লোডশেডিং
লোডশেডিং বললেই এত এত আলোর মধ্যে দপ করে নিভে যাওয়া অন্ধকারকে মনে পড়ে যায়। রাত্রির উল্টানো বাটির মতো কালো আকাশের নিচে অন্ধকারের মধ্যে তার ফারাক বিস্তর। রাত্রির আকাশে তো আর লোডশেডিং হয় না। নক্ষত্রপুঞ্জের আর চাঁদের সমন্বয়ে উন্মোচিত আকাশ-আলোকময়।
অথচ ছোটবেলায় লোডশেডিং মানে আমাদের অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে এসে দাঁড়ায়। সত্যি আঁধার হয়ে আসত মাদার গাছের তলা —সূর্যটা পুরোপুরি ডুবে গিয়ে মন খারাপের অসুখটা ছোঁয়াচে করে দিয়ে যেতো। পড়ার বই নিয়ে বসতাম ভাইবোন মিলে মুখোমুখি। সাঁঝের বেলা একটিবার তার দেখা পাওয়া যেতোই বিরক্তিকর অতিথির মত —সে হলো লোডশেডিং। আমরা অবশ্য খুশিই হতাম। হ্যারিকেন নামক যে বস্তুটি ছিল তার দুই ধারে দুজন বসতাম মাথা দুটো নামিয়ে । পড়ার চেয়ে গল্প জমতো বেশি ।আবার কার দিকে আলোর ভাগ বেশি জুটল সেই নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধতে সময় লাগতো না বিশেষ। যেন বিদ্যার দিগগজ হয়ে উঠব রাতারাতি। আবার কারোর উপর প্রতিশোধ নিতে গেলে আলোর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে পরাজিত হবার ভয়ে ওই আলো আঁধারী লোডশেডিং ছিল ভরসা।
হারিকেনের কাঁচে ফাটল ধরতো চিড় ধরার মতো। কখনো চারকোনা ছোট জানালাও তৈরি হয়ে যেত হ্যারিকেনের কাঁচের দেয়ালে ফাটল ধরার কারনে। জ্বলন্ত শিখা যখন স্তিমিত হয়ে আসত অথচ ঘড়ির সময় আমাদের পড়ার নির্ধারিত সময়ের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে টিকটিক করত তখন আবার ফানেল দিয়ে কেরোসিন তেল ভরা হত। ইনভার্টার আমাদের ছোটবেলার গ্রামের বাড়িতে ছিল বিলাসিতা। ব্যাটারিচালিত আলোই দেখেছি বহু পরে। খুনসুটি কম চলতনা আলো-আঁধারির খেলায়। ফাঁকি মারার দারুন সুযোগ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম সকলে। বাটির তলদেশ উত্তপ্ত করে অপরকে অন্যমনস্ক অবস্থায় আঁচ অনুভব করার মতো দুঃসাহসিকতার দক্ষতাও দেখানো হত ।একটি মার ওপিঠ ছেড়ে তখন নিচে পরেনি। কি সব ভয়ঙ্কর পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবুঝ বয়সের। অনতিদূরে রান্নাঘরে ফুলকো ফুলকো রুটি বানানো হতো,একপ্রকার জোরপূর্বক বায়না করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র লেচি নিয়ে রুটির মত আকার দিয়ে হ্যারিকেনের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হতো। বেশ খানিকক্ষণ অধীর আগ্রহের পর রুটির মত ছোট গোলাকার আধপোড়া স্যাঁকা বস্তুটি দেখে প্রথম সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মন নেচে উঠত। কতো যে আবিষ্কার তখনই কৃতিত্বের খাতায় জুড়ে যেত। আশেপাশে বহ্নিশিখায় নিজেদের আত্মহোমে সমর্পিত পতঙ্গদের নিষ্ঠুরের মতো চালান করে দেওয়া হতো হ্যারিকেনের ভেতর। এতকিছুর পর তবুও বৈদ্যুতিক আলোর দেখা মিলত না, সুদীর্ঘ সময় লোডশেডিং বিরক্তির সীমা পেরিয়ে।
কখনো কখনো বই ছুট হয়ে সকলে মিলে চাটাই পেতে মাটির উঠোনে লন্ঠন নিয়ে বসে পড়া হতো। রহস্যময় অন্ধকার আকাশে চিনতাম কোনটা কালপুরুষ, কোনটা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো সপ্তর্ষি মন্ডল ,কোথায় আছে সন্ধ্যাতারা। অজানা রহস্যাবৃত টিম টিমে তারায় ভরা আকাশ আমাদের চোখের সামনে উল্টে দিত নিজেকে। গোলাকৃতি বা অর্ধগোলাকৃতি চাঁদের চারিপাশে ভাসমান মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে আসতো। আমরা তাই বইয়ের পাতায় জানার অনেক আগেই জেনেছি কালপুরুষের বেল্ট কুকুর আর জিজ্ঞাসা চিহ্নের সপ্তর্ষিমণ্ডল।
মাঝে মাঝে গুম মারা গরমে অতিষ্ঠ হত প্রাণ। তালপাতার হাতপাখা ছিল আরামের সঙ্গী। কপাল মন্দ হলে সেই অতিষ্ঠতা চলত ঘন্টা খানেক এরও বেশী । বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই— দুমদাম বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তিকর অতিথি লোডশেডিং অন্তত একটা গোটা দিন আমাদের পীড়ন না দিয়ে ছাড়তো না। সকাল থেকে উপদ্রব সহ্য করলেও সন্ধ্যে হতেই আমরা বসে পরতাম জানালার ধারে। কালো কালো গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি মারত, মাঝে মাঝে দুটো একটা পাখি উড়ে যেত এডাল থেকে ও ডালে— কচ্চিৎ কদাচিৎ তাওদেখা যেত। আর প্রতিবারই একটাই ছড়া কিশলয় থেকে উঁকিমারত" ফুটফুটে জোছনায় জেগে থাকি বিছানায় /,বনে কারা গান গায় গুনগুন গুনগুন"
তারপর মহামান্য কারেন্টের দেখা মিলতেই ঘরে ঘরে আলোর আলোড়ন উঠত হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতো।তাও তার স্থায়িত্ব হতো বেশ কয়েকবার 'ধরা তো দেবনা' ধরনের লুকোচুরি খেলার পর।
এখন আমাদের ঘরে ঘরে বিকল্প বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা। কালপুরুষ সপ্তর্ষিমণ্ডল নিজেরাই রাত জেগে দিনের আলোয় ঘুমিয়ে পড়ে। বই খুঁজে দেখতে হয় তাই। রাতের আকাশ হাতছানি দেয় না আর। লন্ঠন বা হ্যারিকেন এখন পথচলতি অবজ্ঞাময় গুমটি দোকানের আশ্রয়ে। লোডশেডিং হারিয়ে গেছে আঁধার এর মধ্যেই। এতো এতো আলোয় আমরা তাও মাদার গাছের তলা খুঁজি, বাঁশ বাগানের মাথায় উঁকি মারা চাঁদ মামা খুঁজি, শুকতারা দেখতে চাই,আসলে আমরা নিজেরাও আগের মত নেই— পাল্টে গেছি বদলে গেছি। লোডশেডিং এর মাহাত্ম্য বোঝার মনের অভ্যন্তরে এখন সত্যিই চিরকালীন লোডশেডিং ঘটেছে।।
1 Comments
রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি আর নস্টালজিয়া ধরা পড়েছে সুন্দরভাবে আর মনের মণিকোঠা চকচক করে উঠলো পুরোনো স্মৃতির ঝলকানিতে। কিশোর মনকে প্রশ্রয় দেওয়ার কাহিনী লোডশেডিং। বেশ ভালো।
উত্তরমুছুন