অনিন্দ্য দত্ত'র গল্প


নিবারণের মাছ

জ থেকে মাত্র একবছর আগেও নিবারণ সাপুঁই ছুটির দিনে মাছ ধরতে যেত। নিবারণের একটা মাঝারি মুদির দোকান আছে। হপ্তার ছয়টা দিন সে সেটা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে।সততা জন্য তার সুনাম আছে,তাই তার দোকানে ভীড় লেগেই থাকে। কিন্তু,রবিবার তার দোকান বন্ধ থাকতো,কারণ ফি হপ্তায় সে তার ছিপ,চার আর বিধবা দিদি জয়ার বানানো পরোটা,তরকারি নিয়ে সারাদিন এর জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যেত।আর সন্ধ্যায় মাছ নিয়ে ফিরে দিদিকে ঠেসে ঝাল দিয়ে গরগরে মাছের ঝোল বানাতে বলতো।
নিবারণ বিয়ে করেছিলো,কিন্তু বউ মালতী মাত্র তিন বছরের মাথায় আন্ত্রিকে মারা যায়।
বিয়ে আর করেনি নিবারণ।
দিদি বারে বারে বল্লেও সে জবাব দিয়েছে,"সংসার মায়া রে দিদি, মায়া,পদ্মপাতায় জল,টলমল, ছলমল।আর মায়া বাড়িয়ে কি হবে বল"..আসল কথা,নিবারণ একটু অলস মানুষ। বউ, ছেলেমেয়ে,ভগবান যখন তার কপালে লেখেননি,তখন থাক না,এটাই তার মনোভাব। দোকান সে একদিন বাপ মরা ভাগনে প্রবীর কে লিখে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবে। তার মাঝে পড়ুক না প্রবীর তার যত খুশি।প্রতিবার প্রবীর ফাস্ট,সেকেন্ড হয়ে ক্লাসে ওঠে, সাত ক্লাস হয়ে গেল তার।
যাকগে,আসল গল্পে ফেরা যাক।বেশ বাদলা ছিলো সেদিন,শহরে কে একজন নেতা মারা যাওয়ায় পার্টির ছেলেরা এসে শোক পালনের জন্য বাজার বন্ধ করে দিলো।
নিবারণও আর বাড়ি না ফিরে গুটি গুটি ছিপ,চার আর দুপুরের খাবার টিপিন কারী নিয়ে লোকাল ট্রেনে  চেপে বসল।

লোকাল ট্রেন,তাও দুপুরের গাড়ি।হাঁপাতে হাঁপাতে তিন স্টেশন পরে তারাপুরে প্রায় ঘন্টাখানিক পরে নিবারণকে নামালো। এই তারাপুরে মন্ডল দীঘি বলে নাকি একটা মস্ত দীঘি আছে।সেটা নাকি,একেবারে  মাছে টইটম্বুর। হদিসটা সে পেয়েছিলো ঈশ্বরীতলার বুড়ো ঘাগু মাছমারা দীনেশ নাথের কাছ থেকে।আর দীনু দাদার খবর যে একেবারে অব্যর্থ হবে,সেটা এ দিগরে সকলেই জানে।

দীঘিটা দেখেই মনটা নেচে উঠল নিবারণের।মস্ত বড়, শান্ত,বাতাসে তিরতির করে জল কাঁপছে। আর জলে মাছের ঘাইএর গোল গোল চক্করে একেবারে ভরপুর। এদিক,ওদিক দেখে একটা পাকুড় গাছের ছায়ায় ঠেস দিয়ে সে বসে পড়লো। একটা জুতসই ডাল কুড়িয়ে  পেয়ে ছিপটা তাতে ভর দিয়ে জলের একেবারে কাছে রেখে, বঁড়শিতে কেঁচো গেঁথে ফাতনা জলে নামিয়ে  দিলো, টুপ করে ঢুবে গেল বঁড়শি। নিবারণের ছিপ হেঁজিপেঁজি নয়,একেবারে কলকাতা থেকে আনানো উইলসনের দোকানের জিনিস, হুইলে সাতশো ফুট সুতো ধরে,বড় সাধের সামগ্রী। এইবার ডুবে যাওয়া  ফাতনা পানে চেয়ে অপেক্ষার পালা শুরু, বড় মধুর এ অপেক্ষার সময়। বোধহয়  দশ মিনিটও যায়নি ছিপে টান পড়লো। কিছু  একটা বঁড়শি মুখে করে ক্রমশ  নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, আর হুইলের সুতোও সরসর করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ করেই থামলো হুইল,নিচের মাটি পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে শিকার!প্রায় তিরিশ সেকেন্ড লাগলো নিচে যেতে,এই থেকেই নিবারণ দীঘির গভীরতা আন্দাজ করলো।কিন্তু,আর কিছু  হয়না কেন? বঁড়শি মুখে করে একজায়গায় ও দাঁড়িয়ে আছে কি কোরে?
তারপরই নিবারণের চক্ষুস্থির করে হুইলের সুতো সরসর করে উল্টোদিকে গোটাতে শুরু করলো, যা কিছুই হোকনা কেন, সেটা টোপ মুখে জলের উপর  উঠে আসছে!!

হঠাৎ,নিবারণ দেখলো জলের উপর  হাজার হাজার মাছ মাথা তুলে তাকে দেখছে। রুই, কাতলা,কালবোস, পুঁটি,ট্যাংরা,চিতল,ভোলা, চাঁদা,বাঁশপাতা, শিং,মাগুর সবাই আছে সেখানে,তাদের প্রতিটাই ক্রদ্ধ,নির্মম চোখে চেয়ে আছে তার পানে,প্রতিটি চোখে একই প্রশ্ন " অনেক দিন আমাদের মেরেছিস,আজ বাগে পেয়েছি তোকে,কে আজ বাঁচায় তোকে দেখছি।"তারপর যা ঘটলো তাতে নিবারণের ভয়ে গায়ে ডোল দিয়ে উঠলো, জলের উপর মুখ বাড়িয়েছে এক অতিকায় শোলমাছ, মুখে তার  নিবারণের টোপ গাঁথা, জলের উপর  সে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু  হয়ে উঠেছে, যা কোনো মাছের পক্ষেই কোনোদিনই সম্ভব নয়, তারপর তার হাঁকরে ওঠা গলা শোনা গেল,"ওরে ব্যাটা নিবেরণ সাঁপুই,এটা রাজা মহীপালের দীঘি,আমি মহাশোল রুদ্রাক্ষ এর পাহারাদার,তুই সেদিনের যোগী,এঁদো পুকুরের পুঁটিমাছ ধরা পাবলিক,তুই রাজারাড়রার দীঘিতে এসেছিস মাছ মারতে,দেখ এবার তোর কি হয়".. ভুস করে ডুবে  গেল ওই বিভীষিকা,তারপর  ছিপ ধরা হাত শুদ্ধু ছড়ছড় করে তাকে জলের দিকে টেনে নিয়ে চল্ল,কিছু বুঝবার আগেই নিবারণ কোমর জলে গিয়ে পড়লো,চার পাশে অন্য মাছগুলো তখন নাচতে শুরু করেছে,আর সমবেত স্বরে চেঁচাচ্ছে," হুয়া হুয়া,হত্যা হুয়া, আচ্ছা হুয়া,আচ্ছা হুয়া"সে শব্দে কান পাতা যায়না... নিবারণ "গেলাম মা, রক্ষে কর "বলে ছিপ ছেড়ে দিলো, আর কোনক্রমে হাঁচড়ে পাঁছড়ে সর্বশক্তি দিয়ে জল কাদা ভেঁংগে পাড়ে এসে ধড়াম করে আছড়ে পড়লো। মাথার উপর শয়ে শয়ে দাঁড়কাক তখন বিকট শব্দে মাতিয়ে তুলেছে।আর ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। নিবারণ আর পারলো না,প্রাণপনে এক চিকুর পেড়ে ঠায় অজ্ঞান হয়ে পড়লো।
নিবারণ আর আজকাল মাছ ধরতে যায়না।মন দিয়ে  দোকান করে,আর রবিবার ভোরে উঠে গীতা পড়ে। বয়স তো হচ্ছে। 

সাহিত্যিক অনিন্দ্য দত্ত
আন্ধেরী পূর্ব, মুম্বাই, ভারত























0 Comments