
লক্ষ্মণ দাস ঠাকুরার প্রবন্ধ
নারী ও আধুনিক সমাজ
নারী ও সমাজ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসলোকে একটি চিত্র প্রস্ফুটিত হয়।আমরা আমাদের চারিদিকের পারিপার্শ্বিকতা থেকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রতিমুহূর্তে অনেক কিছু তত্ত্ব তথ্য গ্রহণ ও বর্জন করে চলেছি।যা আমাদের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছে এবং একটি নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি হচ্ছে।সেইরকমই নারী ও সমাজ সম্বন্ধে একটি মূর্ত ধারনা।সুতরাং সমাজ বলতে মূলত এমন একটা ব্যবস্থা বোঝায় যেখানে একাধিক চরিত্র একত্রে কিছু নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করে একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে।পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একত্রে বসবাস করে নি।প্রথমে তারা বিচ্ছিন্নভাবে গুহাকন্দরে বাস কোরে এবং শিকার কোরে জীবন ধারন করেছে।পরবর্তীতে শিকারের ও কৃষি কাজের প্রয়োজনে নদীর ধারে বসবাস শুরু করেছে।প্রাকৃতিক ও বন্য প্রাণীর বিক্ষুব্ধতার হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘর বানিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের মধ্যে জৈবিক ও মানসিক আদান-প্রদানের জন্য পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে থেকেছে।ইতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে সমাজের অস্তিত্ব দেখা যায় কিন্তু তাদের কাঠামোগত কোন অস্তিত্ব নাই। কিন্তু মানুষ সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম হতে থাকে সৌহার্দ্য সহযোগিতা মমতা ও অপরদিকে ঘৃণা লোভ জিঘাংসা ইত্যাদি।তাই সমাজ কে ধরে রাখার জন্য তৈরী হয় কিছু নিয়ম।
সেই নিয়ম লঙ্ঘিত হলে চরম অসম্মানজনক এবং সমাজের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য বলে পরিগণিত হতে থাকে।এই সমাজের মূল চালিকাশক্তি দুটি -নর ও নারী।নর অর্থাৎ পুরুষেরা শারীরিকভাবে বেশি সক্ষম হওয়ার ফলে পুরুষকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর জন্ম হয়।নারীরা প্রাকৃতিক কারণে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হওয়ার জন্য নারী দখলের গোষ্ঠী লড়াইও হয়।তার ফলে প্রাচীনকালে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে।তাহলে আমরা বুঝতে পারছি নারী বলতে পৃথিবীতে অন্যতম প্রাণী যা মানুষের স্ত্রীবাচক রূপ।সংস্কৃত নৃ শব্দটি থেকে উৎপত্তি ( নৃ+ঈ=নারী)।নারী শব্দটি সমস্ত স্ত্রী মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।আর মেয়ের মেয়ে শব্দটি কিশোরীর ক্ষেত্রে বোঝানো হয়।তাছাড়া বয়সের বাধা ডিঙিয়েও নারী শব্দটি সমগ্র স্ত্রী জাতিকে নির্দেশ করতেও ব্যবহার করা হয়।ধীরে ধীরে দিন যত এগিয়েছে এক একটি প্রথা সমাজের বুকে থাবা গেড়ে বসেছে।দাসপ্রথা সামন্তপ্রথা সামাজিক শ্রেণী ও বর্ণপ্রথা।এই সকল ব্যবস্থা তে নারীরাই সবচেয়ে আলোচিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এই প্রথা গুলিতেই ঐতিহাসিকভাবে নারীকে গৃহ প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।স্বাভাবিকভাবেই তারা বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।বর্তমানে আমরা আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়প্রবেশ করেছি।
এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায় আধুনিকতা তাহলে কি?এটি একটি দার্শনিক আন্দোলন।তাহলে বর্তমানের পূর্বের যুগগুলো কি সে যুগেরপ্রেক্ষাপটে আধুনিক ছিল না?আজকের আধুনিকতার রূপদানের উপাদানগুলি সে যুগে অনুপস্থিত ছিল তাই আমরা এই যুগ দাঁড়িয়ে সেই যুগ গুলিকে আধুনিক যুগ বলতে পারিনা।আধুনিক যুগের মূল উপাদান হচ্ছে শিল্পভিত্তিক।নগরের দ্রুত বিকাশ।শিল্প বিপ্লব ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতাতেই আধুনিক যুগের সূচনা।পূর্বাপর ধর্মীয় অভ্রান্ত ধারণা গুলি কে প্রত্যাখ্যান করার মানসিকতা ও আন্দোলন।তার ফলে ক্রমশ ঐতিহ্যবাহী শিল্প-সাহিত্য স্থাপত্য ধর্মীয় বিশ্বাস দর্শণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি সেকালের হয়ে পড়তে থাকে।বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে।উন্নয়ন ও পুনর্নির্মাণকে স্বীকৃতি দিতে থাকে।যে সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে আধুনিকতা বিকাশের পথ আটকে দিয়েছিল সেগুলো কি চিহ্নিতকরণ করে নান্দনিক আত্মদর্শন দিয়ে আধুনিকতায় পৌঁছে দেয়।শিল্প বিপ্লবের ফলস্বরূপ বুর্জোয়া মূল্যবোধের জন্ম হয়।এর নেতি বাচক ভাবনাগুলোর বিরুদ্ধে ও রোমান্টিকতার বিদ্রোহের মাধ্যমে আধুনিকতার সূচনা হয়।প্রযুক্তির যত অগ্রগতি ঘটতে থাকে জীবনযাত্রা ধারারও পরিবর্তন হতে থাকে।তার ফলে সভ্যতার অগ্রগতিও ঘটতে থাকে।ঊনবিংশ শতাব্দীতে জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ও রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কসের বিজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা আধুনিক সমাজ ব্যবস্থাকে আরো ত্বরান্বিত করে।
আধুনিক যুগে নারীদের অবস্থান পর্যালোচনা করার পূর্বে বৈদিক যুগের আদিপর্বে নারীদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল একটু দেখে নেওয়া যাক।নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার ভোগ করতো।সে যুগে নারী শিক্ষার হার বিবেচনা না করেও বলা যায় নারীরা শিক্ষিত ছিল।
ঋকবেদে উল্লেখ আছে স্বয়ম্বর সভা অর্থাৎ স্বামী নির্বাচনে স্বাধীনতা বা গান্ধর্ব বিবাহ অর্থাৎ সহবাসের স্বাধীনতা ছিল।বহুপ্রাজ্ঞীয় নারী যথা গার্গী মৈত্রী অপলার নাম উল্লেখ করা যায়।তাদের বেদ পাঠের অধিকার ছিল।আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতক হতে নারীর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। নারীরা ধীরে ধীরে বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে মনুসংহিতার অনুশাসন প্রচলিত হতে থাকে।অনুশাসন অনুসারে নারীরা শৈশবে পিতা যৌবনের স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্রের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।
সে যুগে নারীরা নগরবধূর ইপ্সিত শিরোপা জয় লাভ করতে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হত।আম্রপালি এমনই একজন।সমগ্র হিন্দুসমাজ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র -চার ভাগে বিভক্ত ছিল।প্রত্যেক বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক কাজের বরাদ্দ ছিল কিন্তু সেখানে নারীদের কোন স্থান ছিল না।তারা ছিল পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী।সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম, বিশেষ করে পুত্র সন্তানের।পুত্র সন্তান লাভের আশায় এবং নারীকে ভোগ বিলাসের অভিলাষে কৌলিন্য প্রথার দোহাই দিয়ে আভিজাত্য বজায় রাখতে পুরুষেরা বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত করেছিল।সম্পত্তির লোভ ও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে হাতিয়ার করে বিধবা নারীদের সহমরনের নামে স্বামীর চিতাতেই পুড়ে মরতে হতো অর্থাৎ সতীদাহ প্রথা প্রচলিত হয়েছিল।পর্দা প্রথা অর্থাৎ অসূর্যম্পশ্যায় নারীকে সম্পূর্ণভাবে গৃহবন্দি করে রাখা হল।ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা রামমোহন রায় বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অন্যান্য মনীষীদের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ঐ সমস্ত কুপ্রথাগুলি রদ হয়। সামাজিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হওয়ায় বিংশ এমন কি একবিংশ শতাব্দীতেও তার কুপ্রভাব লক্ষ্য করা যায়।রূপ কানোয়ার সতী হয়।পণপ্রথার বলি হয়ে এখনো নিরুপমারা চিতার আগুনে পোড়ে।কন্যা ভ্রুণ হত্যা হয়।নারী শিক্ষার হার এখনো অনেকখানি পিছিয়ে।কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি এক অংকের শতকরাতেই সীমাবদ্ধ।লিঙ্গবৈষম্যের বঞ্চনায় লাঞ্ছিত নারীরাই।তবুও ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে বিগত কয়েক শতাব্দী ভারতীয় নারীর অবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকে আধুনিক সমাজে পা রেখেছে।তাইতো সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষণীয়।প্রধানমন্ত্রী লোকসভার অধ্যক্ষ বিরোধী দলনেত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপাল ও অন্যান্য উচ্চপদে আমরা নারীর উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি।বর্তমান আধুনিক সমাজে নারীদের উপস্থিতিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে বিশ্বায়ণ।প্রাচীন কালেও বিশ্বায়ন ছিল, সেটি বাণিজ্যের কারণে এক দেশের সঙ্গে এক দেশের যোগাযোগ ছিল মাত্র।এখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি প্রভূত উন্নতি ফলে বিশেষত উপগ্রহ ইন্টারনেটের ব্যবস্থার ফলে বিশ্বায়ন কে আমরা জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে অনুভব করছি।তার ফলে দেশে দেশে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে।শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নের গতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।সমগ্র দেশ আজ বিশ্ব রাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত হচ্ছে।আর্থসামাজিক কারণে আমাদের দেশে ১০০% নারীর জীবনে বিশ্বায়নের প্রভাব না পরলেও বিরাট অংশের নারী সমাজের মধ্যে তার প্রভাব পড়ছে এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটছে।ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ কেন্দ্রিক বহু আলোচনার অবকাশ আছে।নারীরা আজ গৃহবন্দী থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বনাগরিক।আজ আর নারী ও আধুনিক সমাজ পৃথক ভাবে দেখার কোন অবকাশ আছে বলে মনে করি না।আধুনিক সমাজে নারীরা আজ মুক্তবিহঙ্গ।
0 Comments