মানুষ ফিরবে বিজয়ীর বেশে
জীবন,যাপন,জীবিকা- আজ সময়ের আঘাতে সবটাই বন্দি।তবু সকল বিঘ্নকে ভ্রুকুটি শানিয়ে,জীবন আবার বহমান হতে সচেষ্ট অনন্ত জীবনে,অমৃতের সন্ধানে। যদিও সব মিলিয়ে জীবনের নৌকৌটি আজ ভীষণরকম টালমাটাল। মনে হয় যেন যেকোন সময়েই উল্টে যাবার উপক্রম। পাড়াগায়েঁর বেহুলাঘুম বলে একটা কথা শুনতাম।আবার কেউ কেউ তাকে কালঘুম বলেও অভিহিত করত। মৃত্যু যখন দেহের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় তখন নাকি কিছু টের পাওয়া যায় না;দরজা খুলে আত্মা ভোকাট্টা হয়ে যায়,মানে আত্মা উবে যায়।গোটা পৃথিবীর আজ অনেকটা একই অবস্থা।গত প্রায় আট মাস ধরে যেন আমরা নিজেদের সাথে লুকোচুরি খেলছি।রামায়ণের মেঘনাদ যেমন আড়াল থেকে যুদ্ধে অংশ নিত,এও অনেকটা একই রকম ।শত্রুকে দেখা যাচ্ছে না,ধরাও যাচ্ছে না।ব্রহ্মাস্ত্রর খোঁজে গোটা বিশ্ব,যা দিয়ে বধ করা যাবে অজানা অচেনা শত্রুকে।এখনো তার পরিষ্কার কোন দিশা বা দিকনির্দেশ পাওয়া যায় না।লক ডাউন ও চলেছে অনেকটা গেরিলা যুদ্ধের মত। উদ্দেশ্য একটাই,সময় কেনা ও আক্রান্তদের চিহ্নিত করে আলাদা রেখে চিকিৎসার চেষ্টা করা।যাতে রোগটা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। আর এই মহার্ঘ্য সময়ে কোন কার্যকরী ওষুধ বা ভ্যাকসিন যদি চলে আসে,তাহলে বাঁচোয়া।সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত কেউ বাদ নেই এই মৃত্যু মিছিল থেকে।কোনোভাবে গোষ্ঠী সংক্রমণ রুখতে না পারলে সমূহ বিপদ।আর তা রোখার নিমিত্তেই করা হল লক ডাউন।
যা বাড়তে বাড়তে তিন চারমাস এমনকি কোথাও ছয় মাস চলেছে । এখন ধীরে ধীরে আনলকের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ।যদিও এর গুণগত মান আজও প্রশ্নাতীত নয়; আমাদের দেশের ক্ষেত্রে।আর এই লক ডাউন করতে গিয়েই মানুষ আজ মানুষের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।যোগাযোগ যা কিছু সব দুর থেকে,প্রযুক্তি নির্ভর।শিশুদের মন খারাপের শেষ নেই। স্কুল নেই,কলেজ নেই,শুধু দু'নয়নে ভয় আর মনে সীমাহীন সংশয় । ১৩০ কোটির দেশে জনগণের সদিচ্ছা ছাড়া লক ডাউন সম্ভব ছিলনা।আবার এর পাশাপাশি লকডাউন চালিয়ে যাওয়া ও দুষ্কর।এত কিছুর পরেও আমাদের দেশে রোজ ৩০০০০ থেকে ৫০০০০ করে আক্রান্তের সংখ্যা এবং ১০০০-১২০০ করে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।কেউ জানে না এই মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে।এর মধ্যে ধসে গেছে অর্থনীতি।পথ চলতে গিয়ে অনেক পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রাণ গেল। মানুষের অনাহার,অর্ধাহারের মর্মান্তিক কাহিনি রোজ কানে আসছে। কিন্তু এসবের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,সেটা হল মানুষের মন ও মনন।রোজ এক ভয়,বন্ধু-বান্ধব,স্বজনদের সাথে দেখা না হওয়া,ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদী ভয়ে পরিণত হচ্ছে। আর এ থেকে জন্মায় হতাশা,নেগেটিভ মানসিকতা,ডিপ্রেসন। ক্রমশ ঐ হতাশা গ্রাস করছে জীবনের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে।
সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৫ বছর ধরে চলা একটা গবেষণার কথা এখানে প্রাসঙ্গিক ।বিভিন্ন বয়সের অনেকের কাছে সুখের সংজ্ঞা জানতে চাওয়া হয় । গবেষণা শেষে দেখা যায়,হ্যাপিনেস হচ্ছে Genuine human relationship,সত্যিকারের মানবিক সম্পর্ক।সত্যিকারের সম্পর্ক যখন কারো সাথে থাকে,সেই ব্যক্তি বিত্তবান হোক না হোক,আমরা তার সাথে সুখী হই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ হয়তো সারা পৃথিবীর কাছে ভালো,কিন্তু নিজে শান্তি পান না। কারণ তার জীবনসাথীর সাথে দু'দন্ড মনের কথা বলতে পারেন না।নিজেকে তিনি আর অনুপ্রাণিত করতে পারেন না।এই জেনুইন সম্পর্ক থাকা দরকার আমাদের একের সাথে অন্যের।প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের। করোনা-পরবর্তী এই সময়ে আমরা এই সম্পর্কের অভাবে ও নিরাপত্তাহীনতার অসুখে আক্রান্ত।এবং তা ভীষণরকম ভাবে। মানবাধিকার নিয়ে আমরা সরব হই,বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করি,সভা সমাবেশ আয়োজন করি,আবার সেই অধিকারকেই ভুলুন্ঠিত করতে পিছপা হইনা। জন্মগত ভাবেই মানুষ স্বার্থপর। আর আজকের এই বিপদ সংকুল মুহূর্তে সে আরো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।আমরা মানবিক হওয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা বিবেককে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।আবার কখনো দেখি মানুষকে মানুষেরই এই অসুখে পাশে দাঁড়াতে।ত্রাণ বিতরণ করতে, ওষুধ তুলে দিতে।আবার এরই মধ্যে দেখি বেনোজল ও কিছু কম নেই। ছবি ছাপিয়ে ব্যাক্তিগত ইমেজ তৈরি ও প্রতিষ্ঠা লাভের বাসনা , বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে।মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অধরাই রয়ে যায়।মানবিক সম্পর্ক সুনিশ্চিত করাই যেখানে মানবিক ধর্ম,সেখানে এর লঙ্ঘন ই হলো অসুখ।
মানুষের জন্য ধর্ম,মানুষের জন্যই রাজনীতি।তাই যেখানে মানুষের উপরে ধর্ম ও রাজনীতি গুরুত্ব পায় আ'র মনুষ্যত্ব লঙ্ঘিত হয়,সেখানেই তো মানবতার অসুখ।
যখন রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রাণ নিমেষেই চলে যায়,তখন এ অসুখ রাষ্ট্রের,রাষ্ট্র ব্যবস্থার; বকলমে আমার আপনার সকলের। মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে সপরিবারে আত্মঘাতী হবার পাপবোধের শরিক হয়ে ওঠার অসুখও আমাদের সকলের। যারা দিন-রাত পাত করে শহর নগর সড়ক সেতু ইমারত গড়ে তুলেছে,তাদের ঘাম,রক্ত ও শ্রমের মূল্য দিতে না পারাটা আমাদের তথা গোটা সমাজের অসুখ ।এই করোনা অতিমারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের যে ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছে, সেটা ও আমাদের ই অসুখ ।
এখন ও অবধি গোটা বিশ্বে ছয় লক্ষাধিক প্রাণ গিয়েছে,এক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত এই অসুখে। হ্যাঁ,এই হিসাবটা সরাসরি যারা আক্রান্ত তাদের। আসলে তো গোটা বিশ্ব আজ আক্রান্ত এই অসুখের আতঙ্কে। ৮০০ কোটি মানুষ আজ এই রোগের ভয়ে সিটিয়ে আছে।ঘরে থেকে জীবন ও জীবিকার সংকট যখন সামনে এসে দাঁড়ায়।তখন করোনার ভয়কে অগ্রাহ্য করে বাইরে বেরিয়ে আসাটাও আজ সামাজিক অসুখ,কারণ আমরা মানুষের ন্যূনতম চাহিদাটাও এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সুনিশ্চিত করতে পারিনি।এই ব্যর্থতার দায় আমাদের,আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার, আমাদের সমাজের।
"সামাজিক দূরত্ব " এই শব্দবন্ধ যতই সামাজিক শোনাক,আসলে তা কিন্তু আমাদের কিয়দংশে অসামাজিক করে তুলছে।এরই মধ্যে আবার যখন দেখি,কিছু স্বপ্ন-বিভোর,উদ্যমী,উদ্যোগী তরুণরা বিপদ তুচ্ছ করে এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষের এই কঠিন দুঃসময়ে;তখন মনের কোণে আশার ঝিলিক দেখা দেয় । আমরা আবার আশায় বুক বাঁধি ।
একদিন সব ঝড় থেমে যাবে,নতুন প্রভাত আসবে নতুন সূর্যের হাত ধরে। আমাদের আবার দেখা হবে এই অতিমারির শেষে,নতুন ভাবে এবং অবশ্যই বিজয়ীর বেশে। আর আমরা গড়ে তুলব নতুন স্বপ্নের পৃথিবী রোগমুক্ত ও আমার আপনার মিলনের নবমঞ্চ রূপে ।
0 Comments