সুদীপ পাঠকের গল্প



সেতু 

১.

রাজ কুমার বাড়ী আছো ?
ব্যাস ওমনি সমস্বরে শুরু হয়ে গেল ঘেউ ঘেউ চিৎকার !বহুজাতিক সন্মেলনের মিলিত গণসঙ্গীত। এই এক মুশকিল ! দুটো পয়সা হলে লোকে আজকাল কুকুর পোষে। পুষতে হয়, পোষা দরকার ,বিদেশী নামী দামী ব্রিড আভিজাত্যের সাক্ষ্য বহন করে । তার আবার কুকুরে ভীষণ ভয়। চিকেন হার্টেড বাঙালী কিনা। 
লজ্জা ঘৃণা ভয় তিন থাকতে নয়। ভিক্ষে চাইতে গেলে মাথা নিচু করে চাইতে হয়। গ্রহীতা কখনো দাতার সমালোচনা করতে পারে না। সে অধিকার তার নেই । না এরকম ভুল সে করবে না মোটেই।রাজকুমারদের এই বাতিক আগে ছিল না ,ইদানিং হয়েছে ।ওর বাবা ছিলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।বরাবরই যথেষ্ঠ স্বচ্ছল পরিবার। তবু তাঁর আমলেও এ ধরনের কোনো বাহুল্য ছিল না । তাঁর অবর্তমানে রাজকুমার এখন রাজা। পুরোনো পৈতৃক বাড়ীর ভোল পাল্টে ফেলেছে । একতলার বসবার ঘরের সামনে বেশ বড়সড় আকারের গ্লো শাইন জ্বলজ্বল করছে । "রাজকুমার কনস্ট্রাকশনস : সকল প্রকার সিভিল ইঞ্জিয়ারিংয়ের নক্সা ও প্ল্যান তৈরী ও পাস করানোর একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান । কার্যালয় :এতো বাই এতো অমুকচন্দ্র লেন । সময় এতোটা থেকে এতোটা। রবিবার পূর্ণদিবস বন্ধ।"
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই ।রাজকুমার বরাবরের মেধাবী ছাত্র । প্রথমবারেই জয়েন্ট এন্ট্রান্স এর হার্ডল পেরিয়ে যায় । 

এবার কলিং বেল বাজাতে ছোকরা গোছের একটা কাজের লোক বেরিয়ে এলো । তার মুখে কোনো শব্দ নেই , দৃষ্টি স্থির । নাহ্ এ সুযোগ হাত ছাড়া করা চলবে না । সে মানসিক প্রস্তুতি নিলো । লক্ষ্যভেদ তাকে করতেই হবে যে । 
- রাজকুমার বাবু বাড়ীতে আছেন ? ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
- কি দরকার ? 
- দরকার মানে ইয়ে ... আমি আগে ফোনে কথা বলেছিলাম । উনি আজ আমাকে আসতে বলেছিলেন । 
- আপনি কোত্থেক আসছেন ? 
- বল সৈকত এসেছে , সৈকত ঘোষাল । তাহলেই হবে । 
ছেলেটা এখনো নিষ্পলক দাঁড়িয়ে আছে । দর্শন প্রার্থীর চেহারা ও পোষাক দেখে আন্দাজ করতে চাইছে যে তার মনিব এই লোককে কতক্ষন সময় দেবেন অথবা আদৌ দেবেন কিনা ! আগাপাশতলা পড়ার পর সে বলল 
- আপনি একটু দাঁড়ান ।
- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে । 
নিজের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংশা না করে সে পারলো না । বড় কাজের জন্য মাঝেমধ্যে মিথ্যে বলায় কোনো দোষ নেই । জয়গুরু । 

২.

অবশেষে সমস্ত প্রশ্ন বাণের বেড়াজাল টপকে সৈকত ঘোষাল নামের একজন ভ্যাগাবন্ড এসে উপস্থিত হলো রাজ কুমার বসু নামের শহরের এক অন্যতম খ্যাতনামা ইঞ্জনিয়ারের  ড্রয়িং রুমে । অবশ্য এদের একটি অন্য ধরনের পরিচয়ও আছে।এরা ক্লাসমেট।আবাল্য একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে এবং একই সঙ্গে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে । তবু আজ একজন বন্ধু কে ওপর একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার আগে পরীক্ষায় পাশ করতে হলো । সৈকতের মুখ অন্তত সে ধরনের পরিস্থিতির সাক্ষ্য বহন করছে । কোনো প্রকারে উৎরে যাওয়া ব্যাক বেঞ্চার এসেছে মার্কশিট নিতে ।   

রাজকুমারের ড্রয়িংরুম টি তার নামের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখেছে । চার দেওয়ালে চোখ বোলালে চলতি আধুনিকতার ছোঁয়া অনুভব করা যায় । ঠিক যেনো সিনেমার মতো । সৈকত দরজার সামনে থমকে  দাঁড়িয়ে আছে । পিছন থেকে কাজের ছেলেটি উঁকি দিয়ে মালিকের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করেছে । রাজকুমার যেনো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো । সশরীরে যে উপস্থিত হয়েছে সে যেনো ইহ জগতের কেউ নয় , ভিন্ন গ্রহের প্রাণী । পরনে খদ্দরের জীর্ণ পায়জামা পাঞ্জাবি । পায়ে ততোধিক জীর্ণ প্লাষ্টিকের চপ্পল । কাঁধে সুতি কাপড়ের তৈরী সাইড ব্যাগ । অবশ্য সেটাকে ঝোলা বললেই বেশি মানান সই হয় । গালে ব্লেডের আঁচড় পড়েনি মাস দু'য়েক । মাথায় অবিন্যস্ত তেলজল বিহীন লালচে রঙের চুলের বিশাল বড় একটা বোঝা ।এরকম চেহারার কোনো মানুষ তার ড্রয়িং রুমে আগে কোনো দিন এসেছে কিনা ভেবে বলা মুশকিল।গৃহস্বামী র ইশারায় ভৃত্য বিদায় নিলো ।আজ রোববার,নিয়ন মাফিক অফিস বন্ধ।  কিন্তু কাজের কোনো বিরাম নেই । সেন্টার টেবিলে ছড়িয়ে রয়েছে ব্লু প্রিন্ট । টেবিলের দুই বিপরীত দিকে দুটি সোফা । একটি বাড়ীর মালিক আর অন্যটি তে বহিরাগত দম্পতি বসে আছেন । স্বামী স্ত্রীর চোখে মুখে সংসারি সুখি মানুষের চিহ্ন আঁকা।এঁরা বাড়ী তৈরী করবেন ,রাজকুমার স্থপতি । দরজা থেকে সোফা পর্যন্ত তিনজন কৌতূহলী মানুষের সৃষ্টির শেল ভেদ করে সৈকত এলো । কেউ তাকে বসতে বললো না , তবু সে বসলো । তার মুখ থেকে প্রথম যে কথাটি বের হলো 
- জল ,একটু জল খাবো। 
কাজের লোকের জল দেওয়া ও তার জল খাওয়ার ফাঁক টুকুতে রাজকুমার তার ক্লায়েন্টকে বিদায় জানালো।বলা তো যায় কি কোন সময় কি সিন ক্রিয়েট করে বসে।কারণ সৈকত বরাবরই বেয়াড়া আর খেঁপাটে ধরনের ছেলে ।

এক চুমুকে জলের গ্লাস নিঃশেষ করেই "সত্যি ভাই রাজকুমার তোমার বৈঠকখানাটি চমৎকার সাজিয়েছো" এই ভাবে আলাপচারিতা জমাতে চেয়েছিল সৈকত । কিন্তু রাজকুমারের দাঁতে দাঁত চাপা শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে আর ভরসা পায়নি সে । রাজকুমার প্রথম থেকেই বেশ ভালো বুঝতে পারছিলো যে কিছু নগদ টাকা দিয়ে বিদায় করতে না পারলে এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই । তাই ধৈর্য হারিয়ে টাকার অঙ্কটা সরাসরি জানতে চাইল । কাজের ছেলেটিকে অবাক করে দিয়ে সে যখন বিদায় নিল তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় বেলা একটা ছুঁই ছুঁই । চাকরটি দেখল তার মালিকের অমূল্য ঘন্টাখানেক সময় নষ্ট করে দিয়ে গেল এই ভিখারি গোছের লোকটা । অস্বস্তি চাপতে না পেরে রাজকুমার বারংবার পায়চারি করছিল আর ঘনঘন সিগারেটে টান দিচ্ছিল । ওফ্ বাপরে বাপ কি জ্বালা ! যাবার সময় আবার সূর্যর অফিসের ঠিকানা ফোন নাম্বার সব নিয়ে গেল । প্রথমে তো রাজকুমার কিছুতেই দিতে চাইনি । নানান অছিলায় এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল । কিন্তু এ এমন ছিনে জোঁক সহজে কি আর ছাড়তে চায় ? ভবি কিছুতেই ভোলবার নয় ।তাই অগত্যাই...।যাবার সময় আবার বলে গেল 
"ভাই রাজকুমার একটা কথা বলি কিছু মনে করো না যেন । কুকুর পোষা ভালো কথা ; পশুপ্রেমী নিন্দনীয় নয় নিশ্চয়ই । তবে দু' তিনটে কুকুরের সঙ্গে একটা মানুষের বাচ্ছাও পোষনা কেন ? দু'বেলা দু'মুঠো খেয়ে পরে সেও মানুষ হয়ে যাবে , তাই না ?

ওহ্ অসহ্য ! এরা সেই সকল সো কল্ড মিডিল ক্লাস প্যানপ্যানানি ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না । একরাশ বিরক্তি সহ হাতের ধূমায়িত সাদা কাঠিটি মুচড়ে দিয়েছিল রাজকুমার  মহার্ঘ শ্বেতপাথরের ছাইদানিতে ।

৩. 

উটকো ঝঞ্জাটের মতন সৈকত এসেছিল , চলেও গেল । ঘন্টা খানেক সময় আর হাজার দু'য়েক টাকা নিয়ে তবে আপদ বিদায় হয়েছে । ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছুই বলতে চেয়েছে কিন্তু কিছুই কর্ণগোচর হয়নি রাজকুমারের । অসম্ভব বিরক্তি বোধ হচ্ছিল সেই সময়টা । ক্ষোভের আবরণটা ছিল ঠিকই তবে বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি ।নিজের বংশ কৌলিন্য সামাজিক পদমর্যাদা বজায় রাখার দায় থেকেই যায় তাই ... । 
দু'দিন বাদে সূর্যর ফোন এলো । যা কিনা অবধারিত ছিল । স্বাভাবিক কারণে সূর্য অসম্ভব রেগে আছে । তবু ভালো যে সে রাজকুমারকে দোষারোপ করেনি বা ভুল বোঝেনি । কথা প্রসঙ্গে সূর্য বলল "আরে ধুর ছাড়তো ওর আবার মান-সম্মান কি ? কেঁদে ককিয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর আর পড়াশোনা করেছে বলে তো মনে হয় না ।এখনো সেই বাউন্ডুলেই রয়ে গেল । কাজকর্ম কিছু করে না ,নানান অছিলায় লোকজনের কাছে হাত পাতা ছাড়া উপায়টাই বা কি বল তো ?" রাজকুমার সূর্যের মন্তব্যের পূর্ণ সমর্থন জানায় । সৈকত ঘোষাল,কেরানীর বাচ্চা।চোদ্দপুরুষ তো পুজুরি বামুনের কাজ কাজ করে কাটালো । গোয়াবাগান বস্তিতে এক চিলতে এঁদো টালির চালের ঘরে বসবাস । পাঁচ ভাড়াটের সঙ্গে জলকল আলো নিয়ে লাঠালাঠি চুলোচুলি করে মানুষ হলো । দর্শনে মামুলি।পড়াশোনায় তথৈবচ। ক্লাসের সব চাইতে অমনোযোগী ছাত্র । ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর মাস্টার মশাইয়ের ত্রস্ত হাত যখন সুদকষা কিংবা গতিবেগের সমস্যাগুলির সমাধানে ব্যস্ত ঠিক তখনই সেই ছেলের উদাস দৃষ্টি জানলা ভেদ করে চলে গেছে উঠোনের ওই বড় নিমগাছের সবচেয়ে উঁচু ডালগুলোতে । যেখানে ফাগুন হাওয়ায় কচি পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপছে । কিল চড় থাপ্পড় নিলডাউন অথবা কান ধরে ওঠবসের মতন গ্লানি ও অপমানজনক শাস্তি পেয়ে সে অম্লানবদনে হাসতে পারে । এসব ঘটনা মনে পড়লেই সূর্যর কথায় সায় না দিয়ে পারা যায়না । তাই সৈকতের সাহায্য চাইতে আসার কারণটা কি একবারের জন্যেও জানতে ইচ্ছে করেনি রাজকুমারের , সেটাকে গৌণ করেই দেখেছিল । কিন্তু যে সরল সমীকরণ সে উপনীত হয়েছিল সেখানে চিড় ধরল অচিরেই ।

৪.

প্রায় মাস দু'য়েক বাদে , সময় তখন রাত দশটার কাছাকাছি ।একতলায় নিজের অফিসে কাজে ব্যস্ত ছিল রাজকুমার । হঠাৎ দরজার দিকে নজর পড়লো ।পুরনো আটপৌরে শাড়ির নীচে একজোড়া ধুলোমাখা মেয়েলি পা যেন থমকে আছে কিসের অপেক্ষায় । চোখ তুলে তাকাতেই মেয়েটি বলল 
- নমস্কার , আমার নাম শ্যামলী ঘোষাল ।
রাজকুমারের কপালে প্রশ্নবোধক চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই আগন্তুক আবার বলল 
- আমাকে আপনার চেনার কথা নয় । আমি সৈকত ঘোষালের ছোট বোন । না না আপনার আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।আমি এখন কোন সাহায্য চাইতে আসিনি ।আপনি বলার আগেই আমি নিজে থেকে চলে যাব । তাড়িয়ে দেবার কোন প্রয়োজন হবে না । শুধু কয়েকটা কথা বলার ছিল,একটু সময় হবে ?এই ধরুন মিনিট দশেক। খুব অসুবিধা যদি না থাকে তাহলে... 

সহসা এই ধরনের কথা শুনে এতটাই অপ্রতিভ হয়ে পড়ল রাজকুমার যে প্রতি নমস্কার জানাতে ভুলে গেলো সে কোন প্রকারে জড়তা কাটিয়ে উঠে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল বসুন । কাছে এগিয়ে এসে বসলো শ্যামলী । ছিপছিপে দোহারা  চেহারা , লম্বা কেশ, সম্পূর্ণ নিরালংকার। প্রসাধনবিহীন মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম শাড়ির আঁচলে মুছে কাঁধ থেকে ঝোলাটা নামলো সে । দাদার মতন কাপড়ের ব্যাগে রাজ্যের কাগজ । তার দাদাকে জল চেয়ে খেতে হয়েছিল ; তার ক্ষেত্রে সেরকমটা হলো না । গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে রাজকুমার প্রশ্ন করল 
- কিন্তু আপনি এ কথা বলছেন কেন বলুন তো ?
- বলছি কি আর সাধ করে ! বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষকে অনেক প্রাকটিক্যাল করে তোলে রাজকুমারবাবু ।সেই অভিজ্ঞতা থেকে বললাম । আজ সকালে পার্ক প্লাজায় গিয়েছিলাম ,  সূর্যবাবুর অফিসে । রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা আমাকে দেখাই করতে দিলেন না জানেন ! আসলে দোষটা তো আমারই । ঐরকম একটা আল্ট্রা মর্ডার্ণ এ্যান্ড সুপার স্পিডি জায়গায় আমি যে কতটা বেমানান সেটা বোঝা উচিত ছিল । তাছাড়া বারবার বিরক্ত করলে আপনাদের মতন কাজের মানুষদের তো অসুবিধা হওয়ারই  কথা । রাজকুমারের নীরবতা তার বিমূঢ় অবস্থার সাক্ষী দিচ্ছিল । শ্যামলী পুনরায় যোগ করল আপনার আর সূর্যবাবুর কাছ থেকে দাদা দু' হাজার টাকা করে নিয়েছিল । আসলে সেই সময় আমাদের কাছে কোনো কনট্র্যাক্ট  ফর্ম ছিল না তাই । এই নিন ধরুন ... 
এই বলে ঝোলা থেকে দু'টো হাফ ডিমাই সাইজের পত্রিকা বের করে টেবিলের উপর রাখল সে । প্রচ্ছদের উপরের দিকে তিনটে তুলোর মতো মেঘের ছবি ; মাঝে বড় বড় হরফে লেখা আকাশ : সান্মাসিক সাহিত্য ও শিল্প পত্রিকা ,পরিচালনায় নৈঋত যাত্রী । হাতে তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ল 'শ্রী রাজ কুমার বসু এবং শ্রী সূর্যশেখর চৌধুরী এই দুইজন সহৃদয় ব্যক্তির কাছে আমরা বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি । তাঁদের আশীর্বাদ ও আর্থিক সাহায্য ব্যতীত আকাশের বর্তমান সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হতো না ।' 
রাজকুমার কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই শ্যামলী বলল 
- নৈঋত যাত্রী নামে আমাদের একটা সংগঠন আছে । আমরা সবাই মিলে সেটা চালাই । দাদা হলেন এর মূল কান্ডারী । তবে আরও অনেকেই আছেন । সারা বছর ধরে আমাদের বহুবিধ কর্মসূচি থাকে । এই আকাশ পত্রিকা প্রকাশ করা তার মধ্যে অন্যতম । এটা একটা সম্পূর্ণ শিশু-কিশোর পত্রিকা । ছোটরাই গল্প কবিতা লেখে , ছবি আঁকে । আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন । এই পত্রিকা ওদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয় , এটা প্রকাশ করতে না পারলে ওরা ভীষণ মুষড়ে পড়তো । তাই নিরুপায় হয়ে আপনাদের কাছে আসা । 
প্রসঙ্গ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে রাজকুমার বলল 
- ওসব কথা থাক । আপনাদের কর্মসূচিতে আর কি কি আছে বলুন তো । 
বেশ আগ্রহী ভাব দেখালো রাজকুমার । এবার দ্বিগুণ উৎসাহে শ্যামলী ঝাঁপি খুলে বসলো । বললো 
- ফুটপাতের বাচ্চাদের নিয়ে আমরা একটা অবৈতনিক স্কুল শুরু করেছি । অবৈধ ভাবে জবরদখল করা জলাজমি পুনরুদ্ধার করে সেটা পরিষ্কার করে ফুলের নার্সারি তৈরি করা হয়েছে । বছরে একবার রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয় । এছাড়া ছোটদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও সমাজচেতনা বোধ জাগাতে বিজ্ঞান মেলা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় । এবার ইচ্ছে আছে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরী তৈরি করার । 
- সবই তো বুঝলাম কিন্তু এই বিরাট পরিকল্পনার জন্য তো অনেক টাকার প্রয়োজন !আপনারা কি সরকারি তরফে কোন সাহায্য বা অনুদান... ?
- উঁহু না না একেবারেই নয় ।এ ব্যাপারে দাদা মোটেই আগ্রহী নন।  বরং বলা যেতে পারে ঘোরতর বিরোধী । আমাদের ঠিক চলে যায় । আপনাদের মতন স্বহৃদয় মানুষজনের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসাকে পাথেয় করে পথে নেমেছি । 
কিছুক্ষণ চুপচাপ , আবার শ্যামলী খেই ধরলো ।  
- কি ভাবছেন ? 
- হুম্ ভাবছি শুধুমাত্র ছোটদের একটা পত্রিকার জন্য সৈকত এতটা পথ হাঁটাহাঁটি করলো ! যেন সব দায় ওর ! আচ্ছা এতে ওর ইন্টারেস্ট কি ? 
- আপনি ব্যাপারটা এভাবে দেখছেন কেন , মানুষের জন্য কিছু করাটা দাদা তার জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন আর দায়-দায়িত্বের কথা বলছেন ? ওটা আপনা থেকেই কাঁধে তুলে নিতে হয় । আপনি আমাদের জায়গায় থাকলে আপনিও তাই করতেন নাকি ? যাক সে কথা আপনার অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম তার জন্য দুঃখিত । 

নিয়মমাফিক বিদায় নিতে চেয়েছিল সে,কিন্তু রাজকুমার একপ্রকার জোর করেই তাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে বলে সঙ্গ নিল । প্রায় মোড়ের কাছাকাছি এসে রাজকুমার বলল 
- খুব ভালো লাগলো জানেন আপনাদের কথা জেনে । তবে আরো ভাল লাগতো যদি সৈকত নিজে আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো । 
- ঠিক বলেছেন , কিন্তু উপায় ছিল না জানেন । দাদা এখন কলকাতায় নেই । 
- কেন কোথায় গেছে সৈকত ? 
- মুর্শিদাবাদ । 
- হঠাৎ ? 
- হ্যাঁ হঠাৎই যেতে হলো । ভগবানগোলা ব্লকের একটি ছেলে এবছর মাধ্যমিকে প্রথম দশ জনের মধ্যে স্থান পেয়েছে । যে ছোট্ট স্কুলটিতে পড়ে সেখানকার মাস্টারমশাইরা এতটা আশা করেননি। ছেলেটির মা বাড়ি বাড়ি ঘুঁটে বিক্রি করে ওকে মানুষ করেছে । আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ছেলেটির হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে । জানি যথেষ্ট নয় তবে আমাদেরও তো সাধ্য খুব সীমিত । তাই যতটুকু সম্ভব হয় সামান্য কিছু সহযোগীতা করা এই আর কি  । 
- কিন্তু খবরটা আপনারা পেলেন কিভাবে ? 
- কেন পাঁচদিন আগেই তো আনন্দবাজারের শিক্ষাসংক্রান্ত পৃষ্ঠায় খবরটা ছিল ! আপনারা অন্য কাগজ রাখেন বোধহয় ? 

বাড়িতে ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে তিনটে কাগজে এলেও এই ধরনের আপাত লঘু সংবাদের প্রতি তার অনাগ্রহ বরাবরের । রাজকুমারকে অধোবদনে থাকতে দেখে শ্যামলী বলল 
- ওহো খুব ভালো কথা মনে পড়েছে । রাজকুমারবাবু আগামী রবিবার সন্ধ্যায় আমরা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করব । এলাকায় কৃতী ছাত্রছাত্রীদের হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া হবে আর আমাদের অঞ্চলের প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রীমহাদেব সান্যালকে সংবর্ধনা জানানো হবে । যদি সময় পান তাহলে একটিবার ঘুরে আসবেন কি ? এই নিন দু'টো কার্ড রাখুন । সূর্য বাবুকে তো আর নিজের হাতে পত্রিকাটা তুলে দেওয়ার সৌভাগ্য হলো না , এই নিন আপনার সঙ্গে দেখা হলে দিয়ে দেবেন প্লিজ । অনেক রাত হলো আমাকে অনেক দূর যেতে হবে । চলি ,নমস্কার। 

৫.

চলে গেছে শ্যামলী । কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে তবু যেন তার রেশটুকু রয়ে গেছে । রাত সাড়ে দশটার প্রায় নির্জন হয়ে আসা এ পি সি রোড এর প্রান্ত ধরে শ্লথগতিতে ফিরছিল সে । হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো , হাতে ধরে থাকা আকাশ পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় নজর গেল ।রাস্তার সুউচ্চ আলোকস্তম্ভ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়া হলদে বেগুনি মায়াবী আলোতে সে দেখতে পেল জ্বলজ্বল করছে কিছু শব্দমালা । 

আমি সৈকত আমি সৈকত সুবিস্তৃত প্রশান্ত বক্ষ আমার সহস্র বালুকা রাশির ঐকতান আছে যত দুরন্ত ঘূর্ণি আর আছে যত দামাল তরঙ্গের ফণা লুটায় আমার তটে মুছে দেয় প্রাচীন পদাঙ্ক কত শত 
সৃষ্টি হয় নব নব তাল বাদ্যের সংগীত 
আছি আমি আছি তোমাদের তরে শৈশবে আমার বক্ষ পরে গড়ে তোল স্বর্ণ সিংহাসন 
যৌবনের মধুর স্মৃতি নিয়ে যাও কিছু কিছু 
কুড়ায় ঝিনুক শঙ্খ দুই চারিটি বার্ধক্যেও আছে আহ্বান 
নব প্রভাতের সূর্যোদয়ের সাক্ষী হওয়ার তরে 
দিনান্তের হিসাব মিলায় 
তোমরা ফিরে যাও নিজ নিজ ঘরে আমি ছিলাম আছি 
একাকি শত সহস্রাব্দ ব্যাপী সম্মুখে আমার আছেন রত্নাকর । 

কি করবে এখন রাজকুমার? যে সৈকতকে সহপাঠী হিসাবে মেনে নিতে ঘৃণা বোধ হতো তার, লজ্জা পেত এমন একটা রদ্দি মার্কা স্কুলে ছাত্র জীবনে প্রথম অধ্যায়টা কাটাবার জন্য সেই সমস্ত কারণেই কি সে এখন গর্ববোধ করবে ? সে যে ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আর সৈকত যে মুক্ত ভূমিতে বিচরণ করছে এই দু'য়ের মাঝে বিস্তর ফারাক।যোগসূত্র স্থাপনের সেতুটা আজ বড় জীর্ণ,ভগ্নদশাগ্রস্থ। এই সেতুটি পুনঃনির্মানে কি কি উপাদান লাগবে ?কত খরচ পড়বে প্রতি বর্গফুটের? শহরের প্রতিষ্ঠিত স্থপতি রাজকুমার বসুর ঝাপসা হয়ে আসা বিস্ফারিত চোখের সামনে ভিড় করে আসতে লাগল অনেকগুলি প্রশ্নচিহ্ন।  

সাহিত্যিক সুদীপ পাঠক 
মধুগড়, দমদম, কলকাতা





0 Comments