
দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো- এক গভীর প্রশ্নচিহ্নের সামনে
ভারতীয় সংবিধানে সব রাজ্যগুলোকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি রাজ্য নিজেদের জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ও পুষ্টির মান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যেতে বদ্ধপরিকর হবার কথা। ১৯৮৩ সালে প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০০২ সালের পর আবার ২০১৭ সালে পরিমার্জিত হয়েছে। নতুন নীতিতে অসংক্রমনযোগ্য রোগের বর্ধিষ্ণু চাপ কমানো,স্বাস্থ্য শিল্পের উদবর্তন ও স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ কমানোর উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে,ভারতে অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবা বেসরকারি ক্ষেত্রেই প্রাপ্ত হয়। আর তা হয় মানুষের পকেটের পয়সা দিয়ে,উন্নত দেশগুলোর মত স্বাস্থ্যবীমা থেকে প্রাপ্ত সুবিধা থেকে নয়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ তে ভারতে জিডিপি র ৩.৮৯ শতাংশ ব্যয় হয় স্বাস্থ্য খাতে। এর মধ্যে সরকারি ক্ষেত্রের অবদান জিডিপি র মাত্র ১ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে খরচ হওয়া টাকার ৬৫ শতাংশ মানুষের পকেট থেকে হয়।
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এদেশে নিশুল্ক। সরকার এতে ভর্তুকি দেয়। সরকারি পরিষেবায় মোট যত রুগি চিকিৎসা পায়,তার মধ্যে ১৮% লোক বহির্বিভাগে এই সুবিধা পান ও ৪০% এর মত রোগী ভর্তি হন এই সুবিধা পেতে। এতে পরিষ্কার যে সাধারণ, নিম্নবিত্তরাই সরকারি ব্যবস্থার উপর বেশি নির্ভর করেন। অপরদিকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা বেসরকারি ব্যবস্থাপনার উপরেই বেশি ভরসা করে থাকেন। তার প্রধান কারন অবশ্যই সরকারি ব্যবস্থায় পরিষেবার অপ্রতুলতা ও নিম্ন মান। দেখা যায় প্রায় ৩০০০০-৪০০০০ জন লোকের জন্য বরাদ্দ একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল। সেক্ষেত্রে মানের আশা করাটাও বিলাসিতা মাত্র। অর্থাৎ যে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন কঙ্ক্ষিত ছিল,তা আজ অবধি হয়ে ওঠে নি। এর সাথে যুক্ত হয় ডাক্তার, নার্স,যন্ত্রাদির অভাব ইত্যাদি অর্থাৎ পরিকাঠামোগত ঘাটতি। কোন কোন ক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের যোগসূত্রের অভাব অগ্নিকুন্ডে ঘৃতাহুতি দেয়। জনস্বাস্থ্যের সাফল্যের জন্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য ও সস্তা হওয়াটা খুব জরুরি। সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের নির্ভরতাও এই দুটি কারণেই। কিন্তু ন্যুনতম পরিষেবার অভাব সেই উদ্দ্যেশ্যটাকে সফল হতে দেয়নি। ২০০৫ সালের পর থেকে দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রচুর সংযোজন হয়েছে।দেশের মোট হাসপাতালের ৫৮%, শয্যা সংখ্যার ২৯% ও মোট ডাক্তারের প্রায় ৮১% বেসরকারি ক্ষেত্রে। জাতীয়স্তরের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের ৭০% ও গ্রামাঞ্চলের ৬৩% মানুষ বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান খরচ ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ কেন,অনেক উচ্চ-মধ্যবিত্তদের পক্ষেও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারি হিসেবে যেখানে শুধুমাত্র ১৭% মানুষ স্বাস্থ্যবীমার আওতায়, সেখানে আকাশছোওয়া চিকিৎসার ব্যয়ভার মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ১৯৯৫ সালে ভারত TRIPS চুক্তিতে সাক্ষর করে। ফলে যেকোন কম্পানি ফি দিয়ে কোন অসুধ বানাতে ও তার পেটেন্ট নিতে পারে।অনেক এন্টিবাইওটিক যেগুলো অনেক দেশে নিষিদ্ধ, সেগুলোও এখানে দিব্যি চলছে রমরমিয়ে।
যে প্রধান সমস্যাগুলি ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রকট, সেগুলি হলো-
১। সচেতনতার অভাব রয়েছে গোটা দেশজুড়ে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। আর এই অভাব সবচাইতে বেশি প্রভাব ফেলে গর্ভবতী মা, শিশু ও নারী স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে। সরকার বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করা সত্বেও এখনো বাড়িতে প্রসব করাতে গিয়ে অনেক মায়ের প্রাণ যায়। কাজেই সচেতনতা সব স্তরেই বাড়ানো অতি আবশ্যক।
২। স্বাস্থ্য সুবিধা মানুষের কাছে পৌছনোর ক্ষেত্রে বাধা। উপলব্ধ সুবিধা আর প্রাপ্তির মধ্যেকার শূন্যস্থান এখনো পুরণ করা যায়নি। এর কারণ আর্থিক, সামাজিক অনেক রকমের বাধা।
৩৷ মানব সম্পদের তীব্র অভাব। আজ অবধি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যথেষ্ট ডাক্তার,নার্স,স্বাস্থ্যকর্মী কোনটাই তৈরি করা যায়নি। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার সঙ্গে অপ্রতুল লোকবল দিন দিন সমস্যা বাড়িয়েই গিয়েছে। যে লোকবল আছে স্বাস্থ্যব্যবস্থায়, তারও সঠিক বন্টন করা হয়নি। এখনো যে কোন মেডিকাল কলেজ চলে জুনিয়র ডাক্তারদের সেবায়।
৪।চিকিৎসার লাগামছাড়া খরচের বহর মানুষের গলায় ফাঁসের মত চেপে বসছে। সেক্ষেত্রে সরকারি কার্যকরী কোন নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়না। ফলে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এক লাগামহীন লাভদায়ক ব্যবসায় পরিণত হয়ে উঠছে।
৫৷ দায়বদ্ধতার অভাব ভীষনভাবেই দেখা যায় সর্বস্তরে। কাজের চাপের কথা মাথায় রেখেও এই দায়বদ্ধতা কিয়দংশেও যদি দেখান যেত, স্বাস্থ্যের হাল হয়ত এতটা অস্বাস্থ্যকর হতনা।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু সাম্প্রতিক সংস্কারমুলক পদক্ষেপ করা হয়েছে।
ভারত সরকার জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের মাধ্যমে National Health Portal এর ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছে। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে National eHealth Authority(NeHA) র উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যার ডিজিটাল কার্ডের মধ্যে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সঞ্চিত থাকবে। দ্বাদশ পরিকল্পনায় National Rural Health Mission প্রবর্তন করা হয়েছিল।যেখানে গ্রামীন এলাকায় স্বাস্থ্য পরিসেবাকে আরো বেশি লোকের কাছে পৌছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় । যদিও তার খুব বেশি প্রভাব এখনো দেখা যায়নি।একইরকম ভাবে National Urban Health Mission চালু হয় ২০১৩ তে। কিছু সামান্য পরিকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন রোগী আনা-নেওয়ার ব্যবস্থাদি, ন্যুনতম কিছু ওষুধপত্র প্রদান ছাড়া তেমন কিছু উন্নতি হয়নি।
উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে আয়ুস্মান ভারত বা Pradhan Mantri Jan Arogya Yojana(PMJAY) প্রকল্পে। NITI আয়গের পরামর্শে একটা সার্বিক স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্প রূপায়ণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
ক। প্রায় ৫০ কোটি মানুষের জন্য এই প্রকল্পে আগামী ১০ বছরে ৬.৪০ লক্ষ শয্যার প্রয়োজন হবে। এই মুহূর্তে দেশে মোট ১৪৩৭৯টি হাসপাতালে ৬.৩৪ লক্ষ শয্যা আছে। টিয়ার ২ ও টিয়ার ৩ শহরগুলোর ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালের ভুমিকা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কারন এদের উপরেই অনেক মানুষ নির্ভর করে। শুধুমাত্র মুনাফা-কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা দিয়ে এ কাজ করা সম্ভব নয়। NITI আয়গের প্রস্তাবেও বলা হয়েছে যত বেশি সম্ভব মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ নিতে পারবে ততই মঙ্গল।
খ। PMJAY র আওতার বাইরে থাকা এবং স্বাস্থ্যবীমা নেই, এমন মানুষদের বীমার ছাতার তলায় আনতে পরিকল্পনা করা আবশ্যক। ফার্মা সেক্টরে NITI আয়গের প্রস্তাবে ২০১৯ সালে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করার কাজটি করার কথা। ২০১৯ এ National Medical Commission Bill পাশ করান হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিকিৎসায় বেশি বিল,গাফিলতি ইত্যাদি অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে। এই কমিশন নিজে থেকেই কোন তদন্ত শুরু করতেও পারে। রাজ্যগুলির স্বাস্থ্য পরিকাঠামো মাপার জন্য State Health Index এর প্রবর্তন করে NITI আয়োগ।
ভারত ২০২০ সালে চিকিৎসা পর্যটন থেকে প্রচুর ডলার আয় করবে বলে বলা হচ্ছে। এবং তা হচ্ছিলও। অবশ্যই করোনা- পূর্ববর্তী সময়ে। তার জন্য অন্য দেশের তুলনায় এদেশে স্বল্পমূল্যে উন্নত চিকিৎসা, সহজে ভিসা প্রাপ্তি বড় কারন। বাংলাদেশ ছাড়াও আফগানিস্তান, মালদ্বীপ,নাইজিরিয়া থেকে প্রচুর মানুষ এখানে আসে। অথচ ভারতের মানুষই এই সুবিধা নিতে পারেন না।কি অদ্ভুত বৈপরীত্য! ২০১৫- ২০১৮ সালে ভারতে আসা বাংলাদেশি মেডিক্যাল টুরিষ্ট বেড়েছে প্রায় ৮০%। বিশ্বব্যাংক বলছে,বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা খোদ ভারতে। কিন্তু বীমার সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ মানুষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
তৃণমূল স্তরে টেস্টিং ল্যবের অভাব,চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব,যন্ত্রাদির অপ্রতুলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারির ক্ষেত্রেও। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে সেই পরিকাঠামো তৈরি করতে নাভিশ্বাস উঠেছে। অতিরিক্ত অর্থব্যয় আবশ্যক হয়ে উঠছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে।জনস্বাস্থ্য, টীকাকরণ ইত্যাদিতে জোর দিতে হবে এখনি। আর বর্তমানে কোভিডের আড়ালে যে অনেক অন্যন্য রোগগ্রস্তরাও অকুল পাথারে, তা বলাই বাহুল্য। একই গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়ে তাদের চিকিৎসাও সুনিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি নতুন করে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরী।কথায় বলে 'স্বাস্থ্যই সম্পদ '।
দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ঢেলে সাজানো না হলে অদূর ভবিষ্যতে অতিমারি মোকাবিলা করা কোনমতেই সম্ভব হয়ে উঠবে না।অতএব সাধু সাবধান!
0 Comments