কুলধারা
১.
অশুদ্ধ উচ্চারণ আর ভুল হিন্দিতে দিব্বি ভাব বিনিময় চলে যাচ্ছে।আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কাম গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম,"ললিতজি,অব হাম কঁহা যা রহা হুঁ?"
ললিত গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলে,"কুলধারা সাব। "
"কুলধারা!কিঁউ?ওঁহা পে কেয়া হ্যায়? "
"কুলধারা এক ভুতো কি গাঁও, সাব। "
ভূতের অস্তিত্বে আমাদের কারো বিশ্বাস নেই। সবাই মিলে রে রে করে উঠল। "না না, ওসব ভূতের গাঁ টা দেখে একটা দিন নষ্ট করতে চাই না। তার চে' চলো,সোজা বালিয়াড়ীতো জিপ সাফারি করি। "
বলি,"তা মন্দ না। "
ললিত গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,"সাব,আপকা মর্জি। তবে ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন যে দিনটা মোটে ও নষ্ট হলো না। "
সবার আপত্তি আর আর নিতান্ত অনীহা সত্ত্বেও ললিতজির আগ্রহে রাজি হয়ে গেলাম।সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজেরও একটু কৌতুহল হচ্ছিল বইকী।
বললাম,"বেশ চলো। "
তারপর মজা করে বলি,"ওখানে দু'একটা ভূত দেখতে পাবো তো ললিতজি? "
ললিত বলে,"নহী সাব,দিনের বেলা থোড়ি ভূত দেখা যায়! "
যাই হোক,ললিতজির মোটরে চেপে 'ভূতের গাঁও'এর উদ্দেশে রওনা হলাম। রাস্তার দু'পাশে রুক্ষ মরুভূমির বুকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বাবলা জাতীয় কাঁটাগাছের ঝোপ। ঊষর কঠোরতায় আচ্ছাদিত এমন ভূমিতে এসব উদ্ভিদের বেঁচে থাকার রসদ কোথা থেকে আসে ভাবলেও মনে বিস্ময় জাগে। তবুও বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির অনাবৃত নীরস রূপের মাধুর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি। কয়েকটা বনময়ূররী আর হরিণ খাদ্যান্বেষণে ব্যস্ত। গাড়ির সামনে দিয়ে একটা নীলগাই দ্রুত রাস্তা পারাপার করল। ঘন্টা দুই পর আমরা অবশেষে কুলধারায় এসে পৌঁছলাম। ওখানে গিয়ে আর একপ্রস্থ বিস্ময়ের পালা।
২.
আমাদের গাড়ি প্রস্তর নির্মিত এক তোরণদ্বারের সামনে এসে দাঁড়াল। দেখলাম ফটকের অভ্যন্তরে যেন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া এক ক্ষুদ্র সামন্ত রাজার রাজধানী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে থাকা টিকিট ঘর থেকে টিকিট কেটে কুলধারায় প্রবেশ করলাম।
চারিদিকে ছোট বড়ো নানাধরণের পাথুরে বাড়ির ধ্বংসস্তুপকে দু'পাশে রেখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। যতদূর চোখ যায় দেখি কাঁটঝোপের মাঝে মাঝে শুধু পরিত্যক্ত ভগ্ন ঘর। প্রায় এক কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করে অবশেষে আমরা এক প্রাসাদের (বলা যায় অনতি উচ্চ দ্বিতল গুচ্ছ অট্টালিকা) সামনে এসে উপস্থিত হলাম।
নানা কারুকার্য- খচিত ছোট ছোট দ্বিতল অট্টালিকাগুলি যেন এক অভিজাত রাজপরিবারের গৌরবময় দিনগুলির সাক্ষ্য আজও বহণ করে চলেছে। জনহীন অধুনালুপ্ত জনপদটির অন্য সমস্ত গৃহগুলি ভূমিসাৎ হয়ে গেলেও সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত অট্টালিকাগুলি রাজকীয় মর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
রাস্তা পেরিয়ে কয়েকটা ধাপ উপরে মার্বেল পাথরে বাধানো প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের তিনদিক দ্বিতল অট্টালিকা দিয়ে ঘেরা।মাঝখানে সুন্দর এক দোলমঞ্চ। ঘুরতে ঘুরতে নিজের অজান্তেই ক্লান্ত পায়ে একসময় দোলমঞ্চে বসেপড়েছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো এই পরিবারের আরাধ্য দেবতা ছিলেন কিষণজি।আমার মানস চক্ষে ভেসে উঠল রাজপুত রমণীদের হোলী উৎসবের লোকনৃত্য,আর শ্রবণে অনুরণিত হতে থাকলো রাজস্থানী লোকসঙ্গীত। না জানি এই প্রাসাদের প্রতিটি কুঠুরিতে, অলিন্দে লুকিয়ে আছে নানা মুহূর্তের কতো হাসি -অশ্রু,আনন্দ-বেদনার কাহিনী।
দোলমঞ্চের ওপর বসে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম এক সুদূর ইতিহাসের অধ্যায়ে। এক কল্পজগতে এমন গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে ললিতের উপস্থিতিও টের পাই নি। ওর ডাকে চমকে গিয়ে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।
"চলিয়ে সাব,সবলোগ গাড়িকা অন্দর বৈঠ্ গয়া। "
"হাঁ, চলিয়ে। "
সামনে একটা প্রস্তর ফলকে কিছু লেখা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম ।শিলার ওপর এই গ্রামের সৃষ্টি ও ধ্বংস সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। তবে তাও জনশ্রুতি বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
৩.
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও রাজস্থানের উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় গলা শুকিয়ে কাঠ। পথের ধারে সেনাবাহিনীর ভ্রাম্যমান সোডা স্টল দেখে ললিতকে বললাম, "চলো ললিতজি,এক গ্লাস করে ঠাণ্ডা সোডা খাওয়া যাক। "
গাড়িতে উঠতে উঠতে ললিত বলে,"এখানে বিকেল পাঁচটার পর থাকা নিষেধ। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। "
পাঁচটা বাজতে দেরি নেই। তাই আমরা কুলধারাকে বিদায় জানিয়ে পরবর্তী গন্তব্য মরুভূমির টেন্টের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। গাড়িতে বসে পরিহাসছলে বললাম,"ভূতের গাঁয়ে এসে একটা ভূতেরও তো দেখা মিলল না ললিতজি! তাহলে রাত্রে না হয় একবার এসে ভূতেদের সাথে মোলাকাত করে যাই? "
ললিতের আবার এসব মজা পছন্দ নয়। তাই গম্ভীর হয়ে বলে, "মজাক কা বাত নেহি সাব। রাত্রে এখানে ঢোকা নিষেধ। তাই বলে কেউ যে কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে আসেনি তা নয়। আর ভূতেদের সাথে তাদের মোলাকাতও হয়েছে। কিন্তু জীবিত অবস্থায় কাউকে ফিরে আসতে দেখা যায়নি।"
এখানকার অধিকাংশ মানুষ এই ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। জায়গাটা ভারত -পাকিস্তানের বর্ডারের কাছাকাছি বলেই হয়তো এতো রেস্ট্রিকসন্, এতো সতর্কতা। সেনাবাহিনীর কড়াকড়ি না থাকলে হয়তো এই পরিত্যক্ত জনপদটি জঙ্গী আর দুর্বৃত্তদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠত!
ড্রাইভারকে বললাম,"তা তো না হয় হলো, ভূতের গাঁয়ের গল্পতো কিছুই শোনা হলো না ললিতজি? "
"কহানি শুনবেন সাব?মগর এ তো কহানী নয়,ইতিহাস।"
এরপর ললিতজি আমাদের যে গল্প শুনিয়েছিল তার সঙ্গে প্রস্তরফলকে লিপিবদ্ধ বিবরণের অনেক মিল। তবে সেও বাস্তব ও কল্পনার মিশেল।অবশ্য বাস্তবও কল্পনার রসে জারিত হয়েই তো গল্পের সৃষ্টি। ললিত গাড়ি চালাতে চালাতেই গল্প বলা শুরু করল।
"সাব আজ থেকে প্রায় তিন'শ বছর আগে কুলধারা একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। তারও কয়েক শত বছর আগে,আনুমানিক বার'শ নব্বই সালে পালীওয়ালী ব্রাম্ভণগণ এই গ্রাম পত্তন করে।তাদের আদি নিবাস ছিল যোধপুর রাজ্যের অন্তর্গত পালী। যোধপুরের মহারানা অত্যধিক পরিমানে যুদ্ধ কর ধার্য করার জন্য অতিষ্ঠ হয়ে পালী ত্যাগ করে জয়সলমীর রাজ্যের অন্তর্গত এই স্থানে বসতি স্থাপন করে।গ্রামের নামকরণ করে 'কুলধারা।'
আমি বলি,"কুলধারা মানে তো বংশের রীতি,তাই না।"
"হাঁ জী। শুনিয়ে সাব,ব্রাম্ভণ জমিদারদের সহগমনকারী কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কালক্রমে কুলধারা হয়ে উঠল শস্য শ্যামলা এক সমৃদ্ধশালী জনপদ।প্রচুর পরিমাণে বাজরা,মকাই ফলাত। নীরস মরুভূমির জীপসাম খনির গর্ভে মজুদ অঢেল জলের সন্ধান পেল। পশুপালকেরাও পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ আর পশম যোগান দিতে থাকল।ধীরে ধীরে কুলধারাকে কেন্দ্র করে আরো চুরাশিটি গ্রাম গড়ে তুলল ব্রাম্ভণ জমিদার।"
আমি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, "চুরাশিটি গ্রাম !তা এরকম যথেচ্ছভাবে গ্রাম গড়ে তোলা নিয়ে জয়শলমীর অধিপতির সঙ্গে কোন বিরোধ বাধেনি? ক্ষুব্ধ হননি তিনি? "
ললিত বলে,"ক্ষুব্ধ হবেন কেন!তার অনুমতি নিয়েই তো গ্রাম স্থাপন করেছিল।বরং প্রসন্নই ছিলেন।"
"কেন?"
"কৃষি ও বাণিজ্যে পালীওয়ালী ব্রাম্ভণদের প্রচুর পরিমাণে অর্থাগম হচ্ছিল।তাই রাজ্যের রাজস্ব আদায় হতো অপর্যাপ্ত।নিয়মিত খাজনা দিতেন জমিদার।"
"তাহলে ললিতজি,পালীওয়ালী ব্রাম্ভণদের এখানে বেশ নির্বিঘ্নেই দিন কেটে যাচ্ছিল বলছো? "
"হাঁ সাব। সুখ শান্তিতে বহুযুগ কেটে গেল পালীওয়ালী বংশের। "
"তাহলে এভাবে ধ্বংস হলো কী করে? "
"কথায় বলে সুখ কখনো চিরস্থায়ী হয়না। ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে দুর্দিনের কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো কুলধারার আকাশে। "
"সে কি ওই জয়শলমীর রাজ্যের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী,সালিম সিংহের কারণে?"
প্রস্তরফলকে সালিম সিংহের জন্যই যে কুলধারার এই পরিণতি,সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ললিত আমার কথায় সায় দেয়।,"জী সাব।"
৪.
ললিত একটু দম নিয়ে শুরু করে।
"এখানকার মৌসম যে কতখানি নির্মম, কৃপণ তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না ।কোন কোন সাল বারিষ মরশুমে বাদল হয়না বললেই চলে। পিনেকা পানি ভি নহী মিলতা। ঊনিশ শতকের শুরুতে পর পর দো সাল বিলকুল খরা হয়ে গেল। কোন ফসল হলো না। মানুষের পেটে টান পড়ল।তার ওপর সালিম সিংহ মাত্রারিক্ত কর ধার্য করল। তৎকালীন কুলধারা প্রধানের পক্ষে রাজ্যের প্রাপ্য খাজনা মেটানো অসম্ভব হয়ে উঠল।
"কু্লধারা প্রধানের নাম কি ললিতজি? "
ললিত একটু ভেবে বলে,"নাম! অভি তো মালুম নেহি।
এদিকে রাজস্ব না পেয়ে সালিম সিংহ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তার নির্দেশে সেনারা বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে লুঠতরাজ, অভুক্ত গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার হত্যালীলা চালাতে থাকল। স্ত্রীলোকদের সম্ভ্রমহানি করল।অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বহু মানুষ দেশত্যাগী হলো। "
এই ঘটনানুভাবুকতায় বিহ্বল হয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলি,"কুলধারা প্রধান কোন প্রতিবাদ করল না?"
"তার ক্ষমতা কতটুকু! তবুও সালিম সিংহের কাছে গিয়ে প্রজাদের ওপর অত্যাচার ও খাজনা মকুবের আর্জি জানালো। বহু আবেদন নিবেদনেও তা গ্রাহ্য হলো না। নিরাশ হয়ে জমিদার যখন আসন ত্যাগ করতে যাচ্ছেন, তখন ধূর্ত সালিম সিংহ একটি অত্যন্ত অসম্মানজনক প্রস্তাব দিল। "
আমি বলি,"অসম্মানজনক প্রস্তাবটা কী? "
"সালিম সিংহ বলে,মোগল সেনাপতি জালালউদ্দিন বাদশা সংবাদ পেয়েছেন, জমিদারের একটি বহুত খুবসুরৎ দ্বাদশবর্ষীয়া লেড়কি আছে। মোগল সেনাপতি তার পাণিপ্রার্থী।তার এই প্রস্তাব মেনে নিলে জমিদারের আবেদন মঞ্জুর তো হবেই উপরন্তু তাঁকে কয়েকটি নিষ্কর গ্রাম ভেট দেওয়া হবে।
সালিম সিংহের এই কদর্য অবমাননাকর উক্তি যেন উত্তপ্ত গলিত ধাতবের মতো জমিদারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। ঘৃণায় অপমানে ব্রাহ্মণের শরীরের সমস্ত উষ্ণ রক্ত মাথায় এসে জমা হল। রাজপুত ব্রাম্মনের কাছে এতবড় অসম্মান আর কিছু হতে পারে না। বিধর্মী তো দূরের কথা, তা সে যতই ক্ষমতাসীন মানুষ হোক না কেন, স্বজাতীয় ব্রাম্ভণ ব্যতিত অন্য কোন বংশে কন্যা সম্প্রদান করার অর্থ বংশমর্যাদা ও কুলাচারের ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত। ক্রুদ্ধ পালীওয়ালী ব্রাম্ভণ প্রধান দৃঢ় কণ্ঠে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে সভাকক্ষ ত্যাগ করলেন।
প্রবল পরাক্রমশালী মন্ত্রীও জমিদারকে একটা রাত ভাবার সময় দিল। পরদিন সকালে সম্মতিজ্ঞাপক উত্তর না পেলে কন্যাকে বলপূর্বক অপহরণ করা হবে বলে চূড়ান্ত অভিমতটিও জানিয়ে দিল।"
৫.
ললিতের গল্প বলার মুন্সিয়ানায় আমি বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। তার ব্যাখ্যানে সালিম সিংহের ক্রূরতা আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছিল। ললিত যেমন ভালো ড্রাইভার তেমনি ভালো কথকও।গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে দিব্ব গল্প চালিয়ে যেতে পারে। মূর্খ মন্ত্রী নিশ্চিত ছিল,অনন্যোপায় জমিদার মাথা নত করে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু তার ভাবনা যে কতখানি অমূলক পরদিন সকালেই সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল।
সালিম সিংহের দরবার থেকে ফিরে এসে বংশমর্যাদা ও প্রাণরক্ষার বিষয়ে চরম সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলল কুলধারা প্রধান। পরিবারের সকলের সঙ্গে গোপন আলোচনায় স্থির হলো,সেই রাত্রেই তারা অন্যত্র চলে যাবে। রত্রির ঘন অন্ধকারে পরিবার পরিজন সহ চুরাশিটি গ্রামের মানুষ কুলধারা ত্যাগ করল।"
গল্পটা আমার কাছে এমন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল যে,আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ফেললাম,"যাক,শয়তানের হাত থেকে বাঁচলো তো!সেখান থেকে গেল কোথায়? "
"লোকে বলে ভূজে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল।লেকিন সাব সবাই বেঁচে গেলেও মরতে হলো জমিদার কন্যাকে।"
আমি অবাক হয়ে বলি,"কেন? "
"তাদের পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল। তবু মনের মধ্যে একটা সংশয়ের কাঁটা অবিরত খচখচ করছিল। "
"সংশয়! সংশয়টা আবার কীসের? "
"ধরা পড়ে গেলে বহু মানুষের মৃত্যু অবধারিত। কিন্ত রাজপুত মৃত্যুকে ভয় পায় না,ভয় পায় নারীর সম্মানহানির।ধরা পড়লে জমিদার কন্যার সম্ভ্রম ভূলুন্ঠিত হবে। কুলমর্যাদা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। বংশগৌরব কালিমালিপ্ত হওয়া অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয়। তাই সেই নিষ্কলুষ ফুলের মতো পবিত্র বালিকাটিকে জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করা হলো।বিনা অপরাধে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হলো সোনার প্রতিমাকে। "
আমি আঁতকে উঠে বলি,"না এ হতে পারে না!কেন ওরা এমন নিষ্ঠুর কাজ করলো?"
ললিত আমার প্রতিক্রিয়ায় কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়।
"বংশমর্যাদা ও নারীর সম্মান রক্ষা করতে এমন নির্মম কাজ এখানে অনেক হয়েছে, আজও হয়।"
৬.
ললিত আমার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ করে বলে,"তারপর কী হলো শুনুন সাব। পালীওয়ালী প্রধানের কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে ব্রাম্ভণ কন্যাকে জোর করে তুলে আনার জন্য জালালউদ্দিন বাদশা এক সেনাদল সহ কয়েকজন সর্দারকে কুলধারা পাঠাল। সেই শুনশান গ্রামগুলিতে কাউকে দেখতে না পেয়ে ক্ষিপ্ত সেনারা যথেচ্ছ লুঠতরাজ ও ভাঙচুর শুরু করল। ঠিক সেই মুহুর্তে এক অভাবনীয় অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল। হঠাৎ মেদিনি কেঁপে উঠল। জমিদারের প্রাসাদ ব্যতিত সমস্ত বাড়িঘর তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে নিমেষের মধ্যে ভেঙে পড়্ল।সেই ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে বহু মোগল সেনার মৃত্যু হল। এরপর থেকেই জমিদার কন্যার বিদেহী আত্মা তার অকাল মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য অপেক্ষা করে। "
ললিতের গল্পে আমার আর মনোযোগ ছিল না। আমি ভাবছিলাম পবিত্র ফুলের মতো সেই বালিকার কথা। কত স্বপ্ন ছিল তার চোখে !কমনীয় হৃদয়ে ছিল সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা!বিকৃত লালসার কু-দৃষ্টিতে পড়ে অকালে প্রাণ দিতে হলো। কী নিদারুণ যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে বাঁচার জন্য কত আকুলি বিকুলি করেছে!দগ্ধ হতে হতে হয়তো পরিত্রাহি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, 'আমার কী অপরাধ! আমাকে তোমরা মারছ কেন?মেরো না গো,আমাকে বাঁচতে দাও!'
0 Comments