বেনে বউ ॥ বারিদ বরন গুপ্ত'র গল্প


বেনে বউ 
বারিদ বরন গুপ্ত

আমাদের গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে বেনে বউ ছোট্ট একটা ঘরে একলাই থাকে। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই তাকে বেনে বউ বলেই ডাকে। ছেলেপেলে কেউ নেই, আত্মীয়-স্বজন ও কেউ আছে বলে মনে হয় না, আর থাকবেই বা কি করে! এখানে তো ওর আদি বাড়ি নয়, একবার কাজের সন্ধানে নদীয়ার ওদিক থেকে এসেছিল, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাঠে কাজ করে জীবন নির্বাহ করতো,কয়েক মাস হল স্বামী মারা গেছে, তাই বেনেবৌ এই ছোট্ট ঘরটিতে একলাই থাকে।
       
বেনে বউ আর মাঠে কাজ করতে পারে না,সে সামর্থ্য ও তার নেই, বয়স ও যথেষ্ট হয়েছে। নিঃসঙ্গ বেনেবৌ বচ্চাদের খুব ভালোবাসে। গ্রামের প্রাইমারি এবং অঙ্গনারী স্কুলের বাচ্চারা ওর রোয়াকে বসে খেলা করে, দুষ্টুমিও করে, এতে বেনে বউ কিছু মনে করে না, বরং তার ভালোই লাগে। শুধু তাই নয় বাচ্চাদের অনেক দাবি ও পূরণ করে। নিজের ঠিক মত আহার না জুটলেও কি হবে ! বাচ্চাদের জন্য লজেন্স বিস্কুট এটা ওটা কিনে আনে, তার জন্য সে অন্তোদয় যোজনায় পাওয়া চাল ও মাঝে মাঝে বিক্রি করে,
সত্যি কথা বলতে কি, এই বাচ্চার না থাকলে বেনে বউ যেন হাঁপিয়ে মরে।

প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার মশাই, দিদিমনিরা বেনে বৌকে খুব ভালোবাসে, কারণ একটাই, বেনে বউ থাকলে বাচ্চাদের তাদের সামলাতে হয় না, সেজন্য তারা বেনে বউ এর খাওয়ার ও একটু ব্যবস্থা করেছে, বেনে বউ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিড ডে মিল খায়,তাই যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে সেদিন বেনে বউ এর খুব কষ্ট হয়,খাবারের থেকেও  বাচ্চাদের জন্য, কারণ এই বাচ্চারাই তার সব, বাচ্চারা না থাকলে সারাটা দুপুর তাকে একা একাই কাটাতে হয়। ঠিক এভাবেই বাচ্চাদের নিয়ে সুখের সংসার পেতে ছিল বেনে বউ,জানো নাতিপুতিদের নিয়ে বার্ধক্য কাটানোর স্বপ্ন পূরন করেছিল।

কিন্তু বিধাতার এই সুখ মনে হয় সহ্য হলো না,একদিন ধানবোঝাই একটা ট্রাক্টর দুরন্ত গতিতে আসছিল, একটা বাচ্চা রাস্তায় আপন মনে খেলা করছিল, তাকে বাঁচাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কাপড়ে পা জড়িয়ে ট্রাক্টরের সামনে এসে সে পড়ে, বাচ্চাটিকে কোনরকম বাঁচিয়ে নিজেকে সে বাঁচাতে পারল না, হসপিটাল যাওয়ার মাঝপথেই বিধাতা তাকে তুলে নিল,বেনে বউ এর মৃত্যুর সংবাদে গোটা গ্রামের মানুষ যেন শোকাচ্ছন্ন হয়ে পরলো।

সেদিন শুধু স্কুলের বাচ্চারা নয়, গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবনিতা সকলকে কাঁদিয়ে বেনে বউ স্বর্গযাত্রা করল। বেনে বউ এর মৃত্যুতে বোঝা গেল গ্রামের মানুষের মনে এত ভালোবাসা লুকিয়েছিল ওর জন্য, ওই ছোট্ট কুটিরে সেদিন হাজারে হাজারে মানুষ এসে জড়ো হয়েছিল,সেদিন একটা অতি সাধারণ রমণী যেন তার গুণে অসাধারণ হয়ে উঠেছিল,অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই যে গ্রামের কোন লোক মরলে এত লোক সমাগম হতে আগে দেখিনি, এত মানুষের ভালোবাসা যে তার প্রতি ছিলো তা কখনও ভাবিনি', সত্যিই এই পৃথিবীতে মানুষের ভালোবাসা চিরকাল বেঁচে থাকে, বাচ্চাদের ভালোবাসার কাঙাল সেই বেনে বউ গ্রামের মানুষকে কাঁদিয়ে চিরকালের জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে গেল।

বেনে বউ আজ আর নেই, বেশ কয়েক বছর হল পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, সেদিন দুপুরে ওই ঘরটার পাশ দিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম, দেখলাম প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারা বেনে বউ এর ঘরের রোয়াকে বসে খেলা করছে, দরজা হীন ঘরটার দিকে তাকালাম, মনে হচ্ছিল বেনেবৌ আজও ওই বাচ্চাদের মাঝেই আছে, কারণ ওই বাচ্চারাই ছিল তার সব,একান্ত আপনার। বেঁচে থাকো বেনে বউ চিরজীবী হয়ে ওই বাচ্চাদের মাঝে।

সাহিত্যিক বারিদ বরন গুপ্ত 
সাহাপুর, আসানপুর, পূর্ব বর্ধমান











1 Comments