জিরো আওয়ার ~ অনিন্দ্য দত্ত'র গল্প


জিরো আওয়ার
অনিন্দ্য দত্ত

অনুশ্রী তার মাসতুতো বোন মালবিকার কাছে এই প্রথমবার কর্লেনগঞ্জে বেড়াতে এসেছে।
মামা,অভিজিৎ বাবুর বয়স পঁচাশি বছর বয়স।মামি সবিতা আজ প্রায় তিন বছর হল দেওয়ালে ছবি হয়ে ঝুলছেন।মালবিকার বয়স এখন বেয়াল্লিশ।সে অনুশ্রীর থেকে দশ বছরের বড়।মালবিকা বিধবা।
আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে মালবিকার স্বামী অনুতোষ একটা ডাকাত দলের হাতে,নিজের অফিসের ক্যাশ বাঁচাতে গিয়ে খুন হন।অফিস মালবিকাকে কর্নেলগঞ্জেই কোম্পানির পরিচালিত একটা  স্কুলে চাকরি  দিয়েছে,রিসেপশনিস্ট এর। তাছাড়া একাউন্টস্ এর কিছু  কাজ ও সে করে।
মামা একটা বিস্কুটের কারখানায় স্টোরকিপার ছিলেন,অনেকদিন রিটায়ার করেছেন।তাই,সংসার এর গাড়িটা মালবিকাই টেনে চলেছে।
খুব চুপচাপ বাড়িটা।ওই দুজন আর পুরোনো কাজের মানুষের শ্রীকুমারদা ছাড়া আর কেউ কোত্থাও নেই।
তিন দিন হল এখানে এসেছে অনুশ্রী,এর মধ্যেই জায়গাটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে সে। 
মালবিকা স্কুলে চলে গেলে,মামা সকালের খাবার পর বারান্দায় রোদ্দুরে বসে ঝিমোন।অনুশ্রী গোটা বাড়িতে ঘুরেফিরে বেড়ায়, কখনো বইএর আলমারী খুলে বই পড়ে, আবার একটু পরেই বোর হয়ে গিয়ে,পেছনের বাগানে,কুয়োতলায়,পেয়ারাতলায় ঘুরে বেড়ায়, অশ্বত্থের তলায় বাঁধানো বেদীতে বসে আকাশপাতাল ভাবে।

[২] 

প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল তার বোন টিবি হয়েছিলো, মরণের দরজায় এগিয়ে গিয়েছিলো সে, বহু যত্নে পাঁচ মাস হাসপাতালে থেকে সে সেরে উঠছে,তাই তো বাবা তাকে কর্নেলগঞ্জে স্বাস্থ্যউদ্ধারে পাঠিয়েছেন,সবার আশা,সে একেবারে  সুস্থ  হয়ে ফিরবে।

দরজায় টোকার শব্দে,অনুশ্রী জেগে উঠলো,দরজা খুলে দেখে মালবিকা রাতের পোশাক পরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে  আছে। ফিসফিস করে বললো" চল্,তোকে একটা  মজা দেখাবো"...দুজনে বারান্দা থেকে নেমে বাইরের বাগানে পা বাড়ালো। অনুশ্রী ঘড়িতে দেখলো ভোর পাঁচটা প্রায় বাজে।পেয়ারা তলায় দুজনে দাঁড়ালো,তারপর গলা একদম নামিয়ে মালবিকা বললো "পাখীর ডাক শুনতে পাচ্ছিস, রাতের পাখীরা এখনো গাইছে,একটু পরেই রাতের পাখীরা ওদের পালা শেষ হলে থেমে যাবে,আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে ভোরের পাখীরা গেয়ে উঠবে,এই মুহূর্তটার নামই ব্লু আওয়ার বা জিরো আওয়ার। শোন,মন দিয়ে।অনুশ্রী মনে মনে গুনতে লাগলো, ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯... এবং দশ। সত্যিই হটাৎ করে অনেক পাখী একসাথে গেয়ে উঠলো,আর আমগাছের পাশ থেকে ভেসে এলো ধ্রপদী গানের রেওয়াজ।  
অনুশ্রী অবাক হয়ে মালবিকার দিকে তাকাতে,সে ভেজা গলায় বলে উঠলো" ঠিকই ধরেছিস,ওটা তোর জামাইবাবুরই গলা,এতদিন হয়ে গেল,তবু্ও এখানটা ছেড়ে যেতে পারছে না,আমাকে বড্ড ভালোবাসতো যে"...
অনুশ্রীর মনে হলো,শরীর সারাতে সে ঠিক জায়গাতেই এসেছে।মরন এই বাগানে তার ছায়া ফেলতে পারেনা। দুটি আত্মার নিবিড় প্রেম,এখানে এক ভালোবাসার স্বর্গ রচনা করে রেখেছে।

সাহিত্যিক অনিন্দ্য দত্ত 
পূর্ব নয়গাঁও, থানে, মুম্বাই





1 Comments