আসা যাওয়া
তিন
চোরাগলির আসিফের ঝুপড়িতে পৌঁছে দেখি সে বসে আছে ছোট কাঠের চৌকির উপর। পরিবার বলতে তার বিধবা মা। যে আয়ার কাজ করতে অনেক সকালেই বেরিয়ে পড়ে। আমাকে দেখেই আসিফ ঠোঁটের কোনায় হাসি এনে বললো, ভাইজান এতদিন পর ইঁয়াদ করলে। আমার উপর রেগে নেই তো?
আমি তার চৌকির এক কোনায় বসতে বসতে বললাম, আসিফ, কাজ আছে। রাজি থাকলে বল।
- আপনার কাজ, আর আমি রাজি হবো না তা কি হয়! আপনার কাজ করতে পারলে হাত পাকা হয় ভাইজান। কাজটা কি?
- বাগুইহাটির অশ্বিনীনগর এলাকাটা আজ ঘুরে এলাম। বেশ কয়েকটা বাড়ি দেখে এসেছি। তোকে আজ ওখানে গিয়ে বাড়িগুলো আবার দেখে আসতে হবে। তারপর একটা জবরদস্ত প্ল্যান বানাতে হবে। ফাইনাল চকআউট আমি করবো। রাত ২টোয় ঢুকবো। আধ ঘন্টার অপরেশন। আমি আর তুমি, আর কেউ না। যা হবে ফিপটি ফিপটি। রাজি?
- ভাইজান, এখনই তো যেতে ইচ্ছা করছে। আপনি শুধু বাড়িগুলো আমার এঁকে বুঝিয়ে দিন কোথায় আছে। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।
আসিফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি পৌঁছালাম আমার বাড়িতে। যদিও এটাকে বাড়ি বলা যায় কি? ৭ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা অবশ্য দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। কাগজের মিলে কাজ করে আমায় পড়িয়েছে। বাবা যখন মারা যায় তখন আমি বি এ পড়ছি। ইচ্ছে ছিল একটা কাজ করে জীবনটা চালিয়ে নেবো। কিন্তু সেটা হয়নি। কলেজে পড়াকালিন আমি টিউশনি করে পেট চালাতাম। এরকমই একদিন এক ছাত্রের বাড়িতে আমার সামনে টাকার বান্ডিল পড়েছিল। লোভ সামলাতে পারিনি। ছাত্রের মাথায় বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে আমি টাকা নিয়ে চম্পট দিলাম। ভেবেছিলাম সেই রাতেই কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে ঐ টাকা দিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করবো। তবে আমায় পুলিশ ধরে ফেলে হাওড়া স্টেশনে। জেল হয় ৯ মাসের। এরপর আমি আর থামিনি। কখনও চুরি, কখনও ছিনতাই করতে করতে এমনভাবে নেশা শুরু হয় যে আজও বেরিয়ে আসতে পারিনি।
তবে তিতলী নামের মেয়েটি নিজের নাম সঠিক বলেনি আমি জানি। পাসপোর্টে আমি ওর নাম দেখেছি। মেয়েটির নাম রুপা। রুপা মিত্র। হোটেল রিসেপশনে মেয়েটি ঐ নামেই রেজেস্ট্রি করেছে। এছাড়াও ঐ সময় আড় চোখে ওর পাসপোর্টে আমি ওর আসল নামটাও দেখে নিয়েছি। তবে মেয়েটি আমার নকল নাম কেন বললো! ১০০ ডলার প্রতি সপ্তাহে অফারটা ভালো। মেয়েটির কি তাহলে অন্য কোনো মতলব আছে? থাকলে থাকুক। আমার কোমরে সবসময় একটা ইস্পাতের যন্ত্র আছে। গাইডের মতো সামান্য কাজে ১০০ ডলার সপ্তাহে পাওয়ার লোভটা না থাকলে আজকে সকালে মেয়েটির ঘরে যখন ছিলাম আমি তাকে খালাস করে দিতাম। যে ১০০ ডলার সপ্তাহে দিতে পারে তার কাছে কত পরিমান ক্যাশ থাকতে পারে সেটা আমি ছাড়া আর কেই বা বুঝবে।
বিকেল ৪টের সময় আমি বেলটিপে দাঁড়িয়ে আছি। মহুর্তে দরজা খুলল তিতলী। হ্যাঁ আমি ওকে তিতলী বলেই ডাকবো যতক্ষন না সে নিজের নামটা নিজের মুখে স্বীকার করে। তিতলী আমায় অবাক হয়ে দেখছে, কেন জানি না। সে বললো, ভিতরে আসুন।
আমি ভিতরে ঢুকে একটা সোফায় বসলাম। তিতলী বললো, চা খাবেন?
আমি বললাম, হলে ভালো হয়। তবে আশাকরি চায়ের টাকা আমার পারিশ্রমিক থেকে কেটে নেওয়া হবে না?
তিতলি খিলখিল করে হেসে উঠলো। মেয়েটি যে কতটা শিশুসুলভ তা ওর হাসিতে বুঝতে পারছিলাম। তিতলী আজকেও একটা লাল জিন্স আর কালো টি-শার্ট পরে আছে।
কিছুক্ষন পর বেয়ারা চা দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে তিতলী বললো, আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন।
আমি কোনো জবাব দেওয়ার আগেই তিতলী বললো, আপনি পুরোনো কাপর পড়েই চলে এসেছেন!
আমি বললাম, আমার বেশি কাপড় নেই ম্যাডাম।
তিতলী আঁতকে উঠলো, একি আমায় ম্যাডাম বলছেন কেন?
- আপনি আমায় মাইনে দেবেন তাই ম্যাডাম বলছি।
- না বলবেন না। আপনি আমার নামধরে ডাকবেন।
- ও রূপা।
তিতলি মানে রূপা এখন চুপচাপ। তার চা খাওয়া থেমে গেছে। মাথা নিচু করে সে বলল, জানি না কেন নিজের নামটা ভুল বলেছি আপনাকে। আমি নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বলেছিলাম। আমি লজ্জিত।
আমি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললাম, চলুন আর দেরি করা যাবে না। আমরা বেরোই।
চার
আমরা বিকেল ৫টা নাগাদ এসে পৌঁছালাম খিদিরপুর হাড়কাটা গলির সামনে। রূপা সেই গলির দুধারে তাকিয়ে আমায় প্রশ্ন করল, শঙ্কু, রাস্তার পাশে এই মেয়েগুলো অদ্ভুদভাবে সেজে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
আমি বললাম, এটা একটি রেডলাইট এরিয়া। এর সবাই পতিতাবৃত্তি করে।
রুপা চোখ বড় করে বললো, O my God! আপনি আমায় এখানে এনে খুব ভাল করেছেন। এদের কারোর সাথে আমি কথা বলতে চাই। এদের করোর সাথে আমার একটা ইন্টারভিউ-র ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
আমি বললাম, এখানকার কোনো মেয়ের সাথে আমার তেমন পরিচয় নেই। তবে আপনাকে জানিয়ে রাখা ভালো যে এই রাস্তার পাশের পাড়াতেই আমি থাকি। ওখানে আমার বাড়ি। সবিতা বলে আমি একজনকে চিনি, তার সাথে আমি আপনার ইন্টারভিউ করিয়ে দিতে পারি।
দুধারের রাস্তা দেখতে দেখতে আমরা সবিতার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। সবিতার একতলার বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িতেই আমি থাকি। সবিতা স্বগর্বে পতিতাবৃত্তি করে। তার স্বামী এই এলাকার এক মস্ত মস্তান। তাই এলাকার লোকজন সবিতাকে এড়িয়ে চলে।
সবিতার ভারি দেহ আর সর্ষের মতো চোখের প্রতি আমার কোনো মোহ নেই। তবে আজ থেকে বছর তিনেক আগে আমার টাইফয়েড হয়েছিল। তিনদিন জ্বরে অজ্ঞান হয়ে ছিলাম। তারপর যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখি আমার মাথার সামনে সবিতা বসে। পরে জানতে পারি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সবিতা তিনদিন ধরে আমার সেবা করে গেছে। কেন করেছে জানি না। জানতে চাইওনি কোনোদিন। তবে এই ঘটনার পর থেকেই সবিতার সাথে আমার একপ্রকার পরিচয়হীন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঘরে কোনো ভাল খাবার হলে সবিতা আমার ঘরে দিয়ে যায়। আমি হঠাৎ পুলিশের হাতে পড়লে সবিতা ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। এই তিন বছরে সবিতা কোনোদিন আমায় পাপ নজরে দেখেনি। তবে এক বর্ষার দুপুরে ওর ঘরে হঠাৎ আমার হাত টেনে ধরেছিল। বিড় বিড় করে বলেছিল, তুই কি কিছুই বুঝিস না শঙ্কু?
আমি উত্তর দিইনি। শুধু কোমরে চিমটি কেটে পালিয়ে গেছিলাম। ঐ শেষবার। তারপর আর কোনোদিন সবিতা আমার পাশে আসেনি ঠিক যতটা পাশে এসে ফুল ছোঁয়া যায়।
দরজার কড়া নাড়ানোর শব্দে সবিতা দরজা খুললো, নাভির নিচে কাপড়পরা অবস্থায় সে বলল, কি ব্যাপার শঙ্কু, এ কে?
আমি বললাম, এ একজন লেখক। বিদেশ থেকে এসেছে একটি বই লেখার জন্য। তোমার ইন্টারভিউ নেবে।
বুক ফুলিয়ে হাসতে হাসতে সবিতা বললো, ভেতরে আয়।
রূপা সব দেখছিল, সে কিছুই বলছিল না।
সবিতার সেগুনকাঠের খাটে বসতে বসতে আমি বললাম, একটা চা দাও। গলা শুকিয়ে গেছে।
দিচ্ছি, তোর বিলেতি অতিথি কি খাবে? কফি?
আমি রূপার দিকে তাকালাম। রূপা বললো, আমি কিছু খাবো না। আপনি একটু আমার সামনে বসুন। আমি কিছু প্রশ্ন করব আপনাকে, তারপর চলে যাবো। আমার হাতে সময় খুব কম।
সবিতা ভুরু কুঁচকে বললো, আপনি সবিতার ঘরে এসেছেন ম্যাডাম। একটু বসুন। এখানে তাড়াতাড়ি কোনো কাজ হয় না। অপেক্ষা করতে হয়।
সবিতার ইন্টারভিউ পর্ব চলল প্রায় এক ঘণ্টা। এই এক ঘণ্টা জুড়ে রূপা কি কি প্রশ্ন করেছিল আমার সেদিকে মন ছিল না। আমি খাটের এক কোনো বসে চা খেতে খেতে সাদা চাদরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর ভাবছিলাম পতিতার খাটে এরকম সাদা চাদর ঠিক মানায় না।
এই চাদরের রঙ হবে লাল বা অন্য কিছু। সাদা নয়। আমার মনে পড়ে এক বর্ষার দুপুরের কথা, সেদিন সবিতা আমায় ডেকেছিল। সে বেশ আয়োজন করে খিচুড়ি বানিয়েছিল। আমি কাঁসার থালায় খিচুড়ি খাচ্ছিলাম। আর সবিতা আনমোনা হয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল।
হঠাৎ সে নিজের মনেই বলতে থাকে, জানিস শঙ্কু আমি ছোটবেলায় খুব ভালো গান করতাম। হারমোনিয়াম বাজাতেন আমার বাবা। তিনি আমায় সরগম শিখিয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল বড় হয় গান করবো। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। জানিস, আমি কোনোদিন 'স্নো' মাখতাম না। মা বলতো, মুখে কিছু না মাখলে মেয়েদের মানায় না। আমি ঠোঁট উল্টে জবাব দিতাম, আমাকে এমনিতেই দেখতে ভালো। স্নো মেখে কি হবে?
খিচুড়ি পর্ব শেষ হতে হতে সবিতা আরও অনেককিছু বলেছিল। আমার সেদিকে কান ছিল না। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব নিষ্ঠুর মনে হয় আমার। সবিতা সব কথা শেষ হওয়ার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর খাওয়া হয়ে গেছে? পান খাবি?
কতটা সহজভাবে মানুষটা আমায় আপন করে নিয়েছে। আমিই হয়ত স্বার্থপর'ই হয়ে থাকলাম। কি হত যদি একটু পাশাপাশি যেতাম সবিতার। গত বছরের পুজোতে যে পাঞ্জাবিটা সে আমায় দিয়েছিল তা পরে যখন সবিতার সামনে এসে দাঁড়ালাম সে কিছু সময়ের জন্য কেমন যেন নিষ্পলক হয়ে গেছিল। কি যেন খুঁজছিল আমার দিকে তাকিয়ে। সেই রাতে ঠাকুর দেখে ফেরার পথে আমি তো নিজের ইচ্ছাতেই সবিতার বুকে হাত দিয়েছিলাম। অন্ধকার রাস্তার দুদিকে কেউ ছিল না। সবিতা বড় বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, আজ রাতটা আমার বাড়িতে থেকে যা।
আমি থাকিনি। ওর দেহের প্রতি আমার লোভ নেই। তাও কেন ঘুরেফিরে ওর কালো চামড়া আমায় টানে! ওর স্বামী মাসে এক দুবার আসে। রাজনৈতিক পালাবদলের পর এখন ওর স্বামী পুলিশের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। সবিতার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আর হয়ত হবেও না। এই নিয়ে ওকে একবার আমি প্রশ্ন করেছিলাম। সবিতা বলেছিল, এই রোজগারে ছেলেমেয়ে কিভাবে মানুষ করবো? ওর(সবিতার স্বামী) কোনো ঠিক নেই। কবে শুনব পুলিশ এনকাউন্টার করেছে। তখন ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে।
আমি বলি, কেন! তোমার তো বয়স আছে, আরেকবার বিয়ে করে নিও।
বুকের পাহাড় ফুলিয়ে হাসতে হাসতে সবিতা বলে, তুই করবি আমায় বিয়ে তখন ?
(ক্রমশ)
গল্পকার কৌশিক দে
শরৎ বোস রোড, কলকাতা
0 Comments