অভিষেক ঘোষের চলচ্চিত্র সমালোচনা



কিওর (১৯৯৭) : চলচ্চিত্র সমালোচনা

ছবি : 'কিওর' (১৯৯৭)
পরিচালক : কিয়োশি কুরোসাওয়া ।

[  Cure (1997)
Dir. : Kiyoshi Kurosawa
Country : Japan.
Cast : Kōji Yakusho, Tsuyoshi Ujiki, Anna Nakagawa, Masato Hagiwara etc.  ]


প্রথাগতভাবে ‘হরর ফিল্ম’ আমাদের যেটা দিয়ে থাকে, তা হল — ভয়ের বিনোদন । নিম্নমেধার ছবি-তে সেই বিনোদনে লঘু কৌতুকমুখর অলৌকিকের সাথে মেশে যৌন সুড়সুড়ি । মধ্যমেধার ছবি মেশায় যৌন আবেদন ও বিক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ । আর সত্যিকারের ভালো ছবি এসবের উর্ধ্বে ! মনঃসমীক্ষণ-ই তার স্বভাব । সেখানে উপাদান থাকে যত্রতত্র, অথচ কোনোটিই নিজেকে জাহির করে না । অর্থাৎ ভয়ের উপাদানগুলি মিশে থাকে প্রতিটা ফ্রেমের সঙ্গে, আমাদের ক্ষণিকের বিনোদন দেওয়া সেখানে উদ্দেশ্য নয়, বরং আমাদের চোখ-কানের গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে উপাদানগুলি প্রবেশ করতে চায়, সরাসরি চেতনায় । এই অনুভূতি প্রায়শই বেদনাদায়ক । কারণ হামেশাই এই ধরণের ছবি আমাদের পাপবোধ, অবদমন, জিঘাংসা, তীব্র রাগ,অন্তঃসারশূন্য চাহিদাগুলির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে। ভুলগুলো কবর খুঁড়ে তুলে আনে,বেদনা জাগায়। স্বভাবতই তা সহনীয় নয়,কখনোসখনো। ফলে ছবিগুলি যতই অস্বস্তির কারণ হোক না কেন, আদিমতম ভয় জাগিয়ে তোলার অনুপম সার্থকতাতেই এই ছবিগুলি আমাদের সঙ্গে থেকে যায়।কিয়োশি কুরোসাওয়া -র (আকিরা কুরোসাওয়া-র সাথে এঁর কোনো সম্বন্ধ নেই) আলোচ্য হরর ছবি ঠিক এই অন্তিম শ্রেণিভুক্ত।
Kiyoshi Kurosawa-র ‘Cure’ (1997) শুরু হয় এক অ্যাসাইলামে — যেখানে ডিটেকটিভ কেনিচি তাকাবে (অভিনয়ে Kōji Yakusho)-র স্মৃতিভ্রষ্ট স্ত্রী ফিউমি চিকিৎসকের সামনে বসে একাগ্র মনে জার্মান লেখক Helmut Barz-এর ‘Bluebeard’ (মূলত ফরাসি লোককথা) পড়ছে । সে জানে না কখন কীভাবে সে ঘর থেকে অ্যাসাইলামে এসে পড়েছে । কিন্তু সে বইটা-র শেষে কি হবে, সেটা দিব্যি মনে করতে পারে । অর্থাৎ অবচেতন ও চেতন মনের সমান্তরাল অস্তিত্ব ও তার অন্তরালে শায়িত রহস্যের টোপ শুরুতেই ফেলা হয়ে গেল । এরপর ছবিতে একের পর এক খুন হয়ে চলে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা হত্যাকারীদের আবিষ্কার করি অকুস্থলেই । মৃতদেহের গলায় আঁকা ‘X’ চিহ্ন । হত্যাকারীরা নিজেরাও ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকবে এবং সমানে নিজেদের অপরাধ কবুল করবে এবং তীব্র অপরাধবোধে হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে । অথচ মনে করতে পারবে না, অপরাধের মোটিভ । আচ্ছা আপনার শরীরে বাসা বাঁধা ভাইরাসগুলি-কে যদি আপনি প্রশ্ন করেন, “কেন করলে এরকম ! বলো ?” — কী উত্তর পাবেন। নাথিং।তো সেভাবেই এই ছবিতে সমাজ-সমালোচনা—চিকিৎসাশাস্ত্রের নিষিদ্ধ থেরাপি—মনঃসমীক্ষণ একসূত্রে মিলেছে । প্রত্যেকটি মানুষ এমনই বিচ্ছিন্ন একে অপরের থেকে যে, ভাইরাসের আক্রমণ সহজতর হয় । সমাজটাও ফাঁপা, সারবত্তাহীন । তাই মানুষগুলোর ভিতরটা এতটা খালি যে অজগরের মত আর একটা মানুষের বেঁচে থাকার দাবি তাকে সমেত আত্মসাৎ করে, অনায়াসে গলায় খোদাই করে দেওয়া যায় ‘X’ চিহ্ন । ভায়োলেন্সের অভিঘাত ও এই ছবিতে যথেষ্ট পটুত্বের সাথে বুনে দিয়েছেন পরিচালক, তাতে বাড়তি মাত্রা এনেছে আলোর ব্যবহার ও ক্যামেরা কোণ ।
প্রথম হত্যার পরেই যেহেতু আমরা ইঙ্গিত পেয়ে যাই যে, রহস্য আছে —এর আড়ালে অন্য গল্প আছে, সেহেতু প্রথম হত্যার পরেই জনশূন্য সমুদ্রসৈকতে এক ভবঘুরে-কে দেখেও আমরা আঁতকে উঠি । সে তার পরবর্তী টার্গেটের দিকে যত এগোয়, আমরা তত অনুভব করি ‘Pure Fear’ । এখানেই ছবির সাফল্য। ছবি-তে কোথাও ভয় দেখানোর কোনো চেষ্টা নেই।আমরা শুধু উপাদানের উপস্থিতি অনুভব করলেই শঙ্কিত হয়ে পড়ি। সুচতুর পরিচালক ধীরে ধীরে হিপনোটিজম্-এর কায়দায়, আমাদের চেতনায় রোপন করে দিতে থাকেন সেইসব ভয়ের অঙ্কুর — অবচেতনের মাটির হদিশ পেলেই যা বেড়ে ওঠে। ছবিতে তৈরি হয় আশ্চর্য টানাপোড়েন।ঐ নামহীন চরিত্রটি সবাইকে সম্মোহন বা হিপনোটাইজড্ করে। তারপর হত্যা করায় ।আমরা বুঝি জল,আগুনের মত খাঁটি পার্থিব উপাদানগুলিই তার সম্মোহনের উপাদান বা টুলস্ । কিন্তু ছবির চরিত্রদের মতোই ঐ লোকটির সামনে আমরা অসহায় বোধ করি, ফাঁদে পা দিই । শরিক হই কখনো ডিটেকটিভের অনুসন্ধানী ও সংযমী চেতনার, আবার কখনো মূল অপরাধী কুনিও মামিয়ার (অভিনয়ে অসামান্য Masato Hagiwara) শান্ত, স্থির ক্রূর চালের । গুলিয়ে ফেলি, আমি নিজে ভালো না মন্দ বা, আদতে আমার কী হওয়া উচিত ! ছবিতে একটা দৃশ্যে ডিটেকটিভ ‘তাকাবে’-কে এক শূন্য দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি ক্যামেরার পার্শ্বিক কোনে । পরমুহূর্তেই কোন বদলে গেলে চমকে গিয়ে দেখি, মামিয়া ঐ দেওয়ালের অন্তরালে এক খুপরি-তে তাকাবে-র মুখোমুখি । চমকে উঠতে হয় । আশ্চর্য কৌশল । এমন চমক ছবিতে অসংখ্য । সেট নির্বাচন ও তার সাথে দর্শকের পরিচয় করিয়ে দিতে লং শট্ আর ক্যামেরার অবিচলতা-কে অপূর্ব ব্যবহার করেছেন পরিচালক । ‘Shibui’-ধর্মী জাপানি শিল্পরীতির সূক্ষ্মতা এই ছবির সবচেয়ে বড়ো শক্তি । প্রায় সব দৃশ্যই সাজেস্টিভ — প্রায় সব হত্যাও — মায় ক্লাইম্যাক্স-ও । ভিলেন মামিয়া মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, সে জার্মান মনোবিদ Franz Mesmer-এর কুখ্যাত সম্মোহনবিদ্যা ‘animal magnetism’-এর উপর গবেষণা করতে গিয়ে অবসেসড্ হয়ে পরে । তারপর সে তার প্রয়োগ শুরু করে । কিন্তু সে নিজেও কি ‘মেসমেরাইজড্’ হয় নি ? তার মুখ ঢেকে দেওয়া লম্বা চুলের আড়ালে চোখের উদাসীন দৃষ্টি আর পিঠময় বিরাট পোড়া দাগের যন্ত্রণা সম্পর্কে চরম উদাসীনতা বুঝিয়ে দেও, সেও নিজেতে নেই । কিন্তু কোথাও একটা তার প্রায়োগিক সাফল্যের আনন্দ বেঁচে ছিল চোখের কোনের হাসিতে,কুটিল প্রশ্নে। তাই যে যান্ত্রিক নয়, তাকে মরতেই হতো ।আর এই কৌশলটিই ছবিতে একটি তাত্ত্বিক অনুষঙ্গও সংযোজিত করে ।

এর বেশি বলা উচিত নয়, বললে ছবি দেখার মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে । শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে ছবিটা যেখানে শেষ বলে মনে হয়, তারপরও অনেক চমক অপেক্ষা করে থাকে । শুরু ও শেষের দৃশ্য বাদে গোটা ছবিটাই আবহসঙ্গীতহীন, বহু দৃশ্য সিনেমার ইতিহাসে ঢুকে যাওয়ার মতো চিত্তাকর্ষক । নির্মাণে অসম্ভব মুন্সিয়ানার জন্য পরিচালককেই কৃতিত্ব দিতে হয় । কারণ ছবিটা সেই অর্থে আধুনিক সিনেমার সমস্ত আলংকারিক সৌন্দর্য-কে বর্জন করে । সারল্য বজায় রেখেও ছবিতে আশ্চর্য জটিল আর অশুভ একটা ভয়ের অবয়ব ফুটে ওঠে ।এই চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চাইলে অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত এই ছবি। আর পরিচালকের দর্শন ও বিবর্তন বুঝতে চাইলে অতি অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত তাঁর আরেক সুবিখ্যাত ছবি ‘Pulse’ (Kairo, ২০০১) । ‘কাইরো’ আপনাকে আরো বেশি ভয় পাওয়াতে পারে,কিন্তু ঐ ছবির দ্বিতীয়ার্ধে যেভাবে চূড়ান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছবিটার ঘাড়ে ভর করে, তার ভূত ছবিটার যথেষ্ট ক্ষতি করেছে।তা-নাহলে ভয় দেখানোর মৌলিকতায় ঐ ছবিটাও সেরার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিযোগ্য ।

সমালোচক অভিষেক ঘোষ
কসবা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 


































1 Comments