দেবলীনা ব্যানার্জী'র ছোটগল্প




                আজব সমস্যা

অফিস থেকে ফিরে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে মাটিতে ব্যাগটা নামিয়ে সোফার ওপর ধপাস করে বসে পড়লাম। ঘর অন্ধকার। ভেতর থেকে আওয়াজও তো আসছেনা দেখছি! একটু অবাক লাগল আমার। বাবা গেল কোথায়? তাহলে কি চলেই গেল নাকি এবারের মত? ঘরগুলো ঘুরে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম, যাক কেউ কোথাও নেই। মুখের ওপর বাবাকে চলে যাবার কথাটা বলতে হলোনা বলে একটু স্বস্তিই পেলাম আমি…হাজার হোক বাবা তো! এখন যে অবস্থাই হোক, মুখের ওপর চলে যেতে বলাটা তো আর ঠিক ভালো শোনায় না। ঘরগুলো ঘুরে আবার সোফায় এসে বসতেই একটা চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মনের মধ্যে, এরকম ক'দিন পরপর বাবার এ বাড়িতে যাওয়া আসা যদি অব্যহত থাকে তাহলে তো ভারী চিন্তার বিষয়! আবার এসেও যে চুপচাপ নিজের ঘরে নিজের মত থাকবে তা তো না। হাঁকডাক করে বাড়ির লোকগুলোকে বিব্রত করতেই হবে ওনাকে। এই ধরুন না কেন গতকাল রাতের কথা…
     ড্রইংরুম থেকে উচ্চস্বরে ভেসে আসা টিভির আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার।খাটের ওপর উঠে বসে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখলাম, রাত্রি বারোটা বাজছে। রাতে একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম, ঘুমও এসে গেছিল প্রায় সাথেসাথেই। আর তাই এই কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা গরম হয়ে গেল। কোনো আক্কেল নেই নাকি বাবার? এই রাতবিরেতে এত জোরে টিভি চালাবার অর্থটা কী? হ্যাঁ, মানছি বাবার ইনসমনিয়া আছে। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম আসেনা। কিন্তু তাই বলে গাঁকগাঁক করে টিভি চালিয়ে দিতে হবে? একবার ভাবলাম বাবাকে গিয়ে বলি টিভিটা বন্ধ করতে, কিন্তু আবার মনে হল এই রাত্রিবেলা বাবার সাথে অযথা ঝামেলা করে কি লাভ! বাবাকে এখন কিছু বলতে গেলেই হয় হম্বিতম্বি করবে, আর নয়ত করুণ চোখে তাকিয়ে বলবে,"খোকা, এই বুড়ো মানুষটাকে এমনি করে বলিসনা রে। বুড়ো হওয়ার অনেক জ্বালা….." ইত্যাদি ইত্যাদি।
     গায়ে একটা চাদর ঢাকা দিয়ে খাটের ওপর আবার লম্বা হয়ে শুয়ে পাশবালিশটা চাপিয়ে দিলাম কানের ওপর। এসিটাকেও চালিয়ে দিলাম হাত বাড়িয়ে। শব্দটা এবারে একটু কম লাগছে কানে। ভাগ্যিস মৌ এখন বাড়িতে নেই! নইলে এক্ষুনি একটা দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দিত ঘরের মধ্যে। বাবার এইসব উদ্ভট কার্যকলাপ মৌ মোটেও বরদাস্ত করতে পারেনা। আর ইদানিং তো বাবার উপস্থিতিই ওকে হাইপার করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর সেইসব কিছু মৌ উগড়ে দেয় আমার ওপর। আর আমার তো শিখণ্ডীর দশা, না বলতে পারি বাবাকে কিছু আর না মানতে পারি মৌকে।
     তা যা বলছিলাম, মৌ তো গেছে বাপের বাড়ি। এমনিতে অবশ্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে রাগ,অভিমান করে ঘন ঘন বাপের বাড়ি পাড়ি দেবার অভ্যাস আছে মৌ-এর। তবে এবারের কারণটা কিঞ্চিৎ সিরিয়াস, এবং অবধারিতভাবে বাবা ঘটিত।
      দিন তিনেক আগে অফিস থেকে ফেরার পর আমি আর মৌ ঠিক করেছিলাম, দু'জনে মিলে একটু বেড়িয়ে আসবো। একসাথে অনেকদিন যাওয়াও হয়না কোথাও, তাই ইভিনিং শোয়ে একটা মুভি দেখে ডিনারটা নাহয় বাইরে থেকে করে আসবো। তা সেই উদ্দ্যেশ্যে মৌ তখন সাজগোজ করছে, প্রায় রেডি। শাড়ি পড়া শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে; এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে ভেসে এলো বাবার ডাক,"বউমা, মাথাটা বড্ড ধরেছে। কড়া করে এককাপ চা করে নিয়ে এসো তো। তারপর আমার এখানে বসে বেশ করে আমার মাথাটা একটু টিপে দিও"। বাবার এই আকস্মিক ডাকে প্রথমে খানিক হকচকিয়েই গেছিলাম। তারপরে সামলে উঠে মৌ-এর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর মুখটা কিরকম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হাতের লিপস্টিকটা ঠক করে নামিয়ে রেখে একবার তাকালো আমার দিকে, আর একবার দেওয়ালের দিকে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল," এসবের মানে কী শুনি? আমি আর এই বাড়িতে এক মূহুর্তও থাকবো না। তুমি থাকো তোমার বাবাকে নিয়ে। মুভিটা বরং তুমি ওনার সাথেই দেখো। আমি চললাম বাপের বাড়ি।তোমার মা তো দিব্যি বসে আছেন বোনের বাড়ি গিয়ে। অবশ্য এখানে থাকলে তোমার বাবার জ্বালায় অ্যাদ্দিনে ওনাকে পাগলাগারদে ঠাঁই নিতে হত মনে হয়।"
     আমি বার কয়েক আমতা আমতা করে "আহা ঠান্ডা হও", "বাপের বাড়ি যেওনা" এসব বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মৌ-এর রণরঙ্গিণী মূর্তির সামনে থই করতে পারলাম না বিশেষ। মৌ সেই পাড়ি দিল বাপের বাড়ী, ব্যাগপত্তর গুছিয়ে। আমি বাড়িতে বসে রইলাম একা, ভ্যাবলার মত। বাবাকে গিয়ে দু'টো কথা বলে আসতে পারলে ভালো হত, কিন্তু সেটা করা তো আবার আমার পক্ষে সম্ভব না। যতই হোক আর যেমনই হোক, বাবা তো!
     মৌ চলে যাবার পর একবার ভেবেছিলাম মা'কে একটা ফোন করি। কিন্তু এসব শুনলে মা আবার উল্টে চেঁচামেচি করে প্রেসার বাড়িয়ে ফেলবে। তাই সে চিন্তা বাদ দিলাম মাথা থেকে। এদিকে মৌ চলে যাওয়ায় আমি যতই অপ্রস্তুত হই না কেন, বাবা কিন্তু আছে দিব্যি খোশমেজাজে। হুকুম করে আমাকে দিয়েই চা বানিয়েছে। আবার রাতে বাবার জন্যে দোকান থেকে কিনে আনতে হয়েছে ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন। মৌ যে ঘটা করে সন্ধ্যায়  থেকে চলে গেছে সেকথা ভুলেই গেছে মনে হয়। এই এক বিচ্ছিরি রোগ আছে বাবার, ভুলে যাওয়া রোগ। অ্যাদ্দিন রোগটাকে খারাপই ভাবতাম, কিন্তু এখন দেখছি সুফলও আছে কিছু। সবকিছু ভুলে-টুলে গিয়ে ভালো থাকা যায় কিন্তু!
     রাতে শোবার আগে মৌ-কে ফোন করেছিলাম একটা। কিন্তু সে তো মুখের ওপর "বাবা যদ্দিন থাকবে আমি আর ওই বাড়ীর গণ্ডি ডিঙাবো না" বলে কট করে ফোনটা কেটে দিল। নাহ্, গলা শুনে মনে হল মৌ বেশ সিরিয়াস। এবার আমাকে কিছু একটা করতেই হবে….. বাবার সাথে মুখোমুখি বসে এই সমস্যার একটা মীমাংসা করতেই হবে। এই বাড়িতে বাবার হুটহাট হাজির হওয়াটা এবার কিছু একটা করে আটকাতেই হবে।
     গ্র্যান্ডফাদার ক্লক'টার ঢং, ঢং আওয়াজে চমক ভাঙলো আমার। ঘড়িতে দেখলাম ছ'টা বাজছে। বাড়ি  থেকে বাবার চলে যাবার কথাটা মৌকে জানাতে হবে আবার। সবচেয়ে ভালো হয় ওর বাপের বাড়ি গিয়ে ওকে নিয়ে আসতে পারলে, যাই ফ্রেশ হয়ে ওদের বাড়িই চলে যাই। খুশি হবে ও আমায় দেখলে।
     বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ঘরে ঢুকলাম জামা চেঞ্জ করতে। তখনই চোখ চলে গেল পাশের দেওয়ালটার দিকে, বাবার ছবিতে টাঙানো মালাটা ফ্যানের হাওয়ায় দুলছে অনবরত। ছবিতে বাবার ভোলেভালা মুখটা দেখলে কেউ কি বিশ্বাস করবে বাবার কীর্তিকলাপের কথা? মাসদু'য়েক আগে গত হবার পর থেকে বাবা যেভাবে আমাদের নাকানিচোবানি খাইয়ে চলেছে, তা সত্যিই বেশ অভিনব!
     বেঁচে থাকতে বাবার ছিল আলজাইমার্স। হরদম ভুলে যেতেন সব কথা। তা বাবা তো শেষমেষ দেহত্যাগ করলেন, কিন্তু ভুলে যাওয়ার স্বভাবটা বাবাকে আর ত্যাগ করলনা! এখন বাবা মাঝেমধ্যে ভুলে যান উনি জীবিত, নাকি মৃত! আর তখনই ঘটে বিপত্তি। আগের অভ্যাস মত বাড়ীতে হাজির হয়ে শুরু করেন হাঁকডাক। আবার ওনার বর্তমান অবস্থায় এখানে আসাটা যে ঠিক না, সেটা মনে পড়ে গেলে চলেও যান হুট করে। এই কয়েক দিনে আমি কিছুটা মানিয়ে নিলেও মৌ একেবারেই হজম করতে পারেনা বিষয়টা। অবশ্য ওকেও তার জন্যে দোষ দেওয়া যায়না। বেঁচে থাকতে বাবাকে যতই ভালবাসিনা কেন, অশরীরী বাবার উপস্থিতি তো আর বিশেষ সুখপ্রদ হতে পারেনা। তাই না! বহু মাথা খাটিয়েও এই অদ্ভুতুড়ে সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় আমি অন্তত খুঁজে পাইনি...আপনাদের জানা থাকলে বলবেন কিন্তু অবশ্যই!!

        গল্পকার দেবলীনা ব্যানার্জী
                              টিকরহাট, পূর্ব বর্ধমান


0 Comments