অধিকার বনাম স্বাধীনতা ~ রথীন্দ্রনাথ রায়ের প্রবন্ধ


রথীন্দ্রনাথ রায়ের প্রবন্ধ
অধিকার বনাম স্বাধীনতা

একসময় ব্রিটেনের ইতিহাসে অধিকার কথাটি নিয়ে খুব সোরগোল হয়েছিল । প্রবল প্রতাপশালী রাজতন্ত্র শেষ পর্যন্ত গণ আন্দোলনের চাপে ম্যাগনাকার্টা বিল, অধিকারের সনদ প্রভৃতি বিল পাশ করে । সেই শুরু হয়েছিল।আজো সেই ধারা অব্যাহত । কিন্তু অর্থ বুঝি পরিবর্তিত হয়ে চলেছে । একসময় আন্দোলন হয়েছিল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের অধিকারী । বলা হতো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে কোনও অন্তরায় থাকবেনা । প্রায় প্রত্যেকটি দেশের সংবিধানেও তা গৃহীত হয়েছে । কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । একটি নারী অপরটি পুরুষ । অর্থাৎ নারীর জন্য এক ধরনের অধিকার, তো পুরুষের জন্য আর এক ধরণের ।অর্থাৎ সমাজে নারী--পুরুষ স্বতণ্ত্র দুটি ইউনিট ।
  
প্রাগৈতিহাসিক যুগে স্বাধীনতার কোনো ধারণাই ছিল না । কারণ তখন কেউ কারোর অধীনস্থই ছিল। তখন নারীপুরুষ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক স্বাধীনতা ভোগ করত । কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা যখন থেকে গড়ে উঠেছে তখন থেকেই যার বেশি ক্ষমতা সে বেশি পরিমাণে অধিকার ভোগ করতে লাগল । ক্ষমতা মানে তখন পেশি শক্তিকেই বোঝানো হতো । আর এখন ক্ষমতা বলতে রাজনৈতিক ক্ষমতাকেই বোঝানো হয় । আর রাজনীতির দালালেরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে  'নারী স্বাধীনতা'র  নামে ভোট চাইতে শুরু করেছে।নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলতে শুরু করেছে। হরেক রকমের শ্রী এসেছে ।আইনগত ভাবে সমানাধিকারের কথা বলা হলেও তা রাজনীতির কূটকচালিতে শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি । 

সমানাধিকারের কথাটা সে যুগেও বলা হতো আজো বলা হয় । আসলে সমানাধিকার হলো রবার্ট ওয়েনের কল্পসমাজতণ্ত্রের অতি রোমান্টিক স্বপ্ন । কমিউনিস্টরাও দেখাত।যদিও তারা এখন ইতিহাস।  বাস্তবে সমানাধিকার স্বপ্নই রয়ে গেছে । বর্তমান অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হয় সমানাধিকারের স্বপক্ষে ভাবনাচিন্তা করার অর্থ হল সময়ের অপচয় করা । কারণ এখন তোল্লা দেওয়ার যুগ । তোল্লা দিয়ে দিয়ে নারীকে কখন যেন পণ্য করে তোলা হয়েছে । নারী তা টেরই পায়নি । যেকোনো প্রসাধনী শুধুমাত্র নারীরাই ব্যবহার করেনা । করে সবাই । কিন্তু মুখ ব্যবহার করা হয় নারীর । এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই । কারণ বিজ্ঞাপন থেকেও তো টুপাইস কামাই হচ্ছে।  
  
সমাজতত্বের মতে নারী এবং পুরুষের যে ধারণা তা হল আপেক্ষিক । পুরুষ এবং স্ত্রী আসলে দুটি শব্দ বা চিহ্ন । সৃষ্টির আদিলগ্নে মানুষ মানুষীরা নিজেদেরকে পুরুষ বা নারী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেনি। সেসময় তারা কতকগুলি প্রাকৃতিক ক্রিয়ার অধীন ছিল । এর ফলে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কতকগুলি কাজে প্রবণতা বৃদ্ধি পেল । সেদিন থেকে মানবিক আবেদনের কারণেই নারী পুরুষ পাশাপাশি থেকে পরস্পরের পরিপূরক হয়েছে । কিন্তু সমাজ গঠিত হওয়ার পর থেকেই অধিকারের ধারণা গড়ে ওঠে । যার যত বেশি ক্ষমতা সে ততো বেশি অধিকার ভোগ করতে থাকে।আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট পাওয়ার লক্ষ্য দুর্বলদের জন্য কিছু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।  সে ধারা আজো অব্যাহত।প্রাকৃতিক কারণেই নারী পুরুষের তুলনায় বেশ কিছুটা দুর্বল।কিন্তু ক্ষমতাবানরা নিজেদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতেই নারীর স্বার্থে কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করে। ব্যাস মার দিয়া কেল্লা।ভোটে জয়জয়কার। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনেই আমরা এই তত্বের সাফল্য দেখেছি।নারীকে নারীর ভাগ্য জয় করার অধিকার দেওয়া হলনা বরং ছলে বলে কৌশলে তার জগৎকে ছোট করে দেওয়া হল ।মার খেল প্রকৃত উন্নয়ন।করোনার ধাক্কায় টালমাটাল অর্থনীতি। এখন ঈশ্বরই (যদি থাকে) পারেন আমাদের বাঁচাতে। 
  
চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতে কিছু সংরক্ষিত অধিকার নিয়ে তারা বেশ ছিল এবং আছে । কিছুকাল আগে যে অধিকারকে যথেষ্ট মনে করা হতো আজ আর তা যথেষ্ট নয় । কারণ চাহিদার তো শেষ নেই । ফলে আরও চাই । কিছু কিছু দাবী পূরণ হচ্ছেও । কারণ ক্ষমতাবানদের স্বার্থেই সংরক্ষণ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। আধুনিক গণতন্ত্রে ভোট প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।  আর সংরক্ষণ থাকার সুবাদেই সংরক্ষিত শ্রেণী স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকে। এতে ঐ শ্রেণীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ তো ঘটেই না বরং আরো বেশি সংরক্ষণ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও একথা স্বাভাবিক ভাবেই প্রযোজ্য । যদিও নারীর জন্য আলাদা করে স্বাধীনতার কথা ভাবা যায়না তবু কিছু অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে । আবার সমানাধিকারের কথাও বলা হচ্ছে । ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেকেরই সমানাধিকার থাকা উচিত । সেখানে নারী পুরুষ আলাদা ভাবে সমানাধিকার ভোগ করতে পারেনা । 

সমাজ জীবনে নারী পুরুষের বিশেষ বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।প্রত্যেকেই বিশেষ দক্ষতার অধিকারী । এই দক্ষতাকে স্বীকার করতে না পারলে আমাদেরকে পিছন দিকে হাঁটতে হবে।মেয়েরাও দুর্বল নয়,  তা প্রমানিত হয়ে চলেছে । অনেকেই কর্মক্ষেত্রে সফল হচ্ছেন । এতে একটা জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারছে । কিন্তু শুধুমাত্র সংরক্ষণের কথা ভাবলে প্রতিভাময়ীদের প্রতিভাকেও স্বীকার করা যাবেনা। সেক্ষেত্রে মুড়ি মুড়কি সমান দরে বিকোবে। 
  
পুরুষের জন্য কোনো অধিকারই সংরক্ষিত হয়নি । তবু তারা ক্ষমতাবলে কিছু অধিকার ভোগ করে থাকে।নারী সেভাবে নিজেদের গড়ে তুলুক এবং স্বাভাবিক মানবিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আসুক । মানবিক প্রতিযোগিতা এই কারণে যে মানুষ তো মানুষই । সে নারী অথবা পুরুষ যেই হোক না কেন । প্রাকৃতিক কারণেই উভয়ের ক্ষমতায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে । সেই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েই উভয়কে একে অপরের পরিপূরক হতে হবে । 
নারীস্বাধীনতা বা উইমেনস লিব এর আজকাল কদর্থও হয়ে চলেছে । সমাজে কিছু তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তা নারী পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত না হয়ে পুরুষ শাসনের ধূয়ো তুলে থাকেন । আসলে এঁরা আঙুর ফলকে টক জেনেও বলেন টক।এটাও সত্য যে আজও গ্রামে বা শহরে মেয়েদের ওপরে একপ্রকার ধর্মীয় লাঞ্ছনা চলছে । সেখানে মনে করা হয় মেয়েরা বুঝি সন্তান উৎপাদনের যণ্ত্র । কোথাও কোথাও কন্যাভ্রুণ হত্যা হচ্ছে । এর জন্য সমগ্র পুংসমাজকে দায়ি করা উচিত হবে না । তাছাড়া প্রত্যেকটি অপরাধের আইনগত মীমাংসার ব্যবস্থাও রয়েছে । কোনো স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ নয় । আবার স্বাধীনতা ভোগ করতে গেলে অপরের স্বাধীনতায় বাধা দিলেও চলে না । সমাজ এবং জীবনের প্রতি আমরা প্রত্যেকেই দায়বদ্ধ । অতএব জীবনের সুষমবিকাশে যৌথ স্বাধীনতাই শেষ কথা । 

প্রবন্ধকার রথীন্দ্রনাথ রায় 
গিধাগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান , পশ্চিমবঙ্গ 



 



1 Comments

  1. ধন্যবাদ সম্পাদক মহোদয়কে আমার প্রবন্ধটিকে পাঠকের গোচরে আনার জন্য । এগিয়ে চলুক হৃদস্পন্দন ।

    উত্তরমুছুন