?" 

সঠিক উত্তরের সন্ধানে নেমে পড়তে পড়তে আয়ুষ আবিষ্কার করে, কৌতূহলী একজোড়া অতিরিক্ত চোখ এই ঘরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে-- মা এসে কখন সামনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সাত-উনিশ...সাত-উনিশ...সাত-উনিশ... নামতাটা তো ওর জানা, উনিশ ঘরের নামতা ওর মুখস্ত কবে থেকেই, কিন্তু সাত-উনিশটা মুখে আসছে না কেন কিছুতেই! এক থেকে নয় পর্যন্ত বেয়াড়া সংখ্যাগুলো কেমন যেন এলোমেলোভাবে চোখের সামনে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করতে করতে বিরক্তিকরভাবে কিলবিল কিলবিল করে, ওদের হাজার হাজার পায়ে আঁচ্‌ড়ে-খামচে দিচ্ছে মাথার ভেতরটাতে। কিছুতেই সেগুলির কয়েকটিকে একত্রিত করে সাত-উনিশের সংখ্যাটিকে দাঁড় করাতে পারলো না আয়ুষ।      

ধীরে ধীরে দাদুভাইয়ের মুখে হতাশার চিহ্ন প্রকট হয়ে ওঠে। মা'র মুখ হয়ে ওঠে আরক্তিম। আর আয়ুষের যে কী হল, কিছুতেই ওর মুখে এল না উনিশ ঘরের নামতাটা। দাদুভাই মাথায় হাত দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন। মা কেঁদে ফেলল। আর্তনাদ করে বলতে লাগল, এই ছেলেকে নিয়ে আমি কী করি বল তো বাবা! আমার তো সব মাটি হবার জোগাড়! এর দ্বারা কি পড়াশোনা আদৌ হবে বলে মনে হয় তোমার? উনিশ ঘরের নামতা ওকে কবেই শিখিয়েছি, এখানে আসার আগে রিভিশনও দিল। আর এখন বলতে পারছে না! 

মাকে ওরকম করতে দেখে আয়ুষের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে থাকে। ওর দোষেই মায়ের কষ্ট হচ্ছে, এটা ভাবতেই একটা অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা হতে থাকে। ভীষণ অস্বস্তি বোধ হতে থাকে ওর। কিন্তু উনিশ ঘরের নামতাটা একবারও আওড়াতে পারল না কেন ও! শুধু 'উনিশ একে উনিশ, উনিশ দুগুনে--' ব্যস এইটুকুই বলতে পারল মনে মনে।

এমন সময়ে আয়ুষের বড়মামা এসে ঢোকেন ঘরে। ইনিও অঙ্কের আরেক জাহাজ। কলেজে অঙ্ক পড়ান। বড্ড গম্ভীর প্রকৃতির লোক, কঠিন অঙ্কের মতই গাম্ভীর্য তাঁর। অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ওনার সাথে এবং উনি কারও সাথে তেমন কথাবার্তা বলেন না। আয়ুষেরও কেমন ভয় ভয় করে ওনার ধারেকাছে যেতে। অবশ্য দাদুভাইয়ের মত পটাং পটাং করে অঙ্ক ধরেন না উনি। হয়ত, কলেজে পড়ানো স্যার বলেই আয়ুষের মত অত নিচু ক্লাসের ছাত্রকে অঙ্ক ধরতে প্রেস্টিজে লাগে ওনার। 

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মা আর দাদুভাইয়ের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠেন উনি। উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন-- কী হল? তোমরা এভাবে... 
সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে গম্ভীর মুখে বড়মামা বললেন, হুম্‌, সিরিয়াস কন্ডিশন! 

মা বললেন, শুধু 'সিরিয়াস কন্ডিশন' বলে দায় সারলে তো হবে না, সিরিয়াস কন্ডিশন থেকে উদ্ধার কর ওকে। 

"না না", বড়মামা বলেন, "গুল্লুর তো কন্ডিশন কিছু খারাপ দেখছিনা আমি, ও ঠিকই আছে, ওইটুকু বাচ্চার যেরকম থাকার দরকার, তারচে বরং ভালই আছে। আমি তো দেখছি, উনিশ ঘরের একটি নামতা ঠিকঠাক বলতে না পারায়, তোদের যা মুখচোখের অবস্থা, তাতে তোদের জন্যই বোধ হয় ডাক্তার ডাকতে হবে।"     

-- কি করব বল, আমার যে সব স্বপ্ন আশা আকাঙ্খা ওর উপরেই নির্ভর করে আছে! কিন্তু শুরুতেই যদি এরকম লক্ষণ থাকে, তাহলে আমার কী হবে বল তো! 

একেই বড়মামা গম্ভীর প্রকৃতির লোক, এবার মায়ের কথায় আরেকটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। আয়ুষের বুকটা দুরুদুরু করতে লাগল। না জানি বড়মামা কী ওষুধ বাৎলে দেন। হয়ত এক্ষুণি বলে উঠবেন, ঘরের ভেতর তালাবন্ধ করে ফেলে রাখ! খাওয়া দাওয়া খেলাধুলা ইত্যাদি সব বন্ধ করে দে, দেখবি সব টাইট হয়ে যাবে! কিন্তু সেসব কিছু না বলে, একটু কী যেন ভেবে বলতে লাগলেন-- আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বল দেখি, এই যে তোর স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি পূরণের সমস্ত দায়িত্ব ওর ওপর চাপিয়ে দিয়ে বসে আছিস, ওর নিজের স্বপ্নগুলোর তাহলে কী হবে? ওরও তো কিছু স্বপ্নটপ্ন থাকতে পারে।

আর বাবা তুমি-- বড়মামা এবার দাদুভাইকে পাকড়াও করেছেন-- তুমিই বা ওকে উনিশ ঘরের নামতা জিজ্ঞেস করতে গেলে কেন? আমি লক্ষ্য করছি, যখন তখন তুমি মনগড়া ভাবে ওকে প্রশ্ন ধরছ, এমনকি ওর লেভেলের অনেক ওপরের প্রশ্নও ধরে বসছ, আর উত্তর দিতে না পারলেই দুজনে মিলে ওকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করছ, ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ করছ ওর সম্মুখেই, এসব কি ঠিক হচ্ছে? 

দাদুভাই অবাক হয়ে বললেন, বাঃ রে, পরীক্ষা করে দেখতে হবে না, কতটা প্রোগ্রেস হচ্ছে কি পিছিয়ে যাচ্ছে? 

--তাহলে তুমি সেভাবেই পরীক্ষা নাও। নির্দিষ্ট দিনক্ষণ, সাবজেক্ট, সিলেবাস ইত্যাদি আগে থেকে জানিয়ে দিয়ে ওর পরীক্ষা নাও। কারণ, পরীক্ষার জন্যও মানসিক প্রস্তুত্তি দরকার। পড়ুয়া বলেই কাউকে যখন তখন প্রশ্নপত্র প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললাম পরীক্ষা দাও, তা কি যুক্তিসঙ্গত? তুমি অঙ্ক ভাল জান বলে বাজারে মাছ কিনতে কিনতে কেউ যদি তোমাকে দুটো অঙ্ক করে দিতে বলে, তখন তোমার কেমন লাগবে?  

আয়ুষের বেশ ভালই লাগছে। বড়মামার প্রতি ওর ধারনা তো একেবারে পাল্টে যাবার পথে। 

"হুট করে এসে তুমি ওকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছ, এবং না পারলে দুজনে মিলে বকাঝকা করছ, বলছ 'ব্রেন ডাল হয়ে যাচ্ছে', 'তোর দ্বারা কিছু হবে না' ইত্যাদি, এই করে ওর কনফিডেন্স লেভেলটা একেবারে ধ্বস্ত করে দিয়েছ। তোমার আওয়াজ শুনলেই ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। ওর মাথায় সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। জানা উত্তরও মাথায় আসে না তখন ওর।"

অবাক হয়ে যায় আয়ুষ। বড়মামা কী করে জানল এসব! সত্যিই তো, দাদুভাইয়ের 'কী রে দাদাই...' আওয়াজটা শুনলেই বুকটা ওর 'ধরাস' করে ওঠে! সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। আর সেসময় যদি মা সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলে তো হয়েই গেল।

"তাঁর মানে",মা বলল, "তুই বলতে চাইছিস,ও কী পড়াশোনা করল না করল, তা যাচাই করার যাবে না?"

নিশ্চয় যাবে। কিন্তু তার আগে তাকে মোটিভেট করতে হবে। কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে তাকে অবজ্ঞামূলক কথাবার্তা বললে ওর ভেতরে হীনমন্যতা বাসা বাঁধবে। সেটা না করে বরং ওর ভেতরে আত্মবিস্বাস জাগাতে হবে যে, সেও পারবে। তার প্রশংসা করতে হবে। তা না করে যদি উল্টোটা করা হয়, তাহলে যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠবে। ভাবতে থাকবে-- যদি না পারি উত্তর দিতে, না জানি কী জুটবে কপালে। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী পাভলভ থেকে শুরু করে থর্নডাইক, এমনকি আমাদের রবীন্দ্রনাথও নানাভাবে শিক্ষায় এই মোটিভেশনের ওপর জোড় দিয়েছেন। তাঁদের মতে শিক্ষার্থীকে কোনোভাবেই বিদ্রুপ করা যাবে না--"

"রাখ তো তোর ওসব তত্বকথা। তত্ব আর প্র্যাক্টিক্যালের মধ্যে অনেক ফারাক আছে, বুঝলি। তোদের পড়াতে গিয়ে আমরা কতবার মোটিভেট করেছি রে? আমাদের মাস্টারমশাইরা আমাদেরকে গরু গাধা বলদ ভেড়া নেড়িকুত্তা এসব ছাড়া তো অন্য কিছু বলে সম্বোধন প্রায় করতেনই না। পড়া দিতে না পারলে পেটাতে পেটাতে আধমরা করে ফেলতেন। কিল চড় ঘুষি কানমলা গাট্টা তো ছিলই, উপরন্তু বাঁশের কাঁচা কঞ্চি, বাতা, গাছের ডাল এসবও পিঠে পড়ত হরদম। বাড়িতেও কি কম উত্তমমধ্যম খেয়েছি আমরা? এই তোরাই কি কম মারধোর খেয়েছিস? তা তোদের কি পড়াশোনা হয় নি নাকি? সেসময় পড়াশোনার এত চাপটাপ ছিলনা, তাইতেই ওরকম করতে হয়েছে। আর এখন তো সময়টাই অনেকটা আলাদা। কী ভয়ঙ্কর কম্পিটিশন চলে এসেছে সবেতেই-"

"হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। সময়টা অনেক আলাদা এখন। তখন কাঁচা কঞ্চি, বাঁশের বাতা, কিল-ঘুসি এসব যেমন ছিল, পাশাপাশি এসব ভুলিয়ে দেবার জন্য খেলার মাঠ ছিল, ঠাকুমা-ঠাকুরদার প্রশ্রয়ও ছিল, ছিল কাকিমা জ্যেঠিমা পিসিমা এঁদের স্নেহমাখা আঁচলছায়া। আর এদের? ছোট্ট ফ্ল্যাটের চারটে  নিষ্প্রাণ দেওয়াল ছাড়া এদের আর কেউ নেই অতিরিক্ত। শুধু আছে পাহাড় প্রমাণ চাপ আর সকলের স্বপ্ন পূরণের দায়। এদের আরও অনেক অনেক বেশি করে সহানুভূতি দরকার, আদর দরকার। আর এই যে বলছ কিলচড়ঘুসি, কঞ্চি-বাতা, গাধা-বলদ-ভেড়া, এসব সত্ত্বেও আমরা মানুষ হয়েছি এটা ঠিক, কিন্তু এটাও ঠিক যে, এসবের নির্মমতায় কতজন যে হারিয়ে গেছে তার কোনও হিসেব কারও জানা নেই। আমার ছোটবেলার বন্ধু বাবুল, ক্লাস ফাইভ-এ মাস্টারমশাইয়ের রুদ্রমূর্তি দেখে একদিন বইখাতা ফেলে স্কুল থেকে এমন ছুট লাগাল যে, আর দ্বিতীয়বার স্কুলের দিক মারায়নি।  একটুখানি মোটিভেশন, একটুখানি হাসিমুখ, একটুখানি আত্মবল বৃদ্ধির সহায়তা যদি তখন থাকত, হয়ত আরও কত রত্নপ্রভায় ঝলমল করে উঠত পৃথিবী।

"আয়ুষকে দেখে আমার কিন্তু বরাবরই খুব ব্রাইট অ্যান্ড শার্প মনে হয়েছে। বুদ্ধিমান, স্থিতধী, বিনয়ী এবং পরিশ্রমী। ফাঁকি মারার টেন্ডেন্‌সি আছে বলে মনে হয়নি আমার। ওর মতন বয়সীদের থেকে ও অনেকটাই এগিয়ে আছে সবকিছুতে। কতকগুলো প্রশ্নের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর আমি ওর মুখ থেকে শুনেছি, আমি চমকে উঠেছি সেসব শুনে। হি ইজ আ ভেরি ব্রিলিয়ান্ট অ্যান্ড গুড বয় ইনডিড! আমার তো মনে হয়, এই তোমরা যেটা নিয়ে টেনশন করছ, অর্থাৎ উনিশ ঘরের নামতা ও এক নিশ্বাসে গড়গড় করে বলে দিতে পারবে। 

আয়ুষের মা, দাদুভাই, বড়মামা এঁরা গুরুগম্ভীর আলচনায় ব্যস্ত থাকতে থাকতে আয়ুষ যে এ ঘরে আছে সেকথা ভুলেই গেছে। আয়ুষও বড়মামার কথা শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মাথার ভেতর পোকার কিলবিল আর নেই, বুকের ভেতর কেমন যেন হালকা হালকা বোধ হচ্ছে। চোখের সামনে ওর উনিশ ঘরের নামতাটা গোটা গোটা অক্ষরে ভাসতে থাকে, যেন খুশিতে মাথা দোলাচ্ছে ওরা। আয়ুষ যেন ওদের নাম ধরে ধরে আদর করে ডাকছে এরকমভাবে ওর মুখ থেকে আপনা আপনিই বেরিয়ে আসে-- নয়-উনিশ--একশো একাত্তর, আট-উনিশ--একশো বাহান্ন, সাত-উনিশ--একশো তেত্রিশ, ছয়-উনিশ--একশো চোদ্দ, পাঁচ-উনিশ-- পচানব্বই.....

সবাই স্তব্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।   

সাহিত্যিক অখিল ঘোষ
 বালাকুঠি(জোড়াইমোড়), বক্সিরহাট, কোচবিহার 



     











0 Comments