নারী ও আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থা: সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা ~ বারিদ বরন গুপ্ত'র প্রবন্ধ


বারিদ বরন গুপ্ত'র প্রবন্ধ 
নারী ও আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থা: সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা

আমরা এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় সংসার পেতেছি, যেখানে নারী পুরুষের বৈষম্যের কোন স্থান নেই, অর্থাৎ নয়া বিশ্বব্যবস্থা সকলের সমান অধিকারের কথা বলে, কিন্তু পারতপক্ষে বর্তমান সমাজে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে একটু রেখাপাত করা যেতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বর্তমান সমাজকে প্রচন্ড গতিশীল করেছে, মানুষের জীবন ধারার অভাবনীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তবুও আজও বর্তমান সমাজে নারীরা নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত, উপেক্ষিত, নির্যাতিত, শোষিত, এক কথায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।

               অতিসম্প্রতি আফগানিস্তান নারীদের অবস্থান এর প্রশ্ন গোটা বিশ্বে নারীদের অবস্থান এবং অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আসলে নারীবাদী আন্দোলন এবং নারীর ক্ষমতায়নে তিনটি তরঙ্গ শেষ হয়েছে, চতুর্থ তরঙ্গ চলছে, এই পরিপেক্ষিতে আমরা বলতে পারি পাশ্চাত্য দেশগুলোতে নারীদের সামাজিক অবস্থানে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নারীদের সামাজিক অবস্থান ততটা স্পষ্ট নয়, এখনও সমানে চলছে বঞ্চনা আর উপেক্ষার ইতিহাস, নারীকে বলা হয় অর্ধেক আকাশ, জগতের আলো, সৃষ্টি ,সমাজ সভ্যতার ধারক ও বাহক, কিন্তু এই উত্তরাধুনিক আলোকিত সমাজে নারীরা এখনো অন্ধকারেই রয়েছে, সভ্যতার আলোয় এখনো তারা আলোকিত হতে পারেনি, পদে পদে তাদের সুযোগ কেড়ে নিয়ে পায়ে শেকল পড়ানো হচ্ছে, এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে অধিকার ছাড়েনি কোন কালে, বরং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে অধিকার হরণ করার, ভগবান পৃথিবীতে নারী-পুরুষকে আলাদা করে পাঠায় নি, সমান অধিকারের প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছে।

                  সভ্যতার বিকাশের প্রথম পর্বে সমাজে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ দেখা যায়নি, কিন্তু যেদিন থেকে পশুচারণ সমাজ কৃষি সমাজে উত্তন হলো অর্থাৎ কৃষি বিপ্লব শুরু হল তখনই ঘটলো নারীদের ঐতিহাসিক হার, নারী স্বাধীনতা হরণ করার প্রথম পর্যায়। এককথায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বিলুপ্ত হবার পর লিঙ্গ রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে, শুরু হয় নারী-পুরুষ বৈষম্যের ইতিহাস। নারী-পুরুষের বৈষম্য বিষয়ে নারী বাদী দার্শনিক সীমন্ দ্য বেভোয়া তার 'সেকেন্ড সেক্স' গ্রন্থে এক ঐতিহাসিক বক্তব্য দ্বারা ব্যাপারটাকে খুব স্পষ্ট করে তুলেছেন-'one is not born a woman, becomes a woman' অর্থাৎ কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, নারীতে পরিনত হয়। জন্মগ্ৰহনের সময় আধিপত্য হীন সমাজ থেকে নারী সৃষ্টি হয়, তারপর আধিপত্য মতাদর্শ প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সাহায্যে পুরুষ নারীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

                       মহান দার্শনিক প্লেটো বলেছেন-'ভগবানকে ধন্যবাদ আমাকে নারী করে পৃথিবীতে পাঠান নি', আরও একধাপ এগিয়ে মহান দার্শনিক নিৎসে বলেন-'নারী ভগবানের দ্বিতীয় ভুল!' এই দুই দার্শনিকের বক্তব্য থেকে উঠে আসে তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থানের স্বরূপ, সমাজে কিভাবে নারীরা বেঁচে ছিল। আসলে মধ্যযুগে যেদিন থেকে ধর্ম প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে সেদিন থেকেই বৈষম্য মূলক ব্যবস্থা শক্তপোক্ত হয়েছে। সনাতন হিন্দু ধর্মে নারীকে অভিশাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, ইসলাম ও ক্যাথলিক ধর্মে নারীর স্বতন্ত্র মর্যাদা স্বীকার করা হয়নি, এককথায় প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থা দ্বারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করেছে, বিশিষ্ট নারীবাদী লেখিকা কমলা ভাসিন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীকে পুরুষের নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তিনি বলেন নারী হলো পুরুষের যৌন তৃপ্তির উপায় মাত্র, সন্তান উৎপাদন, পরিবার পরিকল্পনা, সবই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করেন।

                    গোটা উনবিংশ শতাব্দীর জুড়ে মানবসমাজের জীবনধারা, আচার অনুষ্ঠান, প্রথা, রীতিনীতিতে নারীরা উপেক্ষিত ছিল। এমন কি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও নারীদের অধিকার স্বীকার করা হয়নি। গোটা বিংশ শতাব্দি জুড়ে, আজ ইউরোপ আমেরিকা মহাদেশ নারী বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে, তবে একথা সত্য এশিয়া তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তখনও সেভাবে প্রতিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধেনি, কিছু উদারনৈতিক সমাজ সংস্কারক নারীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মাত্র।

             নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৮৪০ সালে আমেরিকা ও বৃটেনের পার্লামেন্টের মেয়েদের ভোটাধিকার দাবির মাধ্যমে, এই ন্যায্য দাবী কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সহজে মেনে নিতে চায়নি, রক্তাক্ত হয়েছে ইউরোপ, বহু রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে তারা এই অধিকার লাভ করেছে। এই সাফল্যের পর গোটা ইউরোপ জুড়ে উত্তাল হয়ে ওঠে নারীবাদী আন্দোলন, ক্রমশ এই আন্দোলনের ঢেউ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী আন্দোলন বিকাশে বড় ভূমিকা পালন করে উইলস্টোন ক্যাফ্ট, চার্লস রাইট মিলস, কাল মার্কস সিমোন দ্য বোভোয়ার বেটি ফ্রেডান, জার্মেইন প্রমুখদের রচনার মাধ্যমে। এইসব সমাজ দার্শনিকদের লেখালেখি নারীবাদী আন্দোলনের পটভূমিকা তৈরি করে, তবে অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে নারীদের এই ন্যায্য দাবি , প্রতিবাদী আন্দোলন ও বৃহত্তর সমাজ, তথা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কখনই ভাল ভাবে মেনে নিতে পারেনি বরং এই আন্দোলন দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, বর্ষিত হয়েছে ব্যঙ্গ, উপহাস, শ্লেষ, শুধু তাই নয় এইসব আন্দোলনকে থামানোর জন্য অনেক সময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, হিংস্রতা প্রয়োগ করেছে, ঘরে-বাইরে উভয় দিক থেকে মেয়েরা অত্যাচার হিংস্রতা শিকার হয়েছে, শুধু তাই নয় কখনো কখনো গুলিও চলেছে, রক্ত ঝরেছে, তবুও থামে নি এই আন্দোলন, এখনো চলছে, নারীর ক্ষমতায়নে যা অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।

                ভারতীয় তথা এশিয়ার সমাজে নারীদের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, প্রাথমিক পর্বে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ ছিলনা, কিন্তু সমাজ যত এগিয়েছে ততই এই ভেদাভেদ প্রকট হয়েছে, মধ্যযুগের ভারত তথা এশিয়ার সমাজে নারীরা তাদের সমস্ত অধিকার হারিয়ে অন্ধকার কক্ষে নিমজ্জিত হয়েছিল। মধ্য যুগে নারীরা আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ে ধর্মের বেড়াজালে, ধর্মের বিভিন্ন আচরণবিধি এবং বিধি-নিষেধর দ্বারা নারীকে বেঁধে ফেলা হয়েছিল।

             বিংশ শতকে এশিয়া তথা তৃতীয় বিশ্বের নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে বিচরণ করেছে, যেটুকু অধিকার তা পুরুষদের দ্বারা পেয়েছিল এবং তাই নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল, পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে সর্বদাই ভোগের বস্তু হিসেবে দেখেছে, তাদের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করেছে, পুরুষরা তাদের ইচ্ছেমতো নারীদের ব্যবহার করেছে, সন্তান উৎপাদন থেকে পরিবার পরিকল্পনা সবই পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এক কথায় বলতে গেলে পুরুষ কাঠামোর মধ্যেই মেয়েরা তাদের অধিকার গুলো ভোগ করেছিল, পুরুষরা শুধু নারীদের ওপর মৈন কর্তৃত্বই নয় তাদের উপর মানসিক, নৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে সমাজে নারীদের কে পঙ্গু করে রেখেছিল।

              বিংশ শতাব্দি জুড়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নারী শোষণ, নারী নির্যাতন সমানে চলেছে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন কানুন তৈরি হয়েছে, তাসত্ত্বেও না নির্যাতনের হার কমানো যায়নি, অনেক সময় সামাজিক কারণে সব নির্যাতনের খবর পুলিশের কাছে পৌঁছায়নি, তাছাড়াও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক অপরাধী ছাড় পেয়ে গেছে‌। বর্তমানে উত্তরাধুনিক কাঠামোতে নারীরা শিক্ষা-দিক্ষা চাকরির ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে এলো ও,এখনো সমাজ পুরোপুরি বৈষম্যহীন হয়নি, বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক গুন বাড়লেও ,তা প্রায় বলতে গেলে পুরুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, নারীরা উপলক্ষ মাত্র।

                 উত্তর আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি, নারীদের মর্যাদা এবং অধিকার রক্ষার প্রশ্নে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, গঠনমূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।অতিসম্প্রতি যেভাবে তালিবানি সমাজ নারীদেরকে হাতের পুতুল করে রাখতে চাইছে, মধ্যযুগের আঁধারে নিয়ে যেতে চাইছে, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে  আমরা বলতে পারি, অধিকার কেউ ছাড়তে চায় না, সেটা অর্জন করতে হয়। ক্ষমতা কর্তৃত্ব এবং আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নারীদেরকে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, এবং ক্ষমতায়নে তিনটি দিক অর্থনৈতিক ,সামাজিক এবং রাজনৈতিক, সব দিকেই নিজেদেরকে মেলে ধরতে হবে এবং অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে।

প্রাবন্ধিক বারিদ বরন গুপ্ত 
সাহাপুর, আসানপুর, পূর্ব বর্ধমান



0 Comments