স্মৃতির ঝাঁপি
কেমন আছো বন্ধুরা? ভালো তো? প্রথমেই তোমাদের জানাই শুভ বিজয়ার প্রীতি,শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। যদিও করোনা ভাইরাসের দৌলতে ঘটা অতিমারির প্রকোপে এবছরের পুজোটা সেইভাবে আমরা মজা করতে পারিনি এখনকার কথায় এনজয় করতে পারিনি তবুও পূজো তো পুজোই না- বচ্ছরে একটিবার মা দুগ্গা কৈলাস থেকে ছেলেপিলেকে নিয়ে আসেন তার প্রিয় বাপের বাড়ি- তাই সাবধানতা অবলম্বন করে আনন্দ তো করতেই হয় তাই না?
যদি আমাদের ছোটবেলার কথা বল তাহলে বলবো যে,আমাদের ছোটবেলায় এই দুগ্গা পুজোর সময় কিন্তু ভারী মজা হত। আমরা সরকারি আবাসন এ থাকতাম তোমরা যাকে বল হাউজিং কমপ্লেক্স। নামে জটিলতা থাকলেও(কমপ্লেক্স) এখানকার জীবন ছিল অতি সহজ সরল। আমার কত বন্ধু ছিল। সকলে মিলে একসঙ্গে খেলতাম। আর যেই না শরৎকালটি পড়তো, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের পানসি ভেসে বেড়াতো আর মাঠে কাশফুলগুলো হাওয়ায় দুলতো অমনি পুজো পুজো গন্ধে আমাদের মনটা নেচে উঠতো। কাঁচা সোনা রোদ গায়ে মেখে, শিউলিফুলের মল পায়ে পড়ে আর পদ্মের কাঁকনে হাত সাজিয়ে সমস্ত প্রকৃতিটাই যেন আমাদের ঘরের মেয়ে 'উমা' হয়ে উঠতো।আমাদের আবাসনটি যেহেতু অনেক বড় ও তাতে প্রচুর মাঠ,গাছ ও একটি পুকুর ছিল- তাই শহুরে পরিবেশে থেকেও কোনো রকম প্রকৃতির পাঠ থেকে আমরা কখনো বঞ্চিত হইনি। আমাদের আবাসন ছিল আমাদের কাছে- 'ছায়া সুনিবিড়- শান্তির নীড়'।
পুজো শুরুর দেড় মাস মত আগে বাবা ও বাবার বন্ধু কাকুরা পুরো আবাসনের বাড়ি ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলতে আসত, তখনই মনে মনে আনন্দ বইতো এইবার পুজো আসছে।পুজো শুরুর এক মাস আগে বাঁশ পরত আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে কারণ ওখানেই যে মণ্ডপটা হত। সেই পড়ে থাকা বাঁশগুলো ধীরে ধীরে মণ্ডপের কঙ্কাল গড়ে তুলত। আমরা যেতে-আসতে মন্ডপের জন্য বাঁধা বাঁশ ধরে দোল খেতাম। তারপর ধীরে ধীরে কাঠামো গড়ে উঠত।সারা দিনরাত কারিগরদের ঠোকাঠুকির আওয়াজ মনকে ভরিয়ে রাখত। আনন্দে বন্ধুরা মিলে জটলা করতাম- এবার প্যান্ডেলটা কি কায়দায় হবে? কতটা উঁচু হবে?প্যান্ডেলের কিরকম রং হবে? ঠাকুর কেমন হবে ইত্যাদি ইত্যাদি নানা রকম বিষয়ে।
আবাসনের প্রত্যেকটি বাড়িতে চতুর্থীর দিন থেকে হলুদ বাল্বের চেন ঝুলানো শুরু করত ডেকোরেটরের লোকেরা- ঘরের জানালা দিয়ে সে দৃশ্য দেখে আর কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারতাম না জানো। সেদিনই রাত্রে বাবা, সব কাকুরা আর পাড়ার বড় বড় দাদারা মিলে যেত প্রতিমা আনতে। লরিতে হইহই করে প্রতিমা নিয়ে আসতো যদিও দুগ্গামায়ের মুখ ঢাকা থাকতো তবুও আমরা হুল্লোড় করে ছুটতাম মূর্তি দেখার জন্য। মূর্তি দেখে আর আমাদের আনন্দ দেখে কে? ব্যস আমাদের পুজো শুরু হয়ে যেত এভাবেই।
কার কটা জামা হল? জুতো হলো? এসবের ধার আমরা ধারতাম না- পুজো মানেই আমাদের আবাসনের আলোয় সেজে ওঠা, গাছে গাছে সবুজ টিউবলাইট,পুকুরের চারপাশে জ্বলা নেভা টুনির কারুকাজ আর প্রত্যেকটি বাড়ির মাথা থেকে নিচ অবধি ঝোলানো বাল্বের চেন আর কয়েকটা হ্যালোজেন, একটা বড় মন্ডপ কারুকাজ করা আর চোখ জুড়ানো দুর্গা প্রতিমা- এতেই আমাদের আবাসন সুন্দরী হয়ে সেজে উঠত আর আমাদের পুজো হয়ে উঠত জমকালো অবশ্য এখনকার মতো চমকানো নয় আর থিমের চমক তো একেবারেই নয়।
পুজোর ষষ্ঠীর দিন থেকে হাতে একটা করে বন্দুক আর তাতে ভর্তি ক্যাপ নিয়ে,নতুন জামা পড়ে মন্ডপের চারিধারে ঘুরে ঘুরে বন্ধুরা মিলে চোর-পুলিশ খেলা -উফ! আজও আমি ভীষণভাবে মিস করি জানো বন্ধুরা! মণ্ডপের সামনে চেয়ার পেতে গোল করে বসে আড্ডা মারা ঘন্টার পর ঘন্টা, কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট পার্স থেকে পয়সা বার করে বন্ধুরা মিলে ফুচকা, চুরমুর, আলু কাবলি, পেপসি খাওয়া,মাঠের মধ্যে বেলুন কিনে সকলে মিলে খেলা করা-কয়েকদিন মায়ের বারণ নেই, বাবার বকুনি, দিদিদের চোখ রাঙ্গানি নেই -শুধু আনন্দ আর আনন্দ। দিদিরাও পাড়াতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাত করে ঘরে ঢুকছে যখন ঢুকছে আমায় ডেকে নিচ্ছে- ততক্ষনে সেদিনকার যত আনন্দ করার অলরেডি করে নিয়েছি।বাড়ি গিয়ে কোনরকমে দুটো খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে যেত- তবুও ঘরের অন্ধকার দেওয়ালে বাইরে থেকে আসা ঝুলন্ত ও দুলন্ত বালবের আলো ও রাস্তার লোকজনের আওয়াজ একটা আলো-আঁধারির মায়াজাল তৈরি করত, আর সেদিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘোর লেগে ঘুমিয়ে পড়তাম।
অষ্টমীর অঞ্জলি, ভোগ প্রসাদ খাওয়া,সন্ধি পুজো, নবমীতে ধুনুচি নাচ,মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও শঙ্খ বাদন(মোমবাতি জ্বালানো ও শাঁখ বাজানো) প্রতিযোগিতা হত,জানো বন্ধুরা মোমবাতি প্রজ্জ্বলন এ মোটামুটি একটা প্রাইজ আমার বাঁধা ধরা ছিল আর সেই পুরস্কার দেওয়া হতো কালিপুজোর সময়। ছোটবেলায় পুজোর জোগাড়ের কাজে বেশি অংশগ্রহণ করতাম না বটে তখন খেলাধুলোটাই মুখ্য ছিল, যখন একটু আধটু বড় হতে লাগলাম মানে এই এইট নাইনে উঠলাম তখন থেকে আমরা বন্ধুরা পূজোর কাজে হাত লাগাতে লাগলাম। ভোরবেলায় উঠে মন্ডপে বসে কত কাজ করা, ফল কাটা হইহই করে চলত সব- অন্যসময় মা বললে,বাবা ডাকলেও ভোরে ঘুম ভাঙতেই চাইতো না আর পুজোর সময় তো বলতেই হতো না সকালে উঠে যেতে হবে বলে যেন রাতটা কাটতেই চাইতোনা,চোখে যেন ঘুমই আসতো না।
দশমীর সকালটা বন্ধুরা মিলে গল্প-আড্ডায় কাটাতাম। পরবর্তীকালে দশমীর দিন সকালে আমাদের সকল আবাসিকবৃন্দকে আবাসনের কমিউনিটি হলে একটা ভোজ খাওয়ানোর ব্যবস্থা হল যা এক কথায় অনবদ্য এবং এখনও যা চালু রয়েছে।সন্ধ্যেবেলায় একটা ছোটখাটো ফাংশন হত। আর মেন ফাংশনটা হত কালীপুজোয়।
এইভাবে এসে পড়ত একাদশী- এবার ঠাকুর বরণ এর পালা আর বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠা। কারণ আমাদের ঠাকুর দশমীতে ভাসান যেত না একাদশীতে যেত।অনেক বড় শোভাযাত্রা করে আমাদের ভাসান হত।লরি করে মা দুর্গা ও তার চার ছেলেমেয়েকে সারা আবাসন ঘোরানো হত।একেক সময় আমরা সাজতাম ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক সাজে বা অরণ্যবাসী অথবা অন্য কোন সাজে।এই শোভাযাত্রায় আবাসনের ছোট বড় সকলে অংশগ্রহণ করতাম,চোখের জলে মাকে বিদায় জানাতাম একসঙ্গে সকলে মিলে।আর তারপর জানো তো ভাসান থেকে ফিরে অন্ধকার মন্ডপের ভিতরে মাটির প্রদীপের টিমটিমে আলো, এক ঘট গঙ্গাজলকে সাক্ষী রেখে বোঁদে আর কোলাকুলি দিয়ে শুভ বিজয়ার সূচনা হত।মন ভীষণ খারাপ হয়ে যেত সেদিন-আজ একথা লিখতে বসে দুঃখ হচ্ছে, কারণ আমিতো এখন আর আবাসনে থাকিনা বিবাহসূত্রে বাইরে থাকি আর বাবা মা গত হয়েছেন বহুদিন। এছাড়া এইতো কিছুদিন হল দুর্গাপূজো শেষ হয়েছে, আমাদের সকলেরই খুব মন খারাপ তাইনা বন্ধুরা?
দুঃখের মধ্যে দিয়ে যে মহা আয়োজনের সমাপ্তি ঘটত, পরদিন থেকে ঘরে ঘরে নাড়ু নিমকি ভাজা,বিজয়া দশমীর প্রণাম, সকলের সঙ্গে সকলের দেখা করে বিজয়ার শুভ কামনা জানানো,বাড়িতে অনেক আত্মীয়র বিজয়া সারতে আসা এবং একই কাজে মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে যাওয়ার আনন্দে সেই দুঃখ কিছুটা হলেও কমতো আর ফিরে এসে আবার ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো- আমাদের বাড়িতেও, সকলেরই সকলের বাড়িতে নিমন্ত্রণ -খিচুড়ি খাবার, ফলে আবার শুরু হতো হইচই - যা আনলিমিটেড চলতেই থাকত।
এর মধ্যেই শুরু হয়ে যেত কালীপুজোর ফাংশনের মহড়া নাচ-গান নাটক-আবৃত্তির যা একেবারে শেষ হতো ভাইফোঁটার রাতে একগাদা মামাতো মাসতুতো পিসতুতো জারতুতো খুড়তুতো দাদাদের উপহারের সম্ভারে কারণ আমি ছিলাম বাড়ির সবচেয়ে ছোট বোন তাই প্রাপ্তির ভান্ডারটা সবচেয়ে বেশি পূর্ণ হতো আমারই। ফলে পুজোর ছুটিটার একমাস থাকতো জমজমাট আনন্দ ভরা- যা আজও আমার মন ভরিয়ে রাখে। আজকাল তো সবাই এই পরিবেশ পায় না- তাছাড়া এখন প্যান্ডেলের সামনে দলবেঁধে আড্ডার চেয়েও প্যান্ডেল হপিং আর 'মুখবই'তে তার মেকি বিজ্ঞাপনী প্রচারে লোকের আগ্রহ বেশি।তবুও জানি তোমরা ছোট,তোমাদের কাছে পুজোর আনন্দটাই আসল আর সব কিছুর চেয়ে আর তাইতো আজও ইচ্ছে করে তোমাদের সঙ্গে ছোট হয়ে সেই ছোট্টবেলাকার আনন্দটা আবার উপভোগ করি।তাইতো আমি তোমাদের বন্ধু বলেছি, তোমরা আমায় বন্ধু করে নেবে তো ? বলো ? তাহলে তোমাদের পূজো তোমরা কিভাবে কাটিয়েছো আমায় জানিও বন্ধুরা কেমন? কোথায় জানাবে?? কেন,আকাশের ঠিকানায়- চলো সবাই খাতা পেন নিয়ে বসে মনের দরজা জানলা গুলো খুলে দাও- বেরিয়ে আসুক মনের গহীন অন্ধকার থেকে তোমাদের আনন্দের স্মৃতিগুলো, ডানা মেলে উড়ে বেড়াক আকাশের ঠিকানায়।ভালো থেকো বন্ধুরা,অনেক ভালোবাসা...
0 Comments