আসা যাওয়া
পাঁচ
সবিতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে রূপাকে নিয়ে সোজা একখানা ট্রামে চেপে বসলাম। রূপা এখন একদম চুপচাপ। ওর এই অদ্ভুদ (মাঝেমাঝে) নিরব হয়ে যাওয়াটার সাথে আমার কেমন যেন একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে। মেয়েটা কিভাবে ঐ সময় কে জানে! তবে বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকে না। এবারেও নিরবতা ভাঙল মিনিট দশেক পরে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের দেশের সাথে কলকাতার অনেক মিল আছে। তবে আমাদের দেশ অনেক পরিষ্কার।
আমি বললাম, তুমি কি এসব ভাবছিলে এতক্ষন ধরে?
- না, ভাবছিলাম অন্য কথা। শুনবেন?
আমি ট্রামের ভাড়া মেটাতে মেটাতে বললাম, বলো।
রূপা ট্রামের জানালায় তাকালো। কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে ওকে। রূপা বলল, সবিতা মেয়েটি খুব ভালো। মনে হয় ওর মধ্যে একটা আস্ত শহর লুকিয়ে আছে। ওকি পতিতাবৃত্তি করে?
আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। সবিতার আসল পরিচয় দিতে মনে দাগ কাটলো, তাই কিছু না ভেবেই না বলে দিলাম। নিজের এইরকম ব্যবহারে নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম। রূপা মনে হয় আমার উত্তরে খুশি হল না, ও হয়ত মনে মনে নিজের বইয়ের একটা প্লট ভাবছিল। যেখানে নায়ক এক পতিতাকে ভালবাসে। শহরের নাম কলকাতা। একটা মারকাটারি ক্লাইম্যাক্স দিয়ে গল্পটা শেষ হবে। আমার না উত্তরে
সেসব কিছুই হল না। রূপা বললো, আমায় একটা সিগারেট দিনতো।
আমি বললাম, ট্রামে, বাসে সিগারেট খেতে দেবে না।
রূপা খুব চঞ্চল হয়ে বললো, তাহলে চলুন নেমে পরি। আমায় এখনই একটা সিগারেট খেতে হবে।
ভিক্টোরিয়ার সামনে নেমে পড়লাম। ময়দানের পাশ দিয়ে দুজন সিগারেট খেতে খেতে আমরা হাঁটছি। রূপা আবার চুপচাপ। অদ্ভুদ মেয়ে ! যখন চুপচাপ হয়ে যায় ওর নাকের দু'ধারে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। বারে বারে বাঁ কানের ঝুলপি চুলকায়। মেয়েটাকে এখন সত্যিই পদার্থবিদ্যার মেয়ে মনে হয়। এরকম খ্যাপাটে না হয়ে পদার্থবিদ্যায় মানুষেরা পার পায় না।
গড়ের মাঠের পাশের এক লোহার বেঞ্চিতে হঠাৎ রূপা বসে পড়ল। আমিও বসলাম। রূপা জোরে জোরে সিগারেটে টান মেরে শেষ করল। আমারটা তখনও বাকি। রূপা আমারদিকে তাকিয়ে বললো, আমার সাথে সবিতার কথাগুলো শুনেছেন নিশ্চই?
আমি উদাসভাবে বললাম, না।
রূপা কছুটা চমকে উঠে বললো, সেকি একটা কথাও শোনেননি!
-নাঃ, আমি তখন একটু অন্যমনস্ক ছিলাম।
-তা ভালো করেছেন। মেয়েটির মনে অনেক দুঃখ। স্বামী দেশের বাইরে থাকে। একা একা থাকে মেয়েটা এরকম একটা জায়গায়। তবে আপনাকে মেয়েটি খুব ভালোবাসে।
-কিভাবে বুঝলেন?
-মেয়েরা মেয়েদের মনের কথা বুঝতে পারে। আপনার একটা পার্সোনাল ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারি?
-করো, তবে বেশি পার্সোনাল হলে হয়ত উত্তর দিতে পারবোনা।
-খুব পার্সোনাল নয়। আপনি কি বিবাহিত?
-না। কেন? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
-এমনি। ভাবছিলাম আপনার সাথে সবিতার বিয়ে হলে বেশ মানাতো। মেয়েটার মনের অনেকটা অংশ জুড়ে আপনি আছেন।
আমি এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললাম, রূপা নভেম্বরের এই সময় কলকাতায় একপ্রকারের ওশ পড়ে। মাথায় বসে গেলে জ্বর নিশ্চিত। চলো হোটেলে ফেরা যাক।
রূপা আমার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই বলল, জানেন, আমার বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন আমি জানতে পারি যে সেই মেয়ের সাথে বাবার সম্পর্ক বিয়ের আগে থেকে। তবুও বাবা আমার মাকে বিয়ে করেছিল বাড়ির চাপে। কিন্তু সেই মেয়েটিকে ভুলতে পারেনি। আমার কি মনে হয় জানেন, আমার বাবা হয়ত মনেপ্রাণে চেয়েছিল আমার মা মরে যাক। আর সেটাই হলো।
এরপর রূপা আরও কিসব বলছিল সেদিকে কান না দিয়ে আমি একটা ট্যাক্সি ডাকলাম। হোটেলে যখন পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় ১০টা। রূপা বলল, রাতের ডিনার খেয়ে যান। এতো রাতে না খেয়ে যাবেন না।
রাতের খাবার খাওয়া হলো না। কারণ আমায় আজ রাত ১১টার মধ্যে নিউমার্কেট থানায় হাজিরা দিতে হবে। মাস দুয়েক আগে একটা মার্ডার কেসে আমার নাম আছে। ময়দানের সাট্টা ঠেকে পয়সা নিয়ে মারামারি হয়েছিল। আমি চুপচাপ পাশে বসে দেখছিলাম, আমার হাতে ছিল লেবু, লঙ্কা আর একগ্লাস বাংলা। পাশের লোক'টা মারামারি করতে করতে হঠাৎ আমার বাংলার বোলতটা ভেঙে একটা লোকের পেটে ঢুকিয়ে দিল। আমি তখনও চুপচাপ বসে ছিলাম। প্রথমে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর দেখলাম লোকটা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। আমি সেই খুনির দিকে তাকালাম, খুনির মুখটা পরিচিত। খুব পরিচিত। কোথায় যেন দেখেছি। মুহুর্তে সে উধাও হয়ে গেল।
এরপর থানা পুলিশ হলো। পুলিশের নজর থেকে আমি পার পেলাম না। প্রতি সপ্তাহে আমায় থানায় হাজিরা দিতে বলা হল।
দুমাস কেটে গেছে আমি তা'ও সবিতাকে জানাইনি তার স্বামী খুনের আসামি। যদিও সে ধরা পড়েনি তবে আমি জানি আজ থেকে দিন ১৫ আগে ডোমজুড়ে একটা এনকাউন্টার হয়েছে। সে যে সবিতার স্বামি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যখন থানায় ডেডবডির ফটো দেখেছিলাম। পুলিশ তাও এই কেসটা ওপেন রেখেছে যাতে তারা বিপদে না পড়ে। সবিতার স্বামির এরকম কিছু একটা হবে সেটা আমি জানতাম। সবিতাকে আমি বলতে চেয়েছিলাম বহুবার, কিন্তু পারিনি। জানি না কেন , হয়ত ওর স্নেহ হারিয়ে ফেলার ভয়ে। মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি স্নেহ ছেড়ে প্রেমে পড়ে যায়। আমি অন্তত সবিতার ক্ষেত্রে তা চাইনা। আমি চাই ও আমার প্রতি চিরজীবনের স্নেহের দাসি হয়ে থাকুক।
হ্যাঁ, আমি নিষ্ঠুর।
ছয়
আজ একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল আমার। শীত আসার আগে কলকাতায় উত্তুরে হাওয়া দেয়। এই সময় শরীরের সাথে সেই হাওয়ার একপ্রকার দ্বন্দ্ব চলে। একটু এদিকওদিক হলেই জ্বর নিশ্চিত। আমার সেরকম কিছু হয়েছে কি না জানি না। তবে মাথাটা ধরেছে। গা গরম। জ্বর কতটা সেটা জানার উপায় নেই। কারণ আমার ঘরে থার্মোমিটার নেই।
স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম হোটেল পিয়ারলেসের দিকে। বেশ শীত শীত করছে। মনে হচ্ছে জ্বর আছে। সে থাকুক। দুপুর একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নেব।
হোটেলে পৌঁছে দেখি রূপা লবিতে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। আমায় দেখে একটা পবিত্র হাসি ছুঁড়ে দিল। বোঝাই যাচ্ছে ও আজ খুব ভাল মুডে আছে। রূপা একটা বেয়ারাকে হাতের ইশারায় ডাকতে ডাকতে আমায় বললো, কফি না চা?
আমি 'কফি' বলে রূপার পাশের সিটে বসলাম। হোটেলের এই লবির অংশটা খুব সুন্দর। বেশ খোলামেলা। মাথার উপরে আকাশ দেখা যায়। বেশ কিছুটা জায়গা অন্তর বেতের চেয়ার আর কাঁচের টেবিল। টেবিলের উপর খবরের কাগজ রাখা। সুন্দর পরিপাটি করে। এমন মনে হয় যেন এখানে ধুলো ময়লাকেও ধুয়ে মুছে রেখে দেওয়া হয়েছে।
বেয়ারা কফি দিয়ে গেল। রূপা কফিতে চামচ নাড়াতে নাড়াতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাকে আজ একটু অন্যরকম লাগছে। কি হয়েছে বলুনতো আপনার?
আমি কফিতে একটা চুমুক মেরে বললাম, তেমন কিছুই না, তবে কাল ঘুম হয়নি রাতে। রূপা ঠোঁটের কোনায় হাসি এনে বললো, আপনি আজকের যুগের মানুষ হয়েও মোবাইল ব্যবহার করেন না কেন?
এমনি, আমি বললাম, এই পৃথিবীতে তেমন কেউ নেই যে আমার খোঁজ নেবে। আর আমিও কারোর বিশেষ খোঁজ নিতে পছন্দ করি না। তাই অহেতুক একটা মোবাইল ব্যবহার করার কোনো মানে হয় না।
আমার উত্তরটা মনে হল রূপার পছন্দ হলো না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো—
আমরা আজ কখন বেরুবো?
আমি বললাম, কফি শেষ করেই ওঠা যাক। তুমি রেডি তো?
জোড়াসাঁকো, কুমারটুলি পেরিয়ে আমরা যখন শোভাবাজার রাজবাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম তখন দুপুর ২টো। ভালো রোদ উঠেছে। তবে আমার এখনও শীত শীত ভাব লাগছে। রূপা প্রচুর ফটো তুলেছে আজ। হাতের সামনে যাকে পেয়েছে তারই একটা করে ইন্টারভিউ নিয়েছে। বেশ খুশি সে। শোভাবাজার রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রূপা বললো, চলুন এবার কিছু খাওয়া যাক। খুব খিদে পেয়েছে।
আমরা একটা খাবার হোটেলে ঢুকলাম, হোটেলটা বেশ মাঝারি ধরনের। তবে রূপাকে দেখে মনে হলো তার বেশ পছন্দ হয়েছে। বেশ কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে সে বললো, আজ আর কোথাও যাবো না। এখান থেকে সোজা হোটেলে ফিরবো। আজকের দিনটার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। আমি বেশ কিছু ভালো ইনফরমেসন পেলাম আমার বইয়ের জন্য। ভাবছি আজ থেকেই লেখা শুরু করবো।
একথা বলেই সে করমর্দন করার জন্য হাত বড়ালো আমার দিকে। আমিও হাত বাড়ালাম। সে আমার হাত ছুঁয়ে আঁতকে উঠে বললো, একি! আপনার হাত এতো গরম কেন? দেখি দেখি , বলেই সে আমার কপালে হাত দিয়ে বলল, সর্বনাশ, গা তো পুড়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে এই জ্বর গা নিয়ে আমার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অদ্ভুদ মানুষতো আপনি, চলুন এখনই ডাক্তারের কাছে যাবো।
এইসময় বেয়ারা খাবার দিয়ে গেলো। রূপা বেয়ারার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো, ভাই, এখানে ভালো ডাক্তার কোথায় আছে বলতে পারেন?
বেয়ারা রাস্তার দিকে হাত দেখিয়ে বললো, এই রাস্তার শেষে একটা চৌরাস্তার মোড় আছে, ওখানে ডাক্তার স্যান্নাল বসেন, খুব ভালো ডাক্তার।
মুখে ভাত গুঁজতে গুঁজতে রূপা বললো, ঠিক আছে। ধন্যবাদ।
ডাক্তার বললো, জ্বরটা বেশ আছে। প্রায় ১০২ ডিগ্রি। এখন রেস্ট দরকার। বেশ কিছু ওষুধ দিল। রূপা নিজে সেইসব কিনলো। নিজেই ট্যাক্সি ডাকলো, আমরা যখন ট্যাক্সি করে ফিরছি তখন রূপা বললো, ইস্ আমার জন্যই আপনার শরীর খারাপ হয়ে গেল। কাল বিকেলে ওভাবে মাঠের পাশে না বসলেই হতো। শঙ্কুবাবু আপনি আজ আর বাড়িতে ফিরবেন না। আমার সাথে হোটেলে চলুন। রেস্ট নিন। আমার রুমে দুটো বেড আছে। একটায় আপনি শুয়ে থাকবেন, অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে। আসলে আপনার মোবাইল নেই; বাড়িও চিনি না। আমি আপনার খবর নিতে পারবো না। তাই বলছিলাম—
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। রূপার কথাগুলো মনে হচ্ছিল অনেক দুর থেকে আসছিল। খুব কষ্ট করে শুনছিলাম। এসবের মধ্যে অনেক কষ্ট করে বললাম, পারলে একবার সবিতাকে জানিও। আজ রাতে ওর বাড়িতে আমার যাওয়ার কথা ছিল। বেচারি অপেক্ষা করে থাকবে।— বলেই চোখ বন্ধ করলাম। গাড়ি তখন ছুটছে হাওয়ার গতিতে। আমার ভালো লাগছে। বুঝতে পারলাম আমার অবস্থা খারাপ। একটা কচি গোলাপি হাত আমার মাথা টিপছে। আমার ভালো লাগছে। দূর থেকে একটা কথা ভেসে আসছে, খুব কষ্ট হচ্ছে? কি উত্তর দেবো জানি না। তবে আমার ভালো লাগছে।
হে ঈশ্বর, আমায় কোনোদিন সুস্থ করো না। অনেক সুস্থ হয়ে দেখলাম এই পৃথিবী। এতটুকু আদরের ছোঁয়া, আপনতার স্পর্শ পাইনি। এরথেকে এই অসুস্থতা ঢের ভালো। কারণ আমার ভাল লাগছে। পুরুষ হিসেবে নিজের পৃথিবী খুঁজে পাচ্ছি। যেখানে অপ্রতিহতভাবে কাউকে পাওয়ার দৃঢ় সংকল্প নেই। অনাদি কোনো এক নারী নিজের ইচ্ছায় আমার দায়িত্ব নিচ্ছে। হোক না কিছু সময়ের জন্য। ক্ষতি নেই। এই সম্পর্কে পাপ নেই। এটাকেই কি মানবিকতা বলে! নাকি মেয়েরা মানবিকতা দেখায় না। তাদের সব আদরেই প্রেম লুকিয়ে থাকে। শুধু সেই প্রেমের সম্পর্কের নামটুকু খুঁজে নিতে হয়। রূপার এই আদরের নাম আমি কি দেবো! মানবিকতা, প্রেম নাকি অন্যকিছু! জানিনা। আর জানতে চাইও না, কারণ আমার ভালো লাগছে।
যখন জ্ঞান ফিরলো আমার চোখ খোলার ক্ষমতা ছিল না। মনে হলো চোখের পাতায় কোনো পাথর বসানো আছে। নিজের আঙুল, দেহের প্রতিটি অংশ অনুভব করছিল কিন্তু কোনোটাই সামান্যতম নাড়ানোর ক্ষমতা আমার মধ্যে নেই। তবে চোখ বুজেই অনুভব করলাম যে বিছানায় শুয়ে আছি তা বেশ নরম—বড়লোকসুলভ। গায়ের চাদর মখমলের মতো, গা কুটকুট করে না। এসবের মধ্যে কানে কিছু কথা ভেসে আসছিল। কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছি। পারছি না। সামান্য চোখ খুলে দেখলাম সামনে'টা সম্পূর্ন ঘোলাটে, মূর্তির মতো আমার সামনে বসে আছে রূপা। ওকে দেখবার জন্য চোখ পুরোটা খুলতে হলো। কি সুন্দর, সরল মুখখানা। আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে রূপা। যেন কতদিনের পরিচিত আমি। রূপা বললো, এখন উঠো না। শুয়ে থাকো। খুব দুর্বল তুমি। প্রায় একদিন তোমার জ্ঞান ছিল না। হোটেলের ডাক্তার দেখে গেছেন তোমায়। বলেছেন চিন্তা করার কিছু নেই। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
আমি আবার চোখ বুজলাম। মনে জমে থাকা বিশাদ বা হঠাৎ পেয়ে যাওয়া এই আদরের কৃপায় আমার চোখে জল এল। অনেক কষ্ট করে আটকে রাখলাম, যাতে রূপা দেখতে না পায়। জানিনা পারলাম কি না।
সাত
আজ প্রায় তিন দিন হলো আমি রূপার হোটেল রুমেই পড়ে আছি। এখন আমি বেশ খানিকটা সুস্থ, তবে হেঁটে চলার মতো শক্তি এখনও আসেনি তেমন ভাবে। গতকাল থেকে উঠে বসতে পারছি। তবে রূপাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে। আমার ঘুম থেকে ওঠার পরথেকেই ওরমধ্যে একটা চরম ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। সকালে সুপ খাওয়ানো, দুপুরে বডি অয়েল মাখিয়ে দেওয়া। রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া। মাঝেমাঝে আমার মনে হয় রূপা হয়তো মনে মনে চেয়েছিল আমি অসুস্থ হই আর ও এভাবে সেবা করবে আমায়।
আজকে সকালে সুপপর্ব শেষ হওয়ার পর আমি বললাম, রূপা অনেক তো হলো এবার আমি যাই।
কেন? রূপা বললো, এখানে বুঝি ভালো লাগছেনা।
আমি বললাম , না রূপা তা নয়। আসলে এত আরামের মধ্যে থাকা আমার ঠিক সহ্য হয়না। এরপর যদি নেশা ধরে যায় তাহলে আমার সমূহ বিপদ। তুমি তো চলে যাবে ৭০দিন পর ইংল্যান্ডে আর আমি তখন সেই—
আমাকে থামিয়ে রূপা বললো, ওসব কথা থাক শঙ্কু। আচ্ছা তোমায় তুমি বলে বলছি বলে কিছু মনে কোরোনা। আমার বেশ ভালো লাগছে।
আমি হাসলাম, রূপাও হাসলো। আমি বললাম, তোমায় কিছু বলার আছে রূপা?
এখন নয়, এখন তুমি রেস্ট নাও। পরে শুনবো। তোমার কথা মতো আমি সবিতার কাছে খবর দিতে গেছিলাম। তখন তুমি এখানে ঘুমাচ্ছিলে। কিন্তু আমি চিনতে পারিনি ওর বাড়িটা। আর সত্যি বলতে ওই গলিতে ঢুকতেও কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। তাই আর যাওয়া হয়নি।
আমি চাদরটা গায়ে টেনে নিয়ে বললাম, ভালো করেছো। আমি পরে ওকে সব বুঝিয়ে বলবো। আসলে সবিতার আমার জীবনে অনেক বড় অবদান আছে। ঠিক অনেকটা তোমারই মতো।
রূপা কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, আমার মতো মানে?
আমি বললাম, এই যেমন তুমি আমায় প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলে সবিতাও এরকম করেছিল। যাইহোক, রূপা আমি একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই আবার বেরুবো তোমার কলকাতা ঘোরাতে।
রূপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমায় বললো, তার আর দরকার হবে না শঙ্কু। কাল রাতে বাবার ফোন এসেছিল। আমায় খুব মিস করছে। আমারও তেমন ভালো লাগছে না এখানে। তাই ঠিক করলাম তুমি সুস্থ হয়ে উঠলেই দেশে ফিরে যাবো।
আমি বললাম, যাঃ এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে! তাহলে যাও। আমি তোমাকে আটকাতেও পারবো না। সেই ক্ষমতা আমার নেই। তবে তোমার বইয়ের কি হবে?
যতটুকু দেখেছি, যতটুকু বুঝেছি এই শহরকে সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখবো।
-খুব জানতে ইচ্ছা করে আমি কি থাকবো সেই বই-এ?
-তোমার কি মনে হয়?
-মনে হয় থাকব। একজন গাইড হিসেবে।
-তুমি থাকবে কি না জানি না তবে সবিতা থাকবে।
-সে থাকুক। আমার ওর সাথে কোনো প্রতিযোগিতা নেই।
হঠাৎ রূপা চলে গেল। মেয়েদের এভাবে চলে যাওয়াটা আমি সিনেমায় দেখেছি। আমার মনে দাগ কাটলো ঘটনাটা। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। রূপা ডাইনিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে। তার মাথা নিচু। বাঁ হাত দিয়ে গাল মুছছে। আমি কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কি ব্যাপার? তুমি কাঁদছো না কি? আমি কি কিছু ভুল করলাম? বলে রূপার কাঁধে হাত রাখলাম।
মুহুর্তে রূপা ঘুরে আমায় জড়িয়ে ধরলো। মেয়েদের আলিঙ্গন যে এত দৃঢ় হয় আমার জানা ছিলনা। টের পেলাম আমার বুক ভিজে উঠছে চোখের জলে। আমি রূপার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, কাঁদছো কেন? আমার কোন কথা মনে লেগেছে তোমার?
রূপা জবাব দিল না। নিজের ডান হাত দিয়ে আমার বুকের মাঝখানটা কামড়ে ধরলো। আমি রূপাকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসলাম। রূপা আমায় ছেড়ে দিল। মাথা নিচু। দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে অনবরত।
টেবিলের উপর রাখা টিসু পেপার দিয়ে চোখ মুছে বললো, শঙ্কু , সবিতার স্বামী মারা গেছে তাকি তুমি জানো?
আমি চমকে উঠলাম, এ কি বলছে রূপা। আমি হ্যাঁবা নাকোনো জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন? কি হয়েছে?
রূপা বললো, আমি তোমায় বলতাম তুমি একটু সুস্থ হয়ে উঠলে। আসলে আমি সেদিন রাতে না গিয়ে পরের দিন সকালে গেছিলাম সবিতার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে শুনতে পাই সবিতা আত্মহত্যা করেছে। তার স্বামীর মারা যাওয়ার খবর তার কাছে আসতেই সে গলায় দড়ি দিয়েছে। ঘটনাটা ঘটেছে সেইদিন রাতে, যেদিন তুমি অসুস্থ হলে। হয়তো ও ভেবেছিল তুমি আসবে ওকে নিতে বা ওর হাত ধরতে। যখন দেখলো তুমি আসোনি তখন হয়তো ভাবলো স্বামী নেই, তুমি নেই তাই আর বেঁচে থেকে কি লাভ ওর। আমি নিজেকে খুব দোষারোপ করছি এরজন্য। আমিই তোমাকে আটকালাম সে'রাতে। তুমি যদি যেতে হয়তো আজ …..
আমি নিশ্চুপ নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। আমার আজ কিছুই বলার নেই। তবে সবিতাকে আমি ঠকাইনি। সেটা আমি জানি। আমি হাত শক্ত করে বললাম, রূপা যখন তুমি এতকিছু জানলে বুঝলে তখন আরও কিছু তোমার জানা দরকার। দেশে ফেরার আগে সেটাও জেনে যাও। তবে আমি এই কথাটা বলেই চলে যাবো। আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের।
রূপা আমায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, কি কথা?
আমি একটা সিগারেট ধরালাম। জোরে দুটো টান মেরে বললাম, প্রথমেই তোমাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমাকে আমার চরম অসুস্থতার সময় এত আপন করে সেবা করার জন্য। তবে তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত যে তোমার সামনে যে মানুষটা বসে আছে সে একজন ডাকাত। টাকার জন্য ছুরি মেরে ছিনতাই করা বা বাড়ির তালা ভেঙে মাঝরাতে ডাকাতি করা আমার পেশা। কলকাতার প্রায় ছয়টি থানায় আমার নামে কেস আছে। ৩ বারের বেশি আমি জেল খেটেছি। তবুও এরপরেও আমি বলবো আমি সৎ। অন্তত তোমার কাছে। সবিতার কাছে।
রূপা নিষ্পলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেও একটা সিগারেট ধরালো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললো, ডাকাত যখন তখন আমার টাকাগুলোও তো নিয়ে যেতে পারতে। সেগুলো নিলেনা কেন?
-মাথায় এসেছিল, তবে পারিনি নিতে। হয়তো সে জন্যই বললাম আমি তোমার প্রতি সৎ।
-আর সবিতার প্রতি সৎ কেন?
-কারণ সবিতা আমায় শরীর দিতে চেয়েছিল, মন দিতে চেয়েছিল। আমি জানতাম সবিতাকে নিয়ে আমি কোনোদিনই সংসার করতে পারবো না। আমার মন সায় দেবে না। তাই আমি কোনোদিনই সবিতার শরীরি আবেদনকে আমল দিইনি। হ্যাঁ, আমি ওর স্বামীর মারা যাওয়ার খবর জেনেছিলাম কিন্তু ওকে জানাতে পারিনি। হয়ত আমি ওর আমার প্রতি মায়ার আবেশ থেকে বেরোতে চাইনি। ওর স্নেহের ছোঁয়াগুলো আমার কাছে ছোটবেলা থেকে না পাওয়া অনেককিছুর ঘাটতি পুরণ করে দিয়েছিল। তাই আমি চুপ ছিলাম। আমি…
থাক, রূপা বললো, ওসব কথা থাক শঙ্কু। আশাকরি নামটা তুমি সঠিক বলেছো! আমি হাসলাম। পৃথিবীর অনেক অমিমাংসীত প্রশ্নের উত্তর হাসিতেই মিটে গেছে। এটাও মিটে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রূপা আমায় বললো, একি দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?
আমি বললাম, এবার আমার যেতে হবে রূপা। আমার সঙ্গে থাকাটা তোমার পক্ষেও নিরাপদ নয়।
রূপা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললো, না তোমার যাওয়া হবে না। আমি রূপার মুখের দিকে তাকালাম। ওর চোখে এক অদ্ভুত আকুতি। যার কোনো সংজ্ঞা হয় না। শুধু ব্যাখ্যা হয়। সে ব্যাখ্যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে—সেই আদম আর ইভের সময় থেকে।
(সমাপ্ত)
0 Comments