
কান্না হাসির দোল দোলানো
ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূর্বা।চোখ দিয়ে এখনো টপটপ করে জল পড়ছে - কিছুতেই সামলাতে পারছে না নিজেকে।
নিচে দোতলা সরগরম। আনন্দ আর হইচই এর সঙ্গে মিশেছে চিংড়ির মালাইকারির সুগন্ধ। এবাড়ির মা বড্ড ভালো রাঁধেন মালাইকারিটা - গত দু'মাসে সে অমৃত স্বাদ পেয়েছে দূর্বার রসনা। মা ডেকেছিলেনও চাখতে, কিন্তু আজ কি করে দূর্বা খাবে?
"পেটটা ভালো নেই মা, আমি বরং একটু নুন চিনির জল খাই।
"এ বাবা, আজকের দিনেই তোর শরীরটা খারাপ হলো - এতো ভালোবাসিস, আচ্ছা তুলে রেখে দেব, কাল খাস।"
আজকের চিংড়ি যে কিছুতেই মুখে তুলতে পারবে না একথাটা কি করে মা'কে বোঝায় দূর্বা? আজ কেন, কাল,পরশু - কোনদিন নয়।
যাদবপুরের দূর্বা গাঁটছড়া বেঁধেছে নর্থ ক্যালকাটার বনেদি মিত্র বাড়ির অম্লানের সঙ্গে। মাস দুই হলো এ বাড়িতে এসেছে । আধুনিক যাদবপুরের ফ্ল্যাট জীবনের সঙ্গে এই তিনপুরুষের তিনতলা বাড়ির পরিবেশ অনেক আলাদা, কিন্তু দুর্বা খুব খুশি। এবাড়ি সারাক্ষণ কিছু না কিছু নিয়ে মেতে আছে । মাতছে দূর্বাও। বড় আদর এবাড়িতে। দুই ছেলের মা, শাশুড়ির আজীবন ইচ্ছে ছিল মেয়ের মা হবার। এখন সে সাধ মিটিয়ে নিচ্ছেন ষোলোআনা।সময় পেলেই শাশুড়ি বৌমা জোরকদমে চুটিয়ে আড্ডা।
উত্তর কলকাতার এই মিত্র বাড়ির কচিকাঁচা থেকে বুড়োরা সব্বাই মোহনবাগান সাপোর্টার। দূর্বার ঠাকুরদার বাবা যদিও দেশভাগের অনেক আগেই বরিশাল থেকে এদেশে এসেছিলেন, দূর্বার বাবা কোনোদিন দেখেনইনি বরিশাল - তবুও সব্বাই গোঁড়া ইস্টবেঙ্গল।
বিশ্বায়নের দৌলতে বিদেশী ফুটবলের ভক্ত এখন সক্কলে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা অন্য।
বাড়িতে দূর্বা বরাবর দেখেছে তাদের ফ্ল্যাটে চলে আসে কাকুরা। লেবু লঙ্কা ঝোলে টিভির ওপর। সে কী উত্তেজনা!
এ বাড়ির হাওয়া অন্যরকম, তাই নিজের ইস্টবেঙ্গল প্রীতির কথাটা আর কাউকে জানায় নি দূর্বা। তবে অম্লান জানে। বিয়ের আগে চারটি বছর ঘোরাফেরায় কম কথা তো আর হয়নি।
সেই আগাগোড়া লাল হলুদ ভালোবাসা দূর্বা কি করে আজ মুখে তোলে মোহনবাগান-জয় উৎসবের চিংড়ি?
ভাবতেই ভাবতেই আর একবার বুক ঠেলে এক পশলা কান্না ঝরে পড়ল টুপটুপ!
পেটটাও মোচড় দিয়ে উঠলো। উঃ! কি খিদেই না পেয়েছে! পাক! কিছুতেই দূর্বা মুখে তুলবে না শত্রুপুরীর আজকের ভোজের রান্না!
শত্রু! শত্রু! সব্বাই শত্রু! অম্লানও কি কম নাকি! কানের কাছে কি জোর চিৎকার করল,"গোওওওল!" বলে। অন্যেরা না হয় জানেন না, তুই তো জানিস আমার ব্যথা!
ধুর, সব বাজে। বার বার মনে হচ্ছে ছুটে চলে যায় যাদবপুর। কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু এভাবে কি যাওয়া যায় নাকি? তার ওপর আজ তো আবার দুর্বার "পেট খারাপ!"
পিঠে একটা হাত পড়ল। মুখ ঘোরালো না দূর্বা। অম্লান এসেছে এবার, খুঁজে না পেয়ে। না, কিছুতেই তাকাবে না দূর্বা।
ওমা! নাকে কিসের গন্ধ!চোখটা খুলল একটুখানি দূর্বা।
জড়িয়ে ধরে কাগজের মোড়কটা সামনে ধরল অম্লান।
"জানি তো খিদে পেয়েছে আমার বৌটার! চটপট খেয়ে নাও! তোমার পছন্দের ডবল এগ দেওয়া চিকেন রোল! লুকিয়ে নিয়ে এসেছি কেউ টের পায়নি! ছাদের ট্যাপের জলে মুখটা ধুয়ে নিচে নামবে!"
"তুমিও এক কামড় নাও!" গদগদ আহ্লাদী উত্তর!
চোখে হাসিকান্নার ঝিকিমিকি।
1 Comments
কি মিষ্টি প্রেম ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন