মননে নারী ~ উত্তম দেবনাথের প্রবন্ধ


উত্তম দেবনাথের প্রবন্ধ 
মননে নারী 

মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের সময় যেমন মহারথীগণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন-- বর্তমান সময়ে আমরাও কিন্তু এক‌ই ভূমিকা পালন করে চলেছি।এর কারন সমাজের অনেক গভীরে নিহীত।
         একটি ছেলে বা মেয়ে শিশু জন্মের পর থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার মাকে দেখেছে পরিবারে প্রতিনিয়ত অবহেলিত অপমানিত হতে।তখন শিশুর মনে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। ছোট্ট শিশু ধীরে ধীরে বড় হয়। ছেলে শিশু অভ্যাস বশত মেয়েদের উপর কর্তৃত্ব করতে চায়।মেয়ে শিশু মাকে দেখে সে ও  ভাবে মায়ের মতো সব মেনে নিতে হবে। তখন সে পরিবেশের সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেয়। এভাবে কালের নিয়মে নারী শোষিত, বঞ্চিত,নির্যাতিত হতে থাকে।ব্যাতিক্রম খুব কম দেখা যায়।
একটা হাতির বাচ্চা কে ছোট্ট বেলা থেকেই একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সে ধীরে ধীরে মস্ত বড় হয়।দড়ি কিন্তু এক‌ই থেকে।সে চাইলেই এক ঝটকায় দড়ি ছিঁড়ে স্বাধীন হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ অভ্যাসের ফলে পারে না।
এখন সময় এসেছে, নারীকে নিজেই নিজের শক্তি উপলব্ধি করতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে সমস্ত প্রতিকূলতা কে ভেদ করে আপন মহিমায়। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি স্মরণীয়,---
"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দেবে অধিকার।"

History=his+story অর্থাৎ তার গল্প। Her story নয় কেন? ইতিহাসে কী মেয়েদের অবদান কম? সরোজিনী নাইডু, প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদার , ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ, আরো অনেক বীরাঙ্গনা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। অথচ তারা মূল স্রোতে অবহেলিত। নারীদের পিছনে রাখা হয় যেমন করে সিনেমায় নাম দেখানোর সময় নায়কের নাম আগে ও নায়িকার নাম পরে দেখানো হয়। এখানেই মনস্তাত্ত্বিক রহস্য লুকিয়ে আছে।
আমরা আধুনিক সমাজে বাস করছি অথচ এখনো ষোড়শ শতাব্দীর প্রথা মেনে বিয়েতে মেয়েদের দান করে চলেছি। সত্যি মেয়েরা দানের সামগ্রী ? পুজো পার্বনে আমরা কী মেয়েদের পুরোহিত হিসেবে মেনে নিতে পারছি ? পিতা মাতার সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার বাস্তবায়িত হয়েছে ? একটি বিষয় লক্ষণীয় নারী পোষাকের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন পকেট নেই কেন ? তার মানে বুঝিয়ে দেওয়া হয় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রয়োজন নেই। অথচ ঢাক ডোল বাজিয়ে চিৎকার করে বলছি আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বাস করছি এই যুগে নারী পুরুষ সমান। ঘটা করে নারী দিবস পালন করে মেয়েদের সহানুভূতি  দেখাচ্ছি। 
শিক্ষা সংস্কৃতি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাহ্যিক ভাবে যতটা পরিবর্তন করতে পেরেছে মানসিক ভাবে খুব কমই উন্নতি সাধন করতে পেরেছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেন তাদের সংখ্যা হাতে গোনা।বেশির ভাগ মানুষই অদৃষ্ট বলে মেনে নেন।ভাগ্য কে দোষারোপ করেন। পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে নীরবে অত্যাচার সহ্য করেন। এতে অপরাধী আরও প্রশ্রয় পায়।
পাখির দুটো ডানার মধ্যে যদি একটা ডানা দুর্বল হয় তাহলে সে বেশি দূর উড়তে পারবে না। সমাজের দুটো ডানা--- নারী ও পুরুষ। নারী বা পুরুষ যেই দুর্বল হবে সমাজ অগ্রগতির পথে পিছিয়ে পড়বে। এই প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের 'নারী' কবিতার একটি উক্তি স্মরণীয়,---
" গাহি সাম্যের গান
আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অনেক আগেই বলে গেছেন,---"Give me good mother , I will gave you a good nation." কাজেই সভ্যতার অগ্রগতির জন্য শুধু পুরুষ নয়,---নারী সমান অংশীদার।

প্রবন্ধকার উত্তম দেবনাথ 
মধ্য কামাখ্যাগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, পশ্চিমবঙ্গ


















0 Comments