কোন্ রাস্তা টা ঠিক
আজ থেকে উনিশ বছর আগে আমি এলাহাবাদ থুড়ি প্রয়াগরাজ এ আমি মহাকুম্ভ মেলার উপর একটা বড় ডকুমেন্টারি তুলছিলাম।প্রায় একমাস আমরা ওখানে ছিলাম,আর কত রকমের বিচিত্র ঘটনা যে সেখানে ঘটেছিল,তা বিস্তারিত বলতে গেলে,চোপড়া অথবা ব্যাসদেবের মহাধারাবাহিক এর থেকেও লম্বা হয়ে যাবে।যাহোক,একটা বিশেষ দিনের কথা না বললেই নয়,কারণ ওই দিন থেকেই আমার জীবন একটা বিশেষ খাতে বইতে শুরু করে। খুলে কই।
যেকোনো যায়গায় শুটিং থাকলেই আমি সাধারণত সকাল পাঁচটা থেকে বেরিয়ে পড়ি,যে কোনো জায়গা,জেগে ওঠার সময়,এমন কতগুলো ছোট খাটো ছবির ক্রমাগত জন্ম দেয় যে সেগুলো না দেখলে মিস,সবই মিস।
যেমন কোনো ধর্মস্থানে সকালে গনগনে আগুনে জিলিপি,কচউরী,পুরী ভাজা,নাপিত এর সামনে উবু হয়ে ইটালিয়ান সেলুনে বসে একদম সল্টলেক স্টেডিয়াম ছাঁট,দেহাতি মহিলার কমলা রং এর হনুমানজীর মূর্তিকে দুধ ঢেলে স্থান করানো, স্বাস্থ্যসমুজ্জ্বল যুবকের নেংটি পরে রাস্তার কলে আরামের স্নান,মন্দিরের মাথায় টারজানের স্টাইলে ধ্বজা বেঁধে আসা,এই সবই দেখলে আমার সেঁকা পাউরুটি ডবল ডিমের অমলেট দিয়ে খাবার মতো পুলক হয়।নদীর ধারে এক বিশালদেহী পুরুষকে প্রাণপনে একজন নিরীহ মতন লোক,ম্যাসাজের নামে তাকে যথেচ্ছ পেটাই করছে,এই ছবি দেখতে পেলে,আমি এমনকি এক খাতা পাটিগণিত ও করে ফেলতে পারি। যাক,বাজে কথা থাক।
থান কথায় আসি। নদীর ধারে এসে পড়েছি। সেটা শিব রাত্তিরের চারদিন আগে,মেলা প্রায় ভেঁগে এসেছে।লোকে পোঁটলা পত্তর গোছাতে ব্যস্ত,একদল রওয়ানা হবে,তাদের মস্ত কড়াইতে ভাত ফুটছে,হু,হু করে ধোঁয়া বেরচ্ছে,আর সেদ্ধ আতপ চালের গন্ধে চারিদিকে ম ম করছে। তন্ময় হয়ে দেখছি,এমন সময় দেখি এক অন্ধ সাধু টুকটুক করে সোজা জলের দিকে চলতে শুরু করেছেন,চোখে না দেখতে পাওয়ার ফলে দুই মিনিটের মধ্যেই একেবারে নদীতে গিয়ে পড়বেন।আমি তো বিদ্যাসাগর পড়া লোক,অন্ধকে সাহায্য করা কর্তব্য,এই কথা মনে গেঁথে আছে।তাই তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাত ধরলাম,আর কোনো পরিচয় এর বালাই না রেখে বললাম যে "আপ রাস্তে ভুল গয়ে মহারাজ,সিধা নদীকে ওর চল দিয়ে থে"...তারপর ওঁকে আর কোনো কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে ওঁনার হাত ধরে পাকা রাস্তায় এনে বললাম "ইয়ে আপকি রাস্তা হ্যায় জী"।
মনে আমার কত গর্ব,এক অন্ধকে আমি সঠিক পথে নিয়ে এসেছি কিনা!
অন্ধ মানুষটি আমার হাতটা আস্তে ছাড়িয়ে নিলেন। তাঁর অন্ধ চোখদুটো আমার মুখের দিকে তুলে খুব নরম স্বরে বললেন" মহাত্মাজী,মেরা রাস্তা তো আপনে মিলা দিয়া,লেকিন,আপকা খুদকা রাস্তাতো ঠিক হ্যাঁয় না?"...বলে হতভম্ব আমাকে পথের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে অতি দ্রুত বেগে চলে গেলেন।
সেই যে আমি দুহাজার এক সালে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলাম- এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি।
আমার পুঁথি পড়া বিদ্যের জাহাজটা শুধু মাঝদরিয়ার ভুস করে ডুবে গেছে।
অন্ধ মানুষটি আমার হাতটা আস্তে ছাড়িয়ে নিলেন। তাঁর অন্ধ চোখদুটো আমার মুখের দিকে তুলে খুব নরম স্বরে বললেন" মহাত্মাজী,মেরা রাস্তা তো আপনে মিলা দিয়া,লেকিন,আপকা খুদকা রাস্তাতো ঠিক হ্যাঁয় না?"...বলে হতভম্ব আমাকে পথের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে অতি দ্রুত বেগে চলে গেলেন।
সেই যে আমি দুহাজার এক সালে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলাম- এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি।
আমার পুঁথি পড়া বিদ্যের জাহাজটা শুধু মাঝদরিয়ার ভুস করে ডুবে গেছে।
পরিচিতিঃ ১৯৬২ এ জাতক অনিন্দ্য দত্ত। ২৪ বছর ধরে সিনেমার সাথে যুক্ত। ১১ টি সিরিয়াল,৭০ টি ডকুমেন্টারি, ৮ টি টেলিফিল্ম, একটি শর্ট ও অনেক করপোরেট ছবি করেছেন। ঝোলায় আছে২৩ টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সন্মান। ১৩ বছর আগে থেকে মুম্বাই প্রবাসী ও কর্মরত। ছবি করা ছাড়াও কবিতা,গদ্য,প্রবন্ধ, নিবন্ধ,স্মৃতি আলেখ্য ইত্যাদি লিখে থাকেন। একটি বই প্রকাশিত,আর ও একটি প্রকাশিতব্য।
0 Comments