পুতুলখেলা
"মা এই পুতুলের বাড়িটা কি কাউকে দিয়ে দেবে?" মেয়ে প্রশ্ন করলো।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজজীবনে পা রাখতে চলেছে। তাই ঘর ঢেলে সাজানোর পালা।
'পুতুলের বাড়ি' কথাটা কানে আসতেই মনে হল কে যেন আমাকে এক ঝটকায় টাইম মেশিনে চড়িয়ে সাঁ সাঁ করে ছোটবেলায় নিয়ে চললো।
পুতুল খেলার পাগল ছিলাম আমি।লোকে বলে গুছিয়ে সংসার করার বীজটির নাকি ওখানেই বপন হয়।ওসব সত্যি নয় সবটা।কত লোকেই তো পুতুল খেলে না,তা বলে সংসার করছে না? না রাঁধলে খাবে কি?
যাক গে,যে কথা বলছিলাম। খেলনাবাটি ছিল নানান ধরণের। কুমোরপাড়ার মাটির,এলুমিনিয়ামের,স্টিলের,কে যেন আবার কাশী থেকে কাঠের খেলনা বাটিও এনে দিয়ে ছিল। সেই সব নিয়ে গামছা বা ছোট শাড়ি ফ্রকের ওপর পরে খেলার কি ধুম!
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজজীবনে পা রাখতে চলেছে। তাই ঘর ঢেলে সাজানোর পালা।
'পুতুলের বাড়ি' কথাটা কানে আসতেই মনে হল কে যেন আমাকে এক ঝটকায় টাইম মেশিনে চড়িয়ে সাঁ সাঁ করে ছোটবেলায় নিয়ে চললো।
পুতুল খেলার পাগল ছিলাম আমি।লোকে বলে গুছিয়ে সংসার করার বীজটির নাকি ওখানেই বপন হয়।ওসব সত্যি নয় সবটা।কত লোকেই তো পুতুল খেলে না,তা বলে সংসার করছে না? না রাঁধলে খাবে কি?
যাক গে,যে কথা বলছিলাম। খেলনাবাটি ছিল নানান ধরণের। কুমোরপাড়ার মাটির,এলুমিনিয়ামের,স্টিলের,কে যেন আবার কাশী থেকে কাঠের খেলনা বাটিও এনে দিয়ে ছিল। সেই সব নিয়ে গামছা বা ছোট শাড়ি ফ্রকের ওপর পরে খেলার কি ধুম!
হঠাৎই মাথায় একদিন এলো পুতুলের বিয়ে দিতে হবে। সাত বছরের বড় দাদাটি আমার পরামর্শদাতা। বললো, "তুই ছেলে পুতুলের মা হ', তাহলে দুটো পুতুলই তোর কাছে থাকবে।"
আমি তো খুব খুশি!
ছোট ছিলাম তো তখন,তাই বুঝিনি যে ছেলে বা মেয়ে যে পুতুলই হোক কেউই কাছে থাকে না!
তো হ্যাঁ পুতুলের বিয়ে। সুভদ্রার মেয়ে আর আমার ছেলে। বেচারি সুভদ্রা চিরকালই ভালোমানুষ। দাদার চক্রান্ত ধরতে পারেনি। আমি প্রস্তাব দিতেই এক কথায় রাজি। সুভদ্রা থাকতো মামার বাড়িতে। সুভদ্রার মাসিরা সব ডাকসাইটে সেলাইবিদ।তাই বোঝাই গেছিলো তত্ব আসবে মার্ কাটারি।
বিয়ের ভোজ নিয়ে চিন্তা নেই। মা সব্বাইকে লুচি, আলুর দম আর পায়েস খাওয়াবে কথা দিয়েছে।কিন্তু সেলাই ফোঁড়াই এসব মায়ের দ্বারা হবে না সে আমার ভালোই জানা।
কিন্তু বরকে তো সাজাতে হবে! কিছুটা হাল ধরলেন মেজো পিসিমা। ছোট্ট পাঞ্জাবি আর ধুতি হলো তৈরী।
কিন্তু টোপর?
তখন কিন্তু এখনকার মতো কোনো ক্র্যাফট এর দোকান ছিল না আমাদের সেই কোদালিয়া হরিনাভি রাজপুর চত্বরে !
কি করা যায়! আবার প্রখর বুদ্ধি খাটিয়ে উপায় বের করলো দাদা! পাড়ায় মাঠের পাশে ক্লাবঘর ছিল,তার বারান্দায় ছেলেরা সিগারেট খেত। তখন সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর রাংতা থাকতো। ওখানে গেলে পাওয়া যাবে কয়েকটা।তবে কেউ দেখলে হাজার প্রশ্ন করবে আবার মায়ের কানেও তুলবে!মা জানতে পারলে একটা পিটুনিও বাইরে পড়বে না! কত যে বাধা!
তা সত্বেও ভোরের আলো ফোটার আগেই দুই মক্কেল চুপি চুপি কাজ সেরে বাড়ি ফিরে এলো।পিসিমা আর আমি দুজনে বুদ্ধি করে বানিয়ে ফেললুম টোপর। জুতোর বাক্স হলো সিন্দুক।
তবে বিকেলে তত্ত্ব যখন এলো তখন বরপক্ষ ক্লিন বোল্ড! কি সুন্দর ছোট ছোট ফার্নিচার দেশলাই বাক্স দিয়ে বানানো, ছোট ছোট পাঞ্জাবি নয় নয় করে গোটা চারেক। ছোট্ট চাদর। ...আরো কত্ত কি ! আর ঘরে বানানো নাড়ু,বরফি দিয়ে থালা সাজানো তত্ত্ব!
বিকেলে বন্ধুরা এলো নেমন্তন্ন খেতে। সবাই এনেছে কিছু কিছু উপহার পুতুলদের জন্যে,ছোট ছোট শাড়ি, পুঁথির মালা । একজন এনেছিল সিগারেটে বাক্স দিয়ে তৈরী ভ্যানিটি ব্যাগ। কি মজা সে আর বলার নয়!
সার বেঁধে কলাপাতায় লুচি আলুর দম আঙ্গুল চেটে চেটে খাওয়া! এখনো চোখে ভাসে।
পুতুল খেলার সময় জ্বালাতন করলেও দাদা সঙ্গে থাকতো
ছোট ছিলাম তো তখন,তাই বুঝিনি যে ছেলে বা মেয়ে যে পুতুলই হোক কেউই কাছে থাকে না!
তো হ্যাঁ পুতুলের বিয়ে। সুভদ্রার মেয়ে আর আমার ছেলে। বেচারি সুভদ্রা চিরকালই ভালোমানুষ। দাদার চক্রান্ত ধরতে পারেনি। আমি প্রস্তাব দিতেই এক কথায় রাজি। সুভদ্রা থাকতো মামার বাড়িতে। সুভদ্রার মাসিরা সব ডাকসাইটে সেলাইবিদ।তাই বোঝাই গেছিলো তত্ব আসবে মার্ কাটারি।
বিয়ের ভোজ নিয়ে চিন্তা নেই। মা সব্বাইকে লুচি, আলুর দম আর পায়েস খাওয়াবে কথা দিয়েছে।কিন্তু সেলাই ফোঁড়াই এসব মায়ের দ্বারা হবে না সে আমার ভালোই জানা।
কিন্তু বরকে তো সাজাতে হবে! কিছুটা হাল ধরলেন মেজো পিসিমা। ছোট্ট পাঞ্জাবি আর ধুতি হলো তৈরী।
কিন্তু টোপর?
তখন কিন্তু এখনকার মতো কোনো ক্র্যাফট এর দোকান ছিল না আমাদের সেই কোদালিয়া হরিনাভি রাজপুর চত্বরে !
কি করা যায়! আবার প্রখর বুদ্ধি খাটিয়ে উপায় বের করলো দাদা! পাড়ায় মাঠের পাশে ক্লাবঘর ছিল,তার বারান্দায় ছেলেরা সিগারেট খেত। তখন সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর রাংতা থাকতো। ওখানে গেলে পাওয়া যাবে কয়েকটা।তবে কেউ দেখলে হাজার প্রশ্ন করবে আবার মায়ের কানেও তুলবে!মা জানতে পারলে একটা পিটুনিও বাইরে পড়বে না! কত যে বাধা!
তা সত্বেও ভোরের আলো ফোটার আগেই দুই মক্কেল চুপি চুপি কাজ সেরে বাড়ি ফিরে এলো।পিসিমা আর আমি দুজনে বুদ্ধি করে বানিয়ে ফেললুম টোপর। জুতোর বাক্স হলো সিন্দুক।
তবে বিকেলে তত্ত্ব যখন এলো তখন বরপক্ষ ক্লিন বোল্ড! কি সুন্দর ছোট ছোট ফার্নিচার দেশলাই বাক্স দিয়ে বানানো, ছোট ছোট পাঞ্জাবি নয় নয় করে গোটা চারেক। ছোট্ট চাদর। ...আরো কত্ত কি ! আর ঘরে বানানো নাড়ু,বরফি দিয়ে থালা সাজানো তত্ত্ব!
বিকেলে বন্ধুরা এলো নেমন্তন্ন খেতে। সবাই এনেছে কিছু কিছু উপহার পুতুলদের জন্যে,ছোট ছোট শাড়ি, পুঁথির মালা । একজন এনেছিল সিগারেটে বাক্স দিয়ে তৈরী ভ্যানিটি ব্যাগ। কি মজা সে আর বলার নয়!
সার বেঁধে কলাপাতায় লুচি আলুর দম আঙ্গুল চেটে চেটে খাওয়া! এখনো চোখে ভাসে।
পুতুল খেলার সময় জ্বালাতন করলেও দাদা সঙ্গে থাকতো
সারাক্ষণ !
উঠোনে বাড়িও বানিয়ে দিয়েছিলো একটা পুতুলের। সেই বাড়ি নিয়েই এক গভীর স্মৃতি।
বেশ সুন্দর ইঁট দিয়ে কাদা লেপে কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো দোতলা ঘর। দিনের বেলা ওখানেই রাজ্যের হাঁড়ি কুড়ি নিয়ে আমার সংসার।
খুব সম্ভবত অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে তখন দু' জনেরই। আমাদের ছুটি। কিন্তু শিক্ষিকা মা স্কুলে। বাবা অফিসে। দুই পিসি বাড়িতেই।
সময়টা খুব সম্ভবত সত্তর সালের গোড়ার দিক। উত্তপ্ত দেশ! সেই পরিস্হিতি বোঝার ক্ষমতা আমার অবশ্য তখন ছিল না।
উঠোনে খেলছি মন দিয়ে। হঠাৎ শুনতে পেলাম মচ মচ শব্দ! ভয় পেয়ে পেছন ফিরে দেখি চার পাঁচটা লোক। মাথায় টুপি। গায়ে ওভারকোট। আমি দৌড়ে বারান্দায় উঠে গেলাম। পিসিমা আমাকে ধরে আছেন আর থরথর করে কাঁপছেন। ইশারা করে দাদাকে বারণ করছেন সামনে আসতে। লোকগুলো লাথি মেরে আমার খেলাঘর ভেঙে দিলো,বোমা লুকোনো আছে কিনা দেখতে ।
আমি চিৎকার করে বলে উঠতে চাইলাম,"ভেঙো না!"
পিসিমা আমার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিলেন।
কতদিন যে আমি কেঁদে ছিলুম সেই বাড়ি ভাঙার শোকে !
ভাবছো এতদিন আগের কথা কি করে মনে রেখেছি এতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে? আসলে আমি ভুলতেই পারিনি।
কি করে পারবো বলো?
যখন হিটলারের অত্যাচারের কাহিনী পড়ি আমার সেই খেলাঘর ভাঙার কথা মনে পড়ে, যখন সিরিয়ার শিশুদের দেখি চোখে ভাসে চারপাশে সেই একই ওভারকোট পড়া মানুষের দল!
উঠোনে বাড়িও বানিয়ে দিয়েছিলো একটা পুতুলের। সেই বাড়ি নিয়েই এক গভীর স্মৃতি।
বেশ সুন্দর ইঁট দিয়ে কাদা লেপে কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো দোতলা ঘর। দিনের বেলা ওখানেই রাজ্যের হাঁড়ি কুড়ি নিয়ে আমার সংসার।
খুব সম্ভবত অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে তখন দু' জনেরই। আমাদের ছুটি। কিন্তু শিক্ষিকা মা স্কুলে। বাবা অফিসে। দুই পিসি বাড়িতেই।
সময়টা খুব সম্ভবত সত্তর সালের গোড়ার দিক। উত্তপ্ত দেশ! সেই পরিস্হিতি বোঝার ক্ষমতা আমার অবশ্য তখন ছিল না।
উঠোনে খেলছি মন দিয়ে। হঠাৎ শুনতে পেলাম মচ মচ শব্দ! ভয় পেয়ে পেছন ফিরে দেখি চার পাঁচটা লোক। মাথায় টুপি। গায়ে ওভারকোট। আমি দৌড়ে বারান্দায় উঠে গেলাম। পিসিমা আমাকে ধরে আছেন আর থরথর করে কাঁপছেন। ইশারা করে দাদাকে বারণ করছেন সামনে আসতে। লোকগুলো লাথি মেরে আমার খেলাঘর ভেঙে দিলো,বোমা লুকোনো আছে কিনা দেখতে ।
আমি চিৎকার করে বলে উঠতে চাইলাম,"ভেঙো না!"
পিসিমা আমার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিলেন।
কতদিন যে আমি কেঁদে ছিলুম সেই বাড়ি ভাঙার শোকে !
ভাবছো এতদিন আগের কথা কি করে মনে রেখেছি এতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে? আসলে আমি ভুলতেই পারিনি।
কি করে পারবো বলো?
যখন হিটলারের অত্যাচারের কাহিনী পড়ি আমার সেই খেলাঘর ভাঙার কথা মনে পড়ে, যখন সিরিয়ার শিশুদের দেখি চোখে ভাসে চারপাশে সেই একই ওভারকোট পড়া মানুষের দল!
আরো আরো কত শতই না ঘর ভাঙছে রোজ বুলডোজারের সপাট লাথি!
কোন সে রাজনীতির চক্রান্ত তা বুঝতে পারিনা! কার যে তাতে ভাল তাও মাথায় ঢোকে না!
শুধু এইটুকু কামনা করি,পৃথিবীর আর কোনো শিশুর খেলাঘর যেন না কোনো পাষন্ডের বুটের লাথিতে ভেঙ্গে যায়!
সাহিত্যিক অদিতি ঘোষদস্তিদার
১৮৯, জনসন রোড, নিউ জার্সি, আমেরিকা
0 Comments