
অনীশ ব্যানার্জ্জী'র মুক্তগদ্য
আধুনিক নারী ও বর্তমান সমাজ
'নারী' এই শব্দটি শুনলে আমার মনে পড়ে মায়ের ছবিটা, যেন তিনি এক জীবন্ত দশভুজা আমাদের সবার পরিবারে। বর্তমানে নারীরা আধুনিক হচ্ছে চার দেওয়ালের গন্ডী পার হয়ে। আচ্ছা এই আধুনিকতার সংজ্ঞা কী ? যে নারী বিয়ের পর সারাদিন ঘরে চুড়িদার পড়ে থাকেন ? নাকি যে নারী গৃহের পোশাক নাইটি পরেই রাস্তায় বের হন ? নাকি যে হিন্দু নারী শাখা পলা আরো কীসব আছে ওগুলো কিছুই পড়েন না ? সিঁদুরটা এমন পড়েন যেন অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। এসব কোনটাই আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য নয় এগুলো অন্যকে দেখে অনুকরণ মাত্র, এসব বিষয়ে বলার নেই কিছু এগুলো মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। প্রশ্নটা হল একজন পুরুষ যখন তার স্ত্রীর জন্য কিছু ধারন করেন না তখন একজন মেয়ে কেন তার স্বামীর জন্য শাখা সিঁদুর পড়বে? আপনাদের ভাষায় বর্তমানের কোন আধুনিক মেয়েকে এই কথা বললে বেশিরভাগ মেয়েই কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারবেনা। কারন কিছুটা সংস্কার কিছুটা দুর্বলতা কিছুটা পারিবারিক কারন।
বর্তমান সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই খারাপ , তাই দিন দিন ধর্ষণ শ্লীলতাহানির মত ঘটানা ঘটে যাচ্ছে। বর্তমান সমাজে যেন
‘কন্যা আমার বলতে গেলে চাই কলিজার জোর
সমাজ এখন দাঁড়িয়ে আছে বসাবে বলে কামড়’
অর্থাৎ কন্যা সন্তান যেন এক আতঙ্ক, তাকে কীভাবে এই চিল শকুনির হাত থেকে বাঁচিয়ে মেয়েকে বড় করব এ এক বিরাট চিন্তা।
"সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে", এই প্রবাদ বাক্য প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে। অথাৎ নারীর কাজ শুধু সংসার সামলানো পর্দার আড়ালে থাকা। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছেন কি পর্দার আড়ালে থাকা কোন মেয়ের শ্লীলতাহানি হয়েছে?সে ধর্ষিতা হয়েছে? পাবেন না, হলেও খবর ছড়িয়ে পড়েনি।তখন মানুষ স্ত্রীলোককে তুচ্ছ ভাবলেও পরস্ত্রী ও নারীকে কুনজরে দেখার সাহস করতেননা। খারাপ খবর ছড়িয়ে দেয়া আর এক খারাপ কাজের জন্ম দেয় যেটা আমাদের মিডিয়া খুব ভালো পারে। এতে মানুষ দুর্বল হয় ভালো উদ্যোগ নেয়া থেকে পিছিয়ে আসে, অপরাধীদের মনোবল বাড়ে। কিন্তু এই পর্দা প্রথা কোন সমাধান হতে পারেনা, কারন রামমোহন বিদ্যাসাগর আজীবন চেষ্টা করেছেন স্ত্রী শিক্ষার জন্য, তাকে পর্দার আড়াল থেকে বের করে আনার জন্য। এটাই আধুনিকতা, তার কিন্তু ইংরেজদের মতন পোশাক আদব কায়দাকে অনুসরণ করেননি আমাদের মতই ধুতি পাঞ্জাবী পড়তেন কিন্তু চিন্তা ভাবনা আলাদা ছিল, ছিল নতুনত্ব, এটাই আধুনিকতা।
বর্তমান সমাজে নারীরা আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজেদের আধুনিক প্ৰমান করতে গিয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন তারা কুসংস্কার মানেনা কিন্তু আসলে তারা ভুলে যাচ্ছে সংস্কার, পরিবারের শিক্ষা বন্ধন। তারপর কঠিন সময়ে তারা মানসিক দুর্বল হয়ে গেলে তাদের ঘিরে ধরছে কুসংস্কার। মেয়েরা আজ উম্মুক্ত, তারা বন্দী নয় এটা খুব ভালো কিন্তু কোথায় থামতে হবে এটাও জানা দরকার।
ছেলে মেয়ের পার্থক্য করা উচিৎ নয়, সবাই সমান কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পার্থক্য বর্তমান। সেগুলো সবসময় স্মরনে রাখা দরকার প্রথম পার্থক্য হল নারীকে নিরাপত্তা দিতে হবে আর পুরুষ তাকে নিরাপত্তা দেবে। কেউ কেউ এটা শুনে আইপিএস বা ক্যারাটে জানা মেয়েগুলোর উদাহরণ দেবেন, কিন্তু সবাই সমান নয়। বিপদ যখন আসবে আপনি প্রস্তুত থাকেননা কিন্তু যিনি বিপদ ডেকে আনেন তিনি কিন্তু প্ৰস্তুত হয়েই আসেন।
প্রথম-: শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সমাজে ছেলে মেয়ে উভয়েই সমান এটা হওয়া দরকার। নারীরা শিক্ষিত হলে সমাজের চেহারাটাই পাল্টে যাবে। ছেলে মেয়েরা এক সাথে পড়বে অবাধ মেলামেশা করবে বন্ধু হবে এটা খুব ভালো একসাথে টিউশানে যাবার সময় একজন অন্যজনকে ডেকে নিয়ে পড়তে যাবে একসাথে, তাতে অসুবিধা কোথায় ? কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পাড়া পড়শি, দুদিন কোন ছেলে কোন মেয়ের বাড়ি এলেই বা গল্প করতে করতে পথ চললেই শুরু হয় কুৎসা রটানো। এগুলো করবেননা, চিন্তাকে আধুনিক করুন। দৃষ্টি এমন রাখুন যেন বিপদ এলেই বাঁচাতে পারেন তবে খারাপ দৃষ্টি দেবেননা।
দ্বিতীয়-: উৎসব অনুষ্ঠানে পাড়ায় ডিজে বক্স বাজলে দেখা যায় পুরুষরা নৃত্য করলেও মেয়েদের যাবার অনুমতি নেই। তাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন দেখে বাড়ি চলে আসতে হয় অনেক জায়গায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় মেয়েদের নাচ, সবাই হাসাহাসি করনে সেটা দেখে, কেন ? উৎসবের আনন্দ সবার তাতে নারী, পুরুষ, আমার আপনার মা,বোন সবাই সামিল হবে, তাদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের পুরুষদেরই, সে যার মা বোন হোক সবাই সমান। মেয়েরাও নৃত্য করবে আনন্দ করবে কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় পুরুষরা মদ্যপ অবস্থায় থাকে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কোন মেয়ের গায়ে পড়ে যেতে পারে, তাই তাদের আলাদা করে রাখতে হবে আর দেখতে হবে যেন ওই পুরুষদের ভীড় থেকে কেউ মেয়েদের ভিড়ে ঢুকতে না পারে। নিরাপদ দূরত্বে আর নিয়ন্ত্রন এই দুটি থাকা দরকার।
তৃতীয়-: বর্তমানে অনেক মেয়েই গাড়ি চালানো শিখছে, ভালো চালাচ্ছে পুরুষের সঙ্গে কোন তফাৎ নেই সেখানে। এটা খুব ভালো শেখাটা সবার দরকার, নিজের মেয়ে বোন শিখতে আগ্রহী হলে বাঁধা দেবেননা। ভাইকে পুত্রকে শেখাতে পারেন যখন মেয়ে বোনকেও শেখান, পার্থক্য করবেননা। অনেক জায়গায় আমি দেখেছি মেয়েরা আগ্রহ প্রকাশ করলেও বাঁধা দেয় বাড়ির লোক বিশেষ করে মা, এই যুক্তি দেখিয়ে যে, "মেয়ে মানুষ কী দরকার ওসব করার?"। পুরুষের মত ভগবান যখন তাকেও দুটি হাত দুটি পা দিয়েছেন সে কেন শিখবেনা ?
আমার বাড়ির ভাই বোন উভয়কেই আমি শেখার জন্য বলি, পূজার সময় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাই বাইকে করে ছেলেমেয়েদের তফাৎ করিনা। কিন্তু বোনেদের নিয়ে কোনদিন সন্ধ্যাবেলা যাইনা অথচ ভাইদের নিয়ে যাই।ওদের নিয়ে গেলে আলো থাকতে থাকতে যাই সন্ধ্যার আগে ফিরে আসি।
ঠাকুর দেখতে গেলে দুপাশের ফাঁকা মাঠ মাঝের রাস্তা ধরে যেতে হয় রাস্তার ধারে যত মাতালদের উৎপাত। চোর ডাকাতের ভয়ও আছে সঙ্গে ভাই থাকলে হয়ত দাঁড় করিয়ে ঘড়ি আংটি বাইকটা কেড়ে নিয়ে দুচর থাপ্পড় মেরে ছেড়ে দেবে। যে ক্ষতি হবে তা আজ না হয় কাল পূরণ হবে। কিন্তু বোন বা মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকলে অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে যার ক্ষতিপূরণ হয়ত সারজীবনেও সম্ভব নয়। বোনদের মাঝে মাঝে রাগ হয় কিন্তু গুরুজনের সমর্থন পাই এক্ষেত্রে।
একটা বিষয় দেখুন আমি কিন্তু ছেলে মেয়ের পার্থক্য করছিনা আবার অন্য সময় করছি, পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতার পাশাপাশি নিরাপত্তার দিকটাও ভাবতে হবে।
চতুর্থ -: বর্তমান সমাজে মেয়েরা ছেলেবন্ধুর সাথে সব কিছুই শেয়ার করতে পারে। একটা মেয়ে তার ছেলে বন্ধুকে বলার ক্ষমতা রাখে, "আজ বেরোতে পারবনা। মাসিক চলছে পেটে ব্যথা"। কেউ শুনলে বলবে মেয়েটা নোংরা অসভ্য, আরে এতে লজ্জার কী আছে? সবটাই সত্য আর বিজ্ঞান। মেয়েটি আধুনিক, তাই বলবে সবাই, হয়ত তাই। সে ভরসা বিশ্বাস ছেলেটার উপর রেখেছে বলেই বলেছে। শুধু প্রেমিক নয় ভালো বন্ধুকেও বলা যায়।
এই মাসিক হলেই আজও ঠাকুর ঘরের দরজা বন্ধ কেউ পরিবারের জন্য আবার কেউ নিজের মনের দুর্বলতার জন্য। আমার পরিচিত এক ডাক্তারি পড়ুয়া এবছর দুর্গাপূজায় অষ্টমীর অঞ্জলি দেয়নি, ফোনে কথা হলে সে জানায় কারনটা হল মাসিক হওয়া। মেয়েটিকে যদি দেখেন তার চাল চলন ভদ্র পোশাক ইত্যাদি দেখে মনে হবে সে আধুনিক কিন্তু সেও পারলনা এই বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে। এইরকম লক্ষ মেয়ে আছে যারা কুসংস্কার মানিনা বলে কিন্তু সংস্কারকে ভুলে যায় আবার কুসংস্কার ঠিক সময়ে এসে চেপে ধরে। ডাক্তার মানে সে মানব শরীরের সম্বন্ধে সর্বজ্ঞানী, তার উচিৎ লোককে বোঝানো যাতে কেউ এইরকম না ভাবে অথচ সেই কিনা পিছিয়ে এল।
পঞ্চম-: প্রেমিক থাকলে প্রকাশ্যে কোন কিছু অসভ্যতা করবেননা, এটা যেন আজকের সমাজে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়ার লোক অনেক সময় বাঁধা দেন, ঠিক করেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসব দেখলে কী শিখবে ভেবে দেখুন। যদি একান্তই ঘনিষ্ঠতা চান তার জন্য অনেক জায়গা আছে সেখানে যান, প্রকাশ্যে কেন ? কেউ কেউ আবার রেগে যুক্তি দেখায় যে একটা মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরলে মানুষের নজরে পড়ে কিন্তু ধর্ষিত হলে পড়েনা। কথাটা ঠিক মানুষ দেখেও দেখেনা, কিন্তু সেটা ঘটার আগে প্রতিরোধক ব্যবস্থা অনেক সময় নেয়া যায়। কিন্তু হয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকেনা, ধর্ষিতাকে বাঁচাতে যাওয়া মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। আমি অনেক মানুষকে দেখেছি যে কোন দুর্ঘটনা থেকে হয়ত কাউকে বাঁচিয়েছেন বা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন তাদের সারাজীবন কোর্টে হাজিরা দিতে যেতে হয়। কে এই ঝামেলা নেবে বলুন ? অন্যের দ্বায়ে। শহরে এখন অনেক জায়গায় দেখি মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে আছে কেউ দেখেনা তাকিয়ে পুলিশ আসে নিয়ে যায়। বর্তমান সমাজ যেন আজ বিবেকহীন কিন্তু সেটা এমনি এমনি নয়। তাহলে একজন মেয়ে বিপদ হলে তাকে বাঁচাতে আসবে কেন বলতে পারেন? এইজন্য আপনাকে অসভ্যতা করতে বারণ করে, কারন আপনি যাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করেন তিনিও হয়ত একজন মুখোশধারী, তাই আপনার যাতে কোন ক্ষতি না হয় তাই হয় লোকে বলে এইসব না করতে।
মেয়েরা অপেক্ষিকভাবে দুর্বল ভগবান যেন তাদের দুর্বল করেই পাঠিয়েছে। আজকের সমাজ তাদের দুর্বলতাকে আরও মদত যোগায়, বর্তমানের নারীও তার ব্যতিক্রম হচ্ছেনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে।
সবচেয়ে বেশী যেখানে মেয়েদের অপমান করা হয় তা হল টিভি সিরিয়াল, মেয়েরা কখনোই ওত খারাপ নয় বাস্তবে, অথচ দেখুন বর্তমানে মেয়েরাই সেটা গিলে গিলে খায় আর অনুকরণ করে তাদেরকে। বর্তমানে মেয়েদের দুর্বলতা আরো কাটিয়ে উঠতে হবে, ছেলেদের বাঁধা নয় বন্ধু ভাবতে হবে। সতীদাহ প্রথা নারীকে অশিক্ষার আড়ালে রাখা এসব কে চালু করেছিল জানা নেই কিন্তু কাটিয়ে তুলেছে পুরুষের আর সাহায্য অবদান। রামমোহন সতীদাহপ্রথা রোধ ও বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রবর্তন তাতে অনুঘটক অথচ পুরানো টিভি সিরিয়ালে দেখবেন মেয়েরাই মেয়েদের বাঁধা দেয় পড়াশুনা করতে, উজ্জীবিত করত সতীদাহের আগুনে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য। ছেলেমেয়ে সমান ভাবতে হবে বর্তমানে সমাজকে কিন্তু তফাতটাও স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। ছেলে মেয়ে পুরোপুরি সেদিন সমান হবে যেদিন একটা মেয়ে ধর্ষণ করবে আর একটা ছেলে ধর্ষিত হবে, যেদিন একটা ছেলে সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতা রাখবে।
সব শেষে একটাই কথা আবারও বলব বর্তমান সমাজকে মেয়েদের উপর নিরাপত্তার দৃষ্টি দিন, খারাপ দৃষ্টি নয়। আর মেয়েদের বলব কুসংস্কার মানিনা এটা দেখাতে গিয়ে যেন সংস্কার পরিবারের শিক্ষা ভুলে গেলে চলবেনা, নিজেকে নিরাপত্তার বলয়ে রেখেই সমস্ত কিছু করতে হবে।
গদ্যকার অনীশ ব্যানার্জ্জী
খুরুল, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ
0 Comments