সদানন্দময়
মানুষটা এককথায় সাদামাঠা। তবে ঠিক মেঠো নয়।একটা শহুরে ছাপোষা ছাপ আছে।হাফ হাতা জামা,সাদা জামা।একটু ঢোলার দিকে একটা গাঢ় রঙের ট্রাউজার। হাতে ঘড়ি।বুক পকেটে পেন গোঁজা।মুখে দুচার দিনের না কামানো দাঁড়ি।মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল।চোখে একটা পুরু লেন্সের চশমা হলেই বেশ হত।কিন্তু উনি চশমা পড়তেন না।খুব ধীরেসুস্থে কথা বলতেন।থেমে থেমে।আমাদের মাষ্টারমশাই।সদানন্দময় বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ জোড়া মনখারাপের রঙ লেপে দেওয়া মানুষটা আমাদের ক্লাস সিক্সের ইংরাজি পড়াতেন।ক্লাস সেভেনের ইতিহাস।ক্লাস ফাইভে বিজ্ঞান আর নাইন টেনে পিটি করাতেন।আদপে উনি কোন বিষয়ের স্যার বুঝতে পারতাম না।আমরা যারা মেধা আর বেঞ্চে সর্বদা মাঝের দিকে থাকতাম,তাদের সাথে স্যারেদের বিশেষ একটা চেনা জানা হয়ে উঠত না।মূলত স্যারেরা দুধরণের ছেলেপিলেকেই বেশি চিনতেন,এক,যারা শেষ বেঞ্চের লাইফটাইম মেম্বার,টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের পাঁচিল ডিঙিয়ে পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে সোজা সিনেমা হলের দুপুর শো এর কিসব সিনেমায় মাতোয়ারা আর দুই,যারা,বিজ্ঞানে একশোয় আটানব্বই আর অংকে নিরানব্বুই পাওয়ার শোকে ডিপ্রেশন এ চলে যেত তারা,যাঁদের হাতে আগামী বিশ্বের বিজ্ঞান শান্তি পাবে খানিক।বাকি থাকত,আমাদের মত একঝাঁক কালো কালো মাথা।যারা শহরের নাম করা স্ট্রিট আর এঁদো গলির মাঝে,নাম না জানা চুন সুড়কির রাস্তা,যেগুলো থাকার সাথে এ সভ্যতার নাম বদনাম কিছুরই সম্পর্ক নেই।
সদানন্দময় বাবু ছিলেন অজাতশত্রু মানুষ।মিতবাক তো বটেই সঙ্গে মিতভাষীও।পরীক্ষায় কড়া গার্ড দেওয়ার দুর্নাম ছিল না কোনওকালে।আবার তুখোড় পড়িয়ে ক্লাসে ধোঁয়া বের করে দেওয়ার এলেমও ছিল না বিশেষ। বেশ একটা চলছে চলবে গোছের, গা সওয়া ধরণের ভদ্রলোক। কেমন একটা নির্লিপ্ত মনখারাপ বয়ে বেড়াত লোকটা।তবে মানুষটার একটা দুর্ধর্ষ গুণ ছিল,তা হল হস্তি সদৃশ স্মৃতিশক্তি। প্রত্যেকটা ছাত্রকে শুধু মুখ চেনাই নয়,নাম ধরেও চিনতেন।ক্লাস ফাইভের ফার্স্টবয় সমীরণ থেকে ক্লাস টেনের মারকুটে সেমি ডাকাত বাপন পর্যন্ত সবাইকে চিনতেন।আরও চমৎকার ব্যাপার ছিল,উনি নামের সাথে রোল নাম্বারটাও মনে রাখতেন।
'ক্লাস টেনের সোমনাথ চৌধুরীর রোল নাম্বার কত সদানন্দ?'
'আজ্ঞে স্যার টেন এ না বি?
এ হলে দুই আর বি হলে সাঁইত্রিশ '
এভাবেই আকস্মিক প্রয়োজনে মুশকিলআসান হতেন চলতা ফিরতা স্টুডেন্ট ডেটাবেস।
সেবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার টেস্ট চলছে।সেদিন ফিজিক্স।পাথরের মত শক্ত প্রশ্নের আঘাতে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে মেধাবী মাথাগুলো।আর আমরা যারা মধ্যমেধার চাষি তারা ফিজিক্সের হড়কা বানে তলিয়ে গেছি,ভেসে ওঠার সম্ভবনা নেই বললেই চলে।পরীক্ষা হলের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ গোলযোগের চেহারা নিচ্ছে ধীরে ধীরে।প্রশ্ন করেছেন ফিজিক্সের তরুন তুর্কি তাপসবাবু।'সিলেবাসের বাইরে,সিলেবাসের বাইরে!'বলে হঠাৎ রব উঠল।হইচই।একেক করে সব ছেলেরাই ক্ষোভ প্রশমনের অব্যর্থ চেষ্টায় সামিল।আমিও মুখ লুকিয়ে দু একবার চিৎকারের কোরাসে কিছু তাল ঠুকলাম।
পরীক্ষার ইনভিজিলেটর,সেদিন সদানন্দময়বাবু।আঠারোর উদ্দামতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাঁর ছিল না,এ বলাই বাহুল্য। 'তোমরা চুপ করো।কথা বলো না,এগুলো ঠিক না!'এই ধরণের নিরীহ বাক্যে সেদিন ছাত্র ভিজবার নয়।
'কী হাঁ করে তাকিয়ে আছিস!নে এগুলো টুকে নে!'
পিছন থেকে চারচৌকো একফালি কাগজ এগিয়ে দিল,স্বপন।এটাকেই চলতি কথায় টুকলি,চোতা,পাতা ইত্যাদি বলে এ আমি জানতাম বিলক্ষণ। দেখি আণুবীক্ষণিক হরফে সবকটা অংক করা রয়েছে।একদিকে অর্ধেক ঘর,হই হট্টগোল করছে।যেকোনও সময় হেডস্যার আসবেন,নিশ্চিত।সবার অলক্ষ্যে আমার হাতে 'চোতা',অংক কটা খাতায় কপিপেস্ট করতে পারলেই,পাশ করে যাব কোনওমতে। জীবনে প্রথমবার। হাত কাঁপছে ঠকঠক করে।সবে টুকতে শুরু করেছি,খাতার উপর একটা ছায়া এসে পড়ল।মুখ তুলে দেখি আমারই সামনে দাঁড়িয়ে সদানন্দময়বাবু।নাহ্,ভয় পাইনি।কিন্তু স্যারের চোখে যা ছিল,তাকেই ঘৃণা বলে।অন্য সদানন্দময় সামনে ছিলেন।কিচ্ছু বললেন না,শুধু বললেন,'ছিঃ!'টুকলির টুকরো নিয়ে স্যার নিজের জায়গায় ফিরছেন,এমন সময় উল্কার মত হাজির হলেন হেডস্যার,শান্তিবাবু।আজ যে অশান্তির ভারি ঝড় বয়ে যাবে এটা ভেবেই কেঁপে উঠলাম।সদানন্দময়বাবুর হাত থেকে ছোঁ মেরে কাগজের টুকরোটা প্রায় কেড়েই নিলেন হেডস্যার।'বাহ্,এ যে মোস্ট আনপ্রেডিক্টটেবল্,আমার স্কুলের সায়েন্সের ছাত্ররাও টুকছে তাহলে!'বাজ পড়লেও এর চেয়ে কম শব্দ হয়।হেডস্যারের ধমকে মনে হল,আজকেই আমার মৃত্যুদিন।নির্ঘাত আমায় স্কুল থেকেই তাড়িয়ে দেবেন স্যার আর বাবা বাড়ি থেকে।'ভাই,কী হবে রে? আমায় টুকলিটা সাপ্লাই করেছিল,বিল্টু,বিল্টুকেও কে একটা দিয়েছে! সবাই ফাঁসলাম!'পিছন থেকে ফিসফিসিয়ে আরও চাপ বাড়াল স্বপন,আমার পাপের অংশীদার। আমার কথা বলার সাহস,শক্তি কিচ্ছু নেই।জিভে,দাঁতে,শ্বাসনালীতে বনধ্,ডেকেছে।শব্দ আসছে না।কথা জড়িয়ে একাকার।হাত পা ঘামছে।হেডস্যার রাগলে মঙ্গলের কোনও আগ্নেয়গিরি ফেটেও পড়ে কিনা জানিনা!
'এটা কার কাছ থেকে পেলে সদানন্দ?'হেডস্যারের জেরার মুখে সদানন্দময়বাবু।'বলো সদানন্দ,তুমি সবার নাম,রোল, হাতের লেখাও চেনো।'স্যার ইতস্তত করছেন।বেশ বুঝতে পারছি ভীতু গোছের সত্যনিষ্ঠ সদানন্দময় স্যারের মুখের কাছেই আমার নামটা ঘুরছে।আর হেডস্যারের পেনের ডগায় আমার চিরবিদায়ের চিরকুট। টিসি।শহরের পয়লা নম্বর স্কুলের সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্র টুকলি করবে! হেডস্যার ভাবতেও পারেন না।ক্ষমতা থাকলে,ফাঁসি দিয়ে দিতেন,আর টিসি দেবেন এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
'স্যার মেঝেয় পড়েছিল।আমি কুড়িয়ে পেলাম!'সদানন্দময়বাবু প্রতিষ্ঠিত সত্যবাদী বলে খ্যাত।তাঁর কথা হেডস্যার মানলেন।'কিন্তু হাতের লেখাটা কার,ভালো করে দেখে বলো,কান টানলেই মাথা আসবে,টেস্ট এ কী করে পাশ করে দেখবো, সবকটাকে ঘাড় ধরে তাড়াব।'
'স্যার,এত ছোটো হরফে লেখা,চেনা মুশকিল!আরও কিছুক্ষণ গর্জন করে শেষমেশ চলে গেলেন হেডস্যার।হেডস্যারের মিশাইলের সামলে ছাত্রদলের সম্মিলিত ক্ষোভ চুপসে গেল।আমার চোখে জল।সদানন্দময়বাবুর চোখে করুণা।
উচ্চমাধ্যমিক দিতে পারলাম।পাশও করলাম কোনওমতের চেয়ে কিছু বেশি পেয়ে।মার্ক্সশিট হাতে প্রথমেই সদানন্দময় স্যারের সামনে।মার্ক্সশিট দেখানোর চেয়ে কৃতজ্ঞতা দেখানোর তাগিদ বেশি ছিল সেদিন।প্রণাম করলাম।স্যার মাথায় হাত রাখলেন।'স্যার আপনার জন্যই পরীক্ষাটা দিতে...'
'ছাড়ো ওসব কথা!'মাঝপথে থামালেন স্যার।বললেন,'মানুষ হও!'
২
আজ অফিসে বিশেষ একটা কাজের চাপ নেই।নিজের কেবিনে বসে আছি।স্কুল পাশ,কলেজ পাশ করে,সেই মধ্যমেধায় ভড় দিয়েই আমি সরকারি অফিসার।আমার যতটা সফল হওয়া উচিত ছিল,তার চেয়েও বেশ কয়েককদম এগিয়ে এসেছি আমি।স্ত্রী পুত্র আর কাজ নিয়ে জমাটি আয়োজনে বেঁচে নিচ্ছি জীবন।
নধরকান্তি ঠিকাদার হিমেশ বাজোরিয়া ঠিক আধ ঘন্টা ধরে আমার সামনে প্রায় হাতজোর করেই বসেছিল।কাজ মিটিয়ে এই মাত্র বিদায় নিয়েছেন।আমিও বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছি।টুকটাক ফাইল পত্রের হিসেব শোধরাচ্ছি।
'স্যার এক ভদ্রলোক দেখা করতে চাইছেন।'আপ্তসহায়ক ছেলেটি খবর দেয়।কম্পিউটার থেকে মুখ না সরিয়েই বললাম,'বলে দাও ব্যস্ত,পরে আসতে!'
'স্যার, বললাম,'সাহেব ব্যস্ত আছেন,উনি বলছেন উনি নাকি আপনার মাষ্টারমশাই,বড় দুঃসময়ে এসেছেন,ওঁর ছেলের ক্যান্সার, একটা হেল্প চাই..!'
স্বাভাবিক ভাবেই অবাক হলাম।সিসিটিভি মনিটরে তাকালাম।ভিজিটরস রুমে,বসে আছেন সদানন্দময় স্যার।পনেরো বছরে চেহারায় আরও মলিনতা চেপে বসেছে।বয়স আর বিষাদ এর ছাপ অভাবের রেখাও এঁকেছে যেন!
কোলাজের মত ফেলে আসা স্কুল জীবনের প্রতিটা পরত দেখতে পেলাম।আমার উচিত ছিল,ছুটে গিয়ে স্যারকে আমার কেবিনে নিয়ে আসা।আপ্যায়নের ত্রুটি করা আমার মহাপাপ।কিন্তু আমি যেতে পারলাম না।পা দুটো ভারি হয়ে উঠল।স্যারের শেষ দুটো কথা,'মানুষ হও!'কুন্ঠার মত কানে বাজতে থাকল।
পার্সে যে কটা দুহাজার টাকার নোট ছিল,বের করে গুনলাম,পুরো দশহাজার।'ওঁর হাতে দিয়ে বলো,স্যার বেরিয়ে গেছেন,ফোনে বললেন আপনাকে এটা দেওয়ার জন্য,আর হ্যাঁ ওঁকে বলো,আমি প্রণাম জানিয়েছি!'
নাহ্!স্যারের সামনে যেতে পারলাম না।সেদিন সেই ছেলেটা যে সামান্য টুকলির টুকরোর ভারে ন্যুয়ে গিয়েছিল।সে আজ রোজ টুকলি করে।বাজোরিয়ার বিলটা পাশ করায়,সে ওয়ান পারশেন্ট, একলাখ টাকা এইমাত্র দিয়ে গেছে।
আমি স্যারের সামনে ভয়ে যাইনি।যদি স্যার আবার বলেন,'মানুষ হও!'
মানুষ যে আমি হতে পারিনি স্যার!
'স্যার,উনি বললেন উনি টাকার জন্য আসেননি।' আপ্তসহায়ক ছেলেটি টেবিলের উপর টাকা কটা নামিয়ে রেখে গেল।
সিসিটিভিতে দেখলাম,স্যার চলে যাচ্ছেন।মাথা হেঁট।
আমারও।
0 Comments