দীপক বেরার গল্প



মোবাইল ফোন 

ছেলেবেলার বয়স পেরিয়ে বিল্টুর এখন কিশোর বয়স। বন্ধুদের কাছে মোবাইলে এখন নানারকম গেম খেলতে শিখেছে সে। গেমগুলো খেলতে খেলতে কেমন যেন নেশার মত হয়ে গেছে বিল্টুর। নিজের একটা মোবাইল নাহলে তার যেন আর চলছে না। একটা মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার জন্য মা কে কয়েকবার বলা হয়ে গেছে। মা বিশেষ পাত্তা দেয়নি। বাবাকে বলতে বলে মা দায় এড়িয়েছে। 

সেদিন সাত সকালে মা বেরিয়ে গেছে ফ্ল্যাটে,বাবুদের বাড়ি ঝিয়ের কাজে। বাবা দুয়ারে বসে বিড়ি টানছে। কাজে বেরিয়ে যাবে একটু পরে। এমন সময় হঠাৎ বিল্টু, বাবার কাছে এসে একটা আঙুলে ঘষা মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার জন্য খুব বায়না করে। মদন ছেলেকে যতই বোঝায় যে, তার কাছে মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার মত এত টাকা নেই। কিন্তু,বিল্টু  কিছুতেই সে কথা বুঝতে চায় না। মদনের মাথায় রাগ চড়ে যায়। ছেলের গালে ঠাস করে এক চড় কষায়। বিল্টু গালে হাত চেপে ধরে কেঁদে কেঁদে দৌড়ে পালায়। দূরে দাঁড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। 

মদন বাউরির মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। বিড় বিড় করে বলতে থাকে,"ধ্যুর, বাপ হয়েছি,আজ অবধি নিজের একমাত্র ছেলের একটা আবদার পর্যন্ত রাখতে পারিনি। বিল্টু জন্মাবার পর, ছেলে হয়েছে বলে কত না আনন্দ হয়েছিল আমাদের,খুশিতে ফেটে পড়েছিলাম আমি আর বউ। কত আদরের ছেলে আমাদের বিল্টু। একটু মন ভাল করার জন্য কিছু একটা ভাল খেলনা বা জিনিস ছেলের হাতে কোনওদিন তুলে দিতে পারিনা। কি যে খারাপ লাগে, আমি একটা অকর্মন্য বাপ হয়েছি!" 
সক্কাল বেলায় ঠিক কাজে বেরোনোর সময়, আজ মনটা বেজায় খারাপ হয়ে যায় মদন বাউরির, কিচ্ছু ভাল লাগে না তার। 
মদন কোনও স্থায়ী কাজ করেনা। কিছুদিন হল, মদন এক রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ পেয়েছে। সামান্যই রোজগার তার, সংসার চালাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। তাও বউটা বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে। কোনও রকমে তিনটে পেট চালিয়ে নেয়, কি করে পারবে সে? মোবাইল ফোন কেনার মুরোদ কি আছে তার? মনে মনে ভাবতে থাকে মদন। 

সাত-সকালের খারাপ মনটা নিয়ে আজ কাজে বেরোয় মদন। পাশের 'আনারকলি' অ্যাপার্টমেন্টের ভাঙা পাঁচিলের মেন্টেনেন্সের কাজ হচ্ছে। ক'দিন ধরে মদন ওখানেই কাজ করছে। 
মদন কাজের স্পটে চলে যায়। ভাল জামা-কাপড় ছেড়ে কাজের ময়লা জামা-কাপড় পরে নেয়। তারপর, ওদের লোকেদের সাথে কাজে লেগে যায়। রাজমিস্ত্রির নির্দেশ মত বালি-সিমেন্টের মিক্সড করা মাল-মশলা নিচের থেকে মাথায় করে বাঁশের ভারায় উঠে মিস্ত্রির হাতে পৌঁছে দেয়। এইভাবে অনেক বার তাকে উপর-নিচ করতে হয়। বেশ কষ্ট হয় তার। কাজের মধ্যেই সকালের যন্ত্রণাটা তাকে কুরে কুরে খায়। 

ট্যিউশনি সেরে পিঠে বইয়ের ব্যাগ আর হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে এ্যাপার্টমেন্টের কিছু ছেলে ওখানকার ফাঁকা মাঠটা তে জড়ো হয়েছে। কিছু ছেলে আবার হাতে ব্যাট-বল নিয়ে এসেছে। ক্রিকেট খেলার আয়োজন করছে বোধ হয়, মদন লক্ষ্য করে। 
একটু পরেই সে দেখে, সবাই তাদের স্কুল-ব্যাগের মধ্যে মোবাইল ফোন গুলো রেখে, ব্যাগগুলো মাঠের পাশে একসঙ্গে লাইন করে রাখে। 
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা তাদের খেলা শুরু করে দেয়। চার,.. ছয়,.. আউট..,. হাউস দ্যাট! .. ক্রিকেটের এইসব চির-চেনা শব্দের সম্মিলিত চিৎকার আর আওয়াজে জায়গাটা ভরে ওঠে। ওরা নিজেদের খেলার আনন্দে মেতে যায়। 
চিৎকার চেঁচামেচি গুলো মদনেরও কানে ভেসে আসে। মদন কাজের ফাঁকে ওদের খেলার দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু, তার মনটা পড়ে আছে মোবাইল ফোনে। মাঠের পাশে ব্যাগের মধ্যে রাখা মোবাইল ফোনগুলোর কথা মদনের মনের মধ্যে যাওয়া-আসা করে। সকালে ছেলের বায়নার কথাটাও মদনের মনে পড়ে যায়। এরকমই একটা মোবাইল ফোনের জন্যেই তো বিল্টুটা বায়না করেছিল। সকালের ঘটনা, আর মাঠের পাশে ছেলেদের ব্যাগের মধ্যে রাখা মোবাইল ফোন, এই দুটো জিনিস এখন মদনের মাথার মধ্যে খালি ঘুরপাক খায়। একটুখানি ভাল বাপ হওয়ার নেশা, আজকে যেন তাকে পেয়ে বসেছে। 

ছেলেগুলোর দিকে মদন তাকায় একবার করে। ওরা নিজেদের খেলায় একেবারে মেতে আছে। মদন আরও লক্ষ্য করে মোবাইল ফোনগুলোর দিকে ওদের কোনও খেয়ালই নেই। মদনের তীক্ষ্ণ নজর এখন একটা মোবাইল ফোনের ব্যাগের দিকে। মদন ভাবে, এই সুযোগ! ধীরে ধীরে ওদের একসাথে লাইন করে রাখা ব্যাগুলোর দিকে এগিয়ে যায়, ভাল করে চারপাশটা একটু চোখ চালিয়ে দেখে নেয় মদন। নাঃ, কেউ ওকে খেয়াল করছে না। খুব সন্তর্পণে মদন একটা ব্যাগের চেন খুলে মোবাইল ফোনটা বের করে নিয়ে নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করে দেয়। আর একমুহূর্তও দেরি না করে তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে কেটে পড়ে সে।  
তারপর, যেখানে ওদের ইট, বালি, স্টোনচিপস্ ইত্যাদি স্তুপীকৃত করে রাখা আছে, সেখানে গিয়ে ইটের ফাঁকে মোবাইল ফোনটা লুকিয়ে রাখে। 

ওদিকে রাজমিস্ত্রী ইসমাইল চিৎকার করে ডাকে, "আরে এ্যায়... মদ.. ন, কোথায় গেলিরে? ওঃ, এ ব্যাটা কোথায় যে যায়, তার ঠিক নেই!" 

"এই রে সেরেছে!", বলেই মদন তাড়াতাড়ি করে মশলার পাত্র নিয়ে মিস্ত্রির কাছে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হয়। "এইতো ইসমাইল দা, এসে গেছি", রুদ্ধশ্বাসে মদন বলে। 
"কোথায় ছিলিরে এতক্ষণ? একটু বলে যাবি তো, এদিকে যে আমার মাল শেষ। বসে আছি কখন থেকে। ভাবছি, এই আসবি, এই আসবি, তা তোর আর পাত্তা নেই! তা কোথায় গিয়েছিলি বাপ আমার?", .. ইসমাইল ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে বলে। 
"এই তো,.. মানে,.. ওই তো,.. ইয়ে,.. মানে, একটু হিসি করতে গিয়েছিলাম।".. মদন আমতা আমতা করে বলে। 
"যা ব্বাবা! এতে তোর এত হড়বড়ানির কী আছে? এত আমতা আমতা করছিস কেন? হিসি করতে গিয়েছিলি বলে কি তোদের মহাভারত একেবারে অশুদ্ধ হয়ে গেছে! আরে বাবা, এ তো সবারই প্রাকৃতিক কর্ম, আটকে রাখা যায়না, ডাক দিলেই যেতে হয়।"
"না, মানে ওই আর কি",.. বলেই, মদন তাড়াতাড়ি করে রাজমিস্ত্রী ইসমাইল কে মশলার মাল এগিয়ে দেয়। 

এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। সারাদিন কাজের শেষে মদন চুরি করা মোবাইল ফোনটা নিয়ে বাড়ি ফেরে। মনে মনে ভাবে, আজ বিল্টুর হাতে মোবাইলটা দিয়ে একেবারে তাক লাগিয়ে দেবে। 


ছিঃ ছিঃ ছিঃ.. বিল্টুর বুকটা একেবারে ফেটে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত বাবা চোর হল? দুঃস্বপ্নেও সে একথা ভাবতে পারেনা। চোখ ফেটে জল আসে বিল্টুর। 
বাবাকে সে একটা মোবাইল ফোন চেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু, তাই বলে, বাবা চুরি করে এনে তাকে মোবাইল দেবে, এ কথাটা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছেনা। 
সেদিন বাবা কাজ থেকে ফিরে এসে রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর যখনই মোবাইলটা বিল্টুর হাতে দিল, তখনই তার সন্দেহ হয়েছিল। নতুন মোবাইল হলে তো নতুন খাপের মধ্যে থাকবে। হাতে নিয়েই বিল্টু বুঝতে পারে যে, ওটা কারুর ইউজ করা। সিম কার্ড ভরা, স্ক্রীন-লক করা মোবাইল। তাছাড়া, মোবাইলের ব্যাক কভারে 'AAKAASH' নামের একটা স্টিকার লাগানো। বিল্টু বেশ বুঝতে পারে, মোবাইলটা নিশ্চিত 'আকাশ' নামের কোনও একজন লোকের। মদনের অতশত জ্ঞান নেই। তাই, যখনই বিল্টু বাবাকে জিজ্ঞেস করে, "এ মোবাইল তুমি কোথায় পেলে? এটা তো অন্য কারুর ব্যবহার করা মোবাইল। কেমন ঘষা ঘষা দাগ হয়ে গেছে! সিম কার্ড ভরা চালু মোবাইল ফোন, পেছনে তো তার নাম লেখা রয়েছে।"  মদন তখন ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে থাকে, পরক্ষণেই বিল্টুর সামনে থেকে কেটে পড়ে। 

বিল্টু জানে, বাবা তার কোনও স্থায়ী কাজ করেনা। আজ রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ করে, তো, কাল কারখানায় কাজ করে। আবার কোনও দিন মুটেগিরি করে। কোনও কোনও দিন ঘরেই বসে থাকে। বাবার ভরসায় থাকলে যে সংসার চলবেনা, দুবেলা দুমুঠো পেটের ভাতও জুটবেনা, সে কথা মা খুব ভাল করেই জানে। তাইতো, মা ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গিয়ে ঝিয়ের কাজ করে। 
আজকাল, সে নিজেও বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করার একটা কাজ জোগাড় করেছে। কিন্তু তাতেও তো তাদের সংসার ঠিক মত চলেনা। পাড়ার হারু কাকার মুদির দোকানে মা ধার-বাকি করে জিনিস নিয়ে আসে। সময়মত টাকা শোধ দিতে পারেনা বলে হারু কাকা, মাকে যাই নয় তাই করে কটুক্তি করে। বিল্টুর খুব খারাপ লাগে। বাবার এতে কোনও তাপ উত্তাপ নেই, কেমন যেন অলস টাইপের। কোনওদিন আবার বাবা মদ খেয়ে এসে মায়ের সঙ্গে অশান্তি করে। আশৈশব এইসব দৃশ্য দেখে দেখে বিল্টুর গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে তার বাবা চুরি করবে, এটা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারেনা। 
তার আরও রাগ হচ্ছে মায়ের ওপর। কারণ, এতকিছু জানার পরেও মা চুপ করে আছে দেখে। বরং, মা আবার বাবার সঙ্গে বসে বসে কি যেন সব গুজগুজ ফুসফুস করছে। সেদিন সারারাত বিছানায় ছটফট করতে থাকে বিল্টু, কিছুতেই ঘুম আসেনা তার। সরকারি ইস্কুলের হরিচরণ মাস্টারের কথাগুলো খুব মনে পড়ে যায় বিল্টুর, "একটা কথা মনে রাখিস, তোরা গরিব হতে পারিস, কিন্তু, কখনোই অসৎ হবিনা। সারাটা জীবন সততা নিয়ে বাঁচবি।" সারারাত ধরে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদল বিল্টু।


আজ 'আনারকলি' এ্যাপার্টমেন্টের এ্যাসোসিয়েশানের আর্জেন্ট মিটিং চলছে। ইদানিং চুরির উপদ্রব খুব বেড়ে গিয়েছে। তাই এ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে মিটিং। 
"গতকাল জগৎ মোহন বাবুর ছেলের দামি মোবাইল ফোনটা চুরি হল। এর আগেও উকিলবাবুর ছেলের সাইকেল চুরি হয়েছে। দু'দিন ছাড়া এসব কী হচ্ছে বলুন তো?" বিশ্বম্ভর বাবুর গলায় উত্তেজনার সুর। 
"গত মাসে শুভমের সাইকেলটাও গেছে। দু'দিন ছাড়া ছাড়া বিল্ডিংয়ের আলোর বাল্ব, টিউব, জলের কলের ট্যাপ, জুতো, চপ্পল, বারান্দা থেকে জামা-কাপড় হামেশাই তো চুরি যাচ্ছে", .. মিসেস লাহিড়ী বেশ ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলেন। 
"আর, এই যে গ্যারেজে আমাদের এতগুলো গাড়ি থাকে, হয়তো কোনওদিন আরও বড় চোর এসে এবার গাড়ির পার্টস খুলে নিয়ে পালাবে। জানেন, যাদবপুরে আমার এক কলিগের গ্যারেজে, রাতের বেলায় গাড়ির কাচ ভেঙে অডিও সিস্টেম চুরি হয়ে গেছে, এইতো ক'দিন আগে", .. মিঃ পান্ডে বেশ আতঙ্ক নিয়ে বলেন। 
সবাই একসুরে বলে ওঠেন,.." সত্যি ব্যাপারটা তো খুবই চিন্তার হয়ে দাঁড়িয়েছে!"
সেক্রেটারি সব্যসাচী বাবু বলেন, "না না আর দেরি করা ঠিক হবে না। পাঁচিলের মেন্টেন্যান্সের কাজতো হচ্ছেই, ওদের দিয়েই পেছনের পাঁচিলটা আর একটু উঁচু করে নিতে হবে, আর সেইসঙ্গে কাঁটাতারের জালও লাগাতে হবে।" 
এ্যাসোসিয়েশানের প্রেসিডেন্ট জ্যোতির্ময় বাবু সব পয়েন্টসগুলো নোট করে নিচ্ছেন। এইসব কাজ করতে কত টাকা খরচ হবে, ফান্ডে কত টাকা আছে, আরও কত টাকা তুলতে হবে এইসব বিষয়ে সেক্রেটারি সব্যসাচী বাবু এবং ট্রেজারার কান্তিবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে তিনি একটা প্রাথমিক হিসেব কষে রাখলেন। 
মিসেস লাহিড়ী বলেন, "দেখুন, আর একটা কথা, এইসব 'কেয়ারটেকার কাম সিকিউরিটি' দিয়ে আর চলবেনা। এরা খায় দায়, আর ঘুমায়, কোনও কর্মের নয়। এবার একটু দেখুন, কোনও প্রাইভেট এজেন্সি থেকে সিকিউরিটি নেওয়া যায় কিনা?" 
সব্যসাচী বাবু আর জগৎ মোহন বাবু প্রায় সমস্বরে বলে ওঠেন, "আরে মাথা খারাপ নাকি, প্রাইভেট এজেন্সি থেকে সিকিউরিটি নেওয়ার কত খরচ জানেন, আইডিয়া আছে আপনার? আমাদের ছোটখাটো এলোন বিল্ডিং। কত টাকা আর উঠবে? এমনিতেই মাসে মাসে মেন্টেন্যান্স চার্জটাই কেউ পকেট থেকে বের করেনা, রেগুলারলি দিতে চায়না। দেখুন লাহিড়ী বৌদি, যতটুকু যা করতে হবে, তা আমাদের নিজেদের ক্যাপাসিটির মধ্যেই করতে হবে।"
"তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন",.. মিসেস লাহিড়ীও উনাদের কথার যুক্তিগ্রাহ্যতা স্বীকার করে নেন। 

বিল্টু সকাল থেকেই বাড়িতে ছিলনা। কাল রাত থেকে মনটা ভাল নেই বলে কোনকিছু না খেয়েই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল বন্ধুদের কাছে। দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখে বাবা খেতে বসেছে। তারও পেট খিদের চোটে চোঁ চোঁ করছে, কিন্তু পেটের চাইতে তার মাথায় রাগ চড়ে আছে অনেক বেশি। সরাসরি সে বাবার কাছে গিয়ে জানতে চাইল, "বাবা, তুমি এই মোবাইল ফোনটা কোথা থেকে চুরি করেছ আমাকে এক্ষুনি বলতেই হবে, আমার জানা খুব দরকার।" 
মদন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, "কী! কী বললি তুই, আমি চোর! তোর এত বড় সাহস! এক চড়ে তোর গাল ফাটিয়ে দেব আমি",.. বলেই বিল্টুর গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে দেয়। তারপর রাগের চোটে ভাতের থালা পা দিয়ে উল্টে ফেলে দিয়ে চলে যায়। 
মা চিৎকার করে উঠে বিল্টুকে বলে, " দিলি তো মাথা খারাপ করে, খিদের সময় মানুষটাকে একটু খেতে পর্যন্ত দিলিনা?"
বিল্টু মায়ের কথায় চুপ করে থাকে, এতসব কান্ড-কারখানা ঘটে যাওয়ার পরেও বাবার প্রতি বিল্টুর এতটুকুও অনুশোচনা হয়না। চোর বাবার প্রতি তার মায়ের কেন যে এত ভালোবাসা, কিসের এত আনুগত্য, ভেবে কুল কিনারা করে উঠতে পারেনা কিশোর বিল্টু। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে টিকে থাকতে গেলে বা বাঁচতে হলে সহায়-সম্বলহীন একজন নারীর একজন পুরুষকে আঁকড়ে ধরার যে কী প্রয়োজন, তা বোঝার মত এখনও বয়স হয়নি বিল্টুর। 
কাগজ বিলি করার সুবাদে বিল্টুর এপাড়া ওপাড়া যাতায়াত বেড়েছে, পরিচিতিও হয়েছে। ওরই মত বয়সের অনেক ছেলেরা দুধ, ডিম, ফুল-মালা ইত্যাদি নানারকমের সব জিনিস ফেরি করে করে বিক্রি করে বেড়ায়। ওদের সঙ্গেও বিল্টুর ভাব-বন্ধুত্ব হয়েছে। বিল্টু খুব হাসিখুশি আর মিশুকে হওয়ার ফলে, ওকে বন্ধুরা সবাই খুব ভালোবাসে। সকালে বেরিয়ে বিল্টু ওদের কাছে বেশ একটু কায়দা করে জানার চেষ্টা করছিল, এলাকায় কাছাকাছি কোনও মোবাইল ফোন চুরি হয়েছে কিনা। এই কথা শুনে ওপাড়ার সেন্টু বলে, "আরে হ্যাঁ, আমার মা বলছিল, 'আনারকলি' বিল্ডিং - এ নাকি কালকে একটা দামি মোবাইল ফোন চুরি হয়েছে। সেই নিয়ে নাকি ওদের বিল্ডিংয়ের বাবুদের কিসব মিটিং টিটিং হয়েছে।" 
"তাই নাকি? তা 'আনারকলি' না, কি যেন বললি, সেটা কোথায়?".. বিল্টু, সেন্টুকে জিজ্ঞেস করে। 
সেন্টু বলে, "আরে ওই যে বড় রাস্তার মোড়ে, যেখানে একটা বড় মাঠ আছে। সেই মাঠের পাশেই একটা বড় বিল্ডিং আছে না, ওইটাই তো 'আনারকলি' বিল্ডিং। আমার মা তো ওই বিল্ডিং এর ফ্ল্যাটে বাসন মাজার ঠিকে কাজ করে। তাইতো, মা শুনে এসে ঘরে বাবাকে বলছিল, আমি শুনেছি।"
"আচ্ছা আচ্ছা",.. বিল্টু বলে। 
সেন্টু জিজ্ঞেস করে, " কেন রে বিল্টু, তুই হঠাৎ এই চুরির কথা জানতে চাইছিস?"
"আরে না না, আমিও ওপাড়ায় শুনলাম, কিসব চুরির ব্যাপারে লোকজন আলোচনা করছিল। 'ইদানিং চুরিটা খুব বেড়ে গেছে'.. এই টাইপের কিছু কথাবার্তা কানে এল, তাই তোদের জিজ্ঞেস করছিলাম আর কি।" 
"ও আচ্ছা, তাই বল",... সেন্টু বলে। 


দুপুর গড়িয়ে একটু বিকেল হতেই বিল্টু বেরিয়ে পড়ে 'আনারকলি' এ্যাপার্টমেন্টের খোঁজে। সেন্টুর কথা মত আগে বড় রাস্তার মোড়ে যায়। তারপর, বড় রাস্তার পাশে বিল্ডিং গুলো দেখতে দেখতে হাঁটে। হঠাৎ বিল্টু লক্ষ্য করে, একটা বড় বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে বড় বড় করে লেখা রয়েছে, .... 'আ না র ক লি'! 
"এইতো পেয়েছি",.. বিল্টু মনে মনে বলে। 
কিছুক্ষণ বিল্টু একটু ইতস্তত করে, তারপর বুকে সাহস নিয়ে বড় লোহার গেটটা একটু ঠেলে মুখটা ঢুকিয়ে উঁকি মারে। 
ভেতরে কেয়ারটেকার গেটের পাশে পায়চারি করছিল। বিল্টুকে উঁকি মারতে দেখেই চিৎকার করে ওঠে, "কে রে ওখানে? কী চাই?" 
বিল্টু সাহস করে ভেতরে ঢোকে। বিল্টুর হাতে ধরে থাকা মোবাইল ফোনটার দিকে প্রথমেই নজর চলে যায় কেয়ারটেকারের। তৎক্ষণাৎ সে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে বিল্টুর ওপর। বিল্টু কিছু বলার আগেই তার কান ধরে হিড় হিড় করে ভেতরে টেনে নিয়ে যায়। তারপর, মোবাইলটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে। ব্যাকে 'AAKAASH' নাম লেখা স্টিকারটা দেখতে পায়। তখনই কেয়ারটেকার সপাটে বিল্টুর গালে একটা চড় কষায়, আর চিৎকার করে বলে, "তাহলে, ব্যাটা তুই চুরি করেছিস আমাদের আকাশ দাদার মোবাইল ফোনটা। দাঁড়া, আজ তোকে দেখাচ্ছি মজা!".. 
চিরকাল স্থবির হয়ে বসে থাকা কেয়ারটেকার, আজ যেন একেবারে উচ্চিংড়ের মত লাফাতে শুরু করেছে, ব্যাপক উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকে সে। 
হঠাৎ করে বিনা দোষে গালে একটা চড় খেয়ে রাগে, লজ্জায়, অপমানে বিল্টুর কানের গোড়া, মুখমন্ডল লাল হয়ে যায়। মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। তারই মধ্যে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে শান্ত ভাবে সত্যি কথাটা বলতে চেষ্টা করে বিল্টু। কিন্তু, কে শোনে কার কথা! 
কেয়ারটেকার চিৎকার করে,"চোর ধরেছি, চোর ধরেছি",.. বলে ততক্ষণে সারা বাড়ি মাথায় করে ফেলেছে একেবারে। এমনিতেই তো কেয়ারটেকার ঠিক মত কাজ করেনা বলে, প্রায়ই সারাক্ষণ নিন্দা-অপবাদ শুনতে হয়, মুখ বুজে সইতেও হয়। তার ওপর আবার কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি। আজ সে একটা মোক্ষম  মওকা পেয়েছে বাহবা কুড়নোর। বিল্টুর কথা শোনার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই তার নেই এখন। ইতিমধ্যেই তার চিৎকার চেঁচামেচিতে কিছু ড্রাইভার, কাজের লোক সেখানে জড়ো হয়ে গেছে। তারা সবাই মিলে বিল্টুকে একহাত নিতে শুরু করেছে। 

আজ, রবিবারের বিকেল। বাবু-সাহেবরা জম্পেশ লাঞ্চ খেয়ে সবাই জিরোচ্ছেন এখন। গিন্নিরা টিভির পর্দায় চোখ রেখে হয়তো রান্নার নতুন রেসিপি শিখছেন। কেউ হয়তো সদ্য ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। এমন সময় নিচের চিৎকার চেঁচামেচিতে সবাই তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে নিচে নেমে আসে। 
সবাই দেখে, কেয়ারটেকার দারুণ উত্তেজিত! 
"এই দেখুন সাহেব, মোবাইল ফোনের চোর ধরেছি। এই ছোঁড়াই আমাদের আকাশ দাদার মোবাইল ফোনটা চুরি করেছিল। আজ আবার নিশ্চয়ই অন্য কিছু একটা চুরির উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকেছিল। ব্যাটাকেে খপ করে ধরেছি।" 
এবার বিল্টু প্রতিবাদ না করে পারলনা। সে চিৎকার করে বলতে লাগল, "আমি চুরি করিনি স্যার, আমি চুরি করিনি। চুরি করলে এই মোবাইল ফোনটা নিয়ে কি আমি এত তাড়াতাড়ি আবার এইখানেই আসতাম?"
"ছেলেটার কথায় যুক্তি আছে",.. ঘোষ বৌদি বলেন। 
একতলার মিঃ জোয়ারদার জিজ্ঞেস করেন, "তাহলে ব্যাপারটা কী বল, এই মোবাইল ফোনটা তুই কোথায় পেলি?" 
মিঃ জোয়ারদারের শান্ত গলায়, বিল্টু একটু সাহস পেয়ে পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে বলল। 
বিল্টুর কথা শেষ হতে না হতেই, মিসেস লাহিড়ী বললেন, "এইসব ছোটলোকদের কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না। এরা সবাই খুব ভাল রকমের অভিনয় জানে, কথায় কথায় মিথ্যে কথা বলে। ওকে পুলিশে দিন।"
শুনে হালদার বাবু বলেন, "আমার তো মনে হয়, ছেলেটি সত্যি কথা বলছে। ও এখান থেকে চুরি করে, আবার সেই জিনিসটা নিয়ে এখানেই বা আসবে কেন? আর, তাছাড়া মেন গেট দিয়ে ঢুকে কেয়ারটেকারের সামনে দিয়েই বা আসবে কেন?".. 
অনেকেই বলেন, "ঠিক, একদম ঠিক, হালদার বাবুর অকাট্য যুক্তি।" 

আকাশের বাবা জগৎ মোহন ব্যানার্জি, এতক্ষণ সব চুপচাপ শুনছিলেন। হঠাৎ, ছেলে আকাশকে ডেকে কিছু একটা জিনিস ঘর থেকে নিয়ে আসতে পাঠালেন। 
তারপর বিল্টুর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিজের হাতে নিলেন, আর বিল্টুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করলেন, "তোর কি এরকম একটা মোবাইল ফোন দরকার?" 
বিল্টু লাফিয়ে উঠে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, "না না স্যার, আমি সে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি।" 
ব্যানার্জি বাবু বিল্টুর কাঁধে হাত রেখে বলেন, "আমি জানি। আমি নিজের ইচ্ছেয় আজ তোকে একটা পুরষ্কার দিতে চাই।".. বলেই ছেলে আকাশের হাত থেকে নতুন একটা মোবাইল ফোন নিজের হাতে নিয়ে আবার বলেন, "আকাশের মোবাইলটা চুরি হয়ে যাওয়ায় আমি কাল রাতে এটা ছেলের জন্য কিনে এনেছিলাম। এখন তোকে আমি, এটাই পুরস্কার হিসেবে দিতে চাই, এটা তোর সততার পুরষ্কার। আর, এবার থেকে তোর কোনও কিছুর অভাব হলে বা দরকার পড়লে আমার কাছে আসিস।"
বিল্টু, অবাক বিস্ময়ে ব্যানার্জি বাবুর চোখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর কি মনে করে যেন, ব্যানার্জি বাবুকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল। তারপর হাসিমুখে মোবাইল ফোনটা নিয়ে এক দৌড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। 

দৌড়, আরও দৌড়,.. অসামান্য সেই দৌড়! সততার পুরষ্কার পাওয়ার আনন্দ যে এতখানি হতে পারে, বিল্টু এর আগে কখনও অনুভব করেনি,.. এক অপার আনন্দ,.. অনির্বচনীয় এক আনন্দ! 
তার মাষ্টারমশাই, হরিচরণ বাবুর কথাগুলো মনে পড়ে যায় বিল্টুর। "গরিব হতে পারিস, কখনও অসৎ হবিনা। সারাটা জীবন সততা নিয়ে বাঁচবি।" 

এদিকে সবাই প্রায় সমস্বরে বলে ওঠেন, "এটা কি করলেন দাদা? অত দামি মোবাইল ফোনটা ছোঁড়াটাকে দিয়ে দিলেন? সবাই হৈ হৈ করে উঠলেন। 
জগৎ মোহন ব্যানার্জি স্মিত হাসি হেসে জবাব দিলেন, "আমাদের মোবাইল ফোনটা তো ফিরেই পেলাম। কিংবা, ছেলেকে আরও একটা ওই রকম মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার ক্ষমতাও আমার আছে। কিন্তু, আজকে আমি যদি ওকে এই সততার পুরষ্কারটা না দিতাম, তাহলে সারাজীবনের জন্য একটা কিশোরের সোজা মেরুদণ্ডটা ভেঙে যেত। একটা মোবাইল ফোনের চেয়ে একটা সোজা মেরুদণ্ডের দাম যে অনেক বেশি, যা ক্রমশ বিলিয়মান হয়ে যাচ্ছে, আমাদের এই অবক্ষয়ের সমাজ থেকে।"

  সাহিত্যিক দীপক বেরা
   হরিদেবপুর, টালিগঞ্জ, কলকাতা

























0 Comments