একটি নদীর নাম
দুহাজার উনিশ সালের পয়লা জানুয়ারী,সবাই যখন বিকেলে ভাত ঘুম সেরে বিকেলে মোচ্ছোবে বেরবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমি একটা ফিল্ম ইউনিট নিয়ে শান্তিনিকেতনর পথে যাত্রা শুরু করলাম। গাড়িতে আমার পাশের সীটে যিনি বসে আছেন, তাঁর দিক তাকিয়ে,হঠাৎ আমার সারাদেহ আড়ষ্ট হয়ে এলো।এনাকে গোটা বিশ্ব চেনে অপু, অমল, নরসিং, ফেলুদা, উদয়ন পন্ডিত, খিদ্দা, ময়ূরবাহন... আরও কত কত কি বলে,আমি এক তুচ্ছ পরিচালক, আজ থেকে তাঁকে পরিচালনা করতে চলেছি! ছোটবেলা থেকে যে মানুষটিকে শ্রদ্ধ করে, সন্মান করে, মহা অভিনেতা ভেবে পূজা করে এসেছি, আবার তীব্রভাবে ভালোও বেশে এসেছি, তিনি আমার পাশে! যদিও বারো বছরের পরিচয়,কাকু বলে ডাকি, তবুও তো তিনি তিনিই,সত্যজিৎ মানস পুত্র আমাদের সকলের আদর্শ।
যাই হোক,আমার টেনশন উনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আমাকে সহজ করবার জন্য,না না কবিতা বলতে শুরু করলেন,পুরোনো দিনের বাংলা ছবির অনেক ব্যক্তির কথা,ওঁনার জীবনের ধ্রুবতারা সেই রায়মশাই এর কথা,নিধু বাবুর টপ্পা ইত্যাদি গাইতে শুরু করলেন। আজ রাতে আমাদের কোনো কাজ নেই। কাল ভোর থেকে শুরু হবে। চরিত্রটি নিয়ে খুব হাল্কা কয়েকটি প্রশ্ন করলেন।
পরের দিন সকালে আমরা শুরু করলাম শুটিং। প্রথমেই একটি আউটডোর সীন,আমার বন্ধু জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রখাত চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর পঙ্কজ পানোয়ার এর সাথে। ওর বাড়িতেই আমাদের মুল শুটিং জোন,আর কাকু আছেন ও সেই বাড়িতে,পঙ্কজ যদি ওর বাড়ি আমাদের ব্যবহার করতে না দিতো তবে এছবি হতেই পারতো না।পঙ্কজ ও তার স্ত্রী বনত্বন্নীকে এই সুযোগে আমার অন্তরের ভালোবাসা জানিয়ে রাখি। তারপর সারাদিন শুটিং চললো, কাকু প্রথম শটের পরেই বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর পুত্রবৎ পরিচালক কাজটা জানে,তাই এবার অন্য এক খেলা শুরু হলো আমাদের মধ্যে।শটের আগে,বা প্রস্তুতির সময়, উনি আমাকে শিল্প,সাহিত্য সংক্রান্ত নানা ধাঁধা,কবিতার প্রথম লাইনটি বলে বাকিটা শুনতে চাওয়া,কোনো বিশেষ চিত্রশিল্প নিয়ে আলোচনা,এইসব শুরু করলেন,এসব আর কিছুই নয়,পরিচালক ছোঁড়ার মগজের এন্টেনাটা খাড়া আছে কিনা,সেই পরীক্ষাটা নিয়ে নেওয়া,এই আরকি।
শুটিং এ এত গল্প আছে যে কোনো দিনই শেষ হবেনা। তবে প্রথম দিনের দুটো ঘটনা না বলে পারছি না। একটা সীনে উনি উপরের বারান্দা থেকে একটা অলীক ঘটনা দেখছেন যে ওঁনার আমেরিকায় চলে যাওয়া নাতনী এই রিসর্টের বাগানে খেলা করছে। উনি শটের ঠিক আগে আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন যে ক্লোজ আপে ওঁনার মুখ কতখানি ফ্রেমে আছে,মাপটা জেনে নেবার পর,যে বিস্ময়,বিপন্নতা,অসহায়তা,আক্রান্ত অবস্থা আর বিচিত্র আবেগের অভিব্যক্তি উনি ওই কয়েক সেকেন্ডর শটটিতে ফুটিয়ে তুললেন,তা আমার চব্বিশ বছরের পরিচালনার জীবনে দেখিনি,এত বিমূঢ় হয়েছিলাম যে কাট শব্দটি বলতে প্রায় তিন সেকেন্ড দেরী হয়েছিল। আর একটা ঘটনা ঘটলো রাতের দিকে,দিনের শেষ শটের সময়। উনি সাধারণত যে কোন পরিচালক কে দিনে চার ঘন্টা কাজ করবার সুযোগ দেন,আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়েছিল প্রথম দিন নয়,ও পরের দিন সাত ঘন্টা! তা সেই নয় ঘন্টার শেষ শট সেদিনের,ওঁনার মাস্টার ও ক্লোজগুলো দেবার পর,প্রচন্ড ক্লান্ত উনি পাশের ঘরে বিশ্রাম করছেন,আমরা অন্য চরিত্রদের ক্লোজ গুলো নিচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ উনি আমাকে সন্মোধন করে সুলক্ষনা বলে অভিনেত্রীর "লুক'টা ভুল হচ্ছে বলে হুংকার দিলেন,আমি গিয়ে বোঝালাম যে আসলে ভুল হয়নি,তখন শান্ত হলেন, বুঝতে পারছেন কি আপনারা,যে একটা লুক ভুল নিয়েও উনি চিন্তিত, সিনেমা জিনিসটাকে সেই মানুষটা কতই না ভালোবাসেন!
আরও কত কি যে এই তিন দিনে হয়েছে, তা আর বিস্তারিত বলবো না,শুধু শেষ দিনের দুটো ঘটনা দিয়ে এই লেখা শেষ করবো। এই ছবিতে একটা বাচ্ছার ভূত আছে,যে বুঝতেই পারছেনা যে সে মরে গেছে, শুধু বুঝছে যে সামনের নদীটা তাকে পার হতে হবে, কিন্তু তার ভয় করছে। আমাদের কবি চরিত্র,যা কাকু করছেন,ওই প্রেতের সাথে তাঁর সেই অলৌকিক নদীর তীরে সাক্ষাৎ হয়। এই সীন নেবার আগে আমি স্ববিস্ময়ে দেখলাম যে দেশের মহানতম অভিনেতা একটা আট বছরের বাচ্ছা মেয়ের সাথে,একটা টোটোতে বসে তাকে সীনটা বোঝাচ্ছেন,ও রিয়ার্সাল করাচ্ছেন!! পুত্রের মত পরিচালক কে কতটা ভালোবাসলে,ও ছবিটিকে কতটা গুরুত্ব দিলে এটা করা যায়!
এরপর আসবো ছবির শেষ সিনে,বেলা পড়ে আসছে,সূর্য আর বড়জোর আধঘন্টা থাকবে,ছবির শেষ সিন এটা,এটাই ক্লাইম্যাক্স,এটা না হলে ছবি শেষ হবেনা,আর আমাদের হাতে আর কোনো দিনও নেই। সবচেয়ে বড় কথা চৌরাশি বছর বয়সে ওঁকে এই শটে হেঁটে চলে কাজ করতে হবে,যা উনি ইদানিং করেনই না। আমার ভেতর ভেতর প্রচন্ড টেনশন চলছে,তবুও যখন আমি গিয়ে বললাম "কাকু,আমরা রেডি" উনি বললেন "দুই মিনিট অপেক্ষা করো,সূর্যটাকে আরেকটু নামতে দাও,আলোটা আরো ড্রামাটিক হবে" আমি যেন একটা আলোর আঘাতে জেগে উঠলাম। বয়সের ভার, প্রচন্ড অসুস্থতা আর সারাদিনের ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে উনি আরও নাটকীয় আলোর অপেক্ষা করছেন!
কিন্তু, সূর্যটা যে নিভে গেল কাকু আমার,এটা কি ঠিক হলো?
যাইহোক,এরপর ও বেঁচে থাকতে হবে,কাজ করতে হবে,তাই আজ প্রতিজ্ঞা করি কাকু,যতদিন দেহে থাকে প্রাণ,প্রাণপনে সিনেমার সরাব জঞ্জাল,তারপর পদপ্রান্তে বসে রব,"অলখ জনের চরণ শব্দে মেতে"...আজ স্তব্ধ হবার দিন,পরে কোনোদিন আবার কথা বলা যাবে। শুধু বলে যাই,এই জীবনে ঘটালে মোর জন্মজন্মান্তর ও,সুন্দর হে সুন্দর।
পরিচিতিঃ ১৯৬২ এ জাতক অনিন্দ্য দত্ত। ২৪ বছর ধরে সিনেমার সাথে যুক্ত। ১১ টি সিরিয়াল,৭০ টি ডকুমেন্টারি, ৮ টি টেলিফিল্ম, একটি শর্ট ও অনেক করপোরেট ছবি করেছেন। ঝোলায় আছে২৩ টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সন্মান। ১৩ বছর আগে থেকে মুম্বাই প্রবাসী ও কর্মরত। ছবি করা ছাড়াও কবিতা,গদ্য,প্রবন্ধ, নিবন্ধ,স্মৃতি আলেখ্য ইত্যাদি লিখে থাকেন। একটি বই প্রকাশিত,আর ও একটি প্রকাশিতব্য।
0 Comments