জন্ম : ১৩, জানুয়ারি ১৯৩৮
মৃত্যু : ৭, নভেম্বর ২০১৯
'যারা হাটকে যারা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান'--- যিনি লিখেছিলেন এই শিরোনাম।
নবনীতাদির বাড়িতে কবে যে প্রথম গিয়েছিলাম, এখন আর মনে নেই। না, তখনও সিঁড়ি-লাগোয়া ইস্পাতের চ্যানেলে বসানো ইলেক্ট্রিকে টানা চেয়ারে করে তিনি ওঠানামা করতেন না।
তার পর মাঝে মাঝেই যেতাম 'সানন্দা' পত্রিকার জন্য কবিতা আনতে।
আমি তখন লীলা মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে অনেকগুলো সংকলন যুগ্ম ভাবে সম্পাদনা করে ফেলেছি।
আনন্দ প্রকাশন থেকে আমাকে একদিন বলা হল, আমাদের কয়েকটা সংকলন করে দিন... আমি বেশ কয়েকটা সংকলন করে দিলাম। হঠাৎ একদিন মনে হল, অনেক বিখ্যাত লেখকই তো কবিতা দিয়ে লেখালিখির জীবন শুরু করেছিলেন, আবার অনেক প্রথিতযশা কবিও এমন এক-একটা গল্প লিখে ফেলেছেন, যেগুলো যে কোনও প্রথম সারির গল্পকারের গল্পকেও হার মানাবে। আমি যদি সেই সব কবিদের গল্প নিয়ে একটা বড়সড় সংকলন করি, তা হলে সেটা নিশ্চয়ই বাংলা সাহিত্যে একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। তাই না?
আমি না-হয় মূল কাজটা করলাম, কিন্তু সঙ্গে তো একজন সিনিয়ার কাউকে চাই। তখনই আমার মাথায় এল নবনীতাদির কথা। নবনীতাদিকে বলতেই, উনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সমস্যা হল, লেখক তালিকা নিয়ে।
আমি যাঁদের সঙ্গে এর আগে এবং পরবর্তিকালেও, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি, তাঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন চৌরঙ্গী-খ্যাত ঔপন্যাসিক শংকর, তেমনি ছিলেন সম্পাদকদের সম্পাদক, লেখকদের লেখক, লালবাঈ-খ্যাত রমাপদ চৌধুরীও। কিন্তু না, তাঁদের কারও সঙ্গেই লেখক-তালিকা নিয়ে আমার কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। আমি যে লেখক তালিকা তৈরি করতাম, সবাই তা একবাক্যে মেনে নিতেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল নবনীতাদির সঙ্গে। এবং ওই সমস্যা, আমার সম্পাদনার জীবনে সেই প্রথম।
নবনীতাদি জানতেন, সম্পাদনায় আমার হাতেখড়ি হয়েছে রমাপদবাবুর কাছে। রমাপদবাবুকে উনি খুব ভাল করেই চিনতেন। রমাপদবাবুর কালীঘাটের বাড়িতে তাঁর ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি প্রায়ই আসতেন। সেই লোকটার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক, উনি তা ভাল করেই জানতেন। তবু...
যে দু'টি মানুষ রমাপদবাবুর অত্যন্ত কাছের ছিলেন, তার মধ্যে একজন আমি আর অন্য জন হলেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। এ সব জানার পরেও তিনি আমার লেখক-তালিকা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানালেন।
না, উনি কোন কোন নাম বাদ দিতে চেয়েছিলেন এবং কোন নামগুলো ঢোকাতে চেয়েছিলেন, সেই নামগুলো আমি আর উল্লেখ করতে চাই না। কারণ, তাঁরা অনেকেই স্বনামধন্য এবং কেউ কেউ জীবিতও। আর তার থেকেও বড় কথা, তাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ মধুর। ফলে...
আমি শুধু নবনীতাদিকে বলেছিলাম, সম্পাদনার ক্ষেত্রে আমার কিছু পলিসি আছে।
আমি তাঁদের লেখাই রাখব, যাঁদের বই ইন্ডিভিজুয়ালি তাঁদের নামে বিক্রি হয়। এবং তাঁদের লেখাই রাখব, যাঁরা সময়ের বিচারে এর মধ্যেই উতরে গেছেন। রাখব তাঁদেরই, যাঁরা ইতিমধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন। তার সঙ্গে এও বলেছিলাম, জীবিত লেখকদের লেখা রাখার ব্যাপারে আমি একেবারেই পক্ষপাতি নই। রাখলে প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের লেখাই রাখব। কারণ, বিখ্যাত সব লেখকদের কাছ থেকেই আমার লিখিত অনুমতি নেওয়া আছে।
আমি যখন আমার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়তে নারাজ, তখন তিনি বললেন, তা হলে একটা কাজ করো, তুমিই যখন সব ডিসিশন নিচ্ছ, আমার নামটা আর রেখো না। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমাকে ও ভাবে তাকাতে দেখে তিনি বলেছিলেন, আর রাখলেও, তোমার নামটা আগে রাখো, আমার নামটা পরে।
আমি যখন যাঁর সঙ্গে যৌথ ভাবে কোনও সংকলন সম্পাদনা করেছি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার নামটা সব সময় তাঁদের পরেই রেখেছি। কিন্তু এ কী বলছেন তিনি!
তিনিও নাছোড়বান্দা। তাঁর জায়গা থেকে তিনিও কিছুতেই সরবেন না। অগত্যা দু'জনকেই কিছুটা সমঝোতা করতে হল। অবশেষে পঞ্চাশ জন কবির এক-একটা অনবদ্য গল্প নিয়ে প্রকাশিত হল--- কবির কলমে গল্প।
নবনীতাদি, মানে নবনীতা দেবসেন থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে। তাঁর বাড়ির নাম--- ভালো-বাসা। সেখানেই ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহন করেন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত কবি নরেন্দ্র দেব। মা রাধারাণী দেবী। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, লিলুয়ার যে 'দেবালয়' বাড়িতে নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণীর বিয়ে হয়েছিল, সেটা ছিল বেশ বড় বাড়ি। ছিল বিশাল পুকুর। অনেকখানি জায়দা নিয়ে বাগান। সেখানে সব রকমের শাক-সবজিই হত। মাছও কিনতে হত না। বাড়িতে মুরগিও ছিল। ফলে বাজারও যেতে হত না খুব একটা। উপরন্তু যে বড় বড় ঘাস হত, সেগুলো রঘুভাই, মানে নবনীতাদিকে যিনি মানুষ করেছিলেন, সেই গুনিয়া ভাইয়ের দাদা--- সে-ই ঘাস কেটে আস্তাবলে গিয়ে বিক্রি করে দিয়ে আসতেন।
সেই বাড়ি বিক্রি করেই হিন্দুস্থান পার্কের এই বাড়ি কেনা হয়। তত দিনে প্রথম সন্তানকে খুইয়েছেন নরেন্দ্র-রাধারাণী। জন্মের মাত্র কয়েক দিন পরেই সেই ছোট্ট প্রাণ চিরতরে নিভে গেছে। ভেঙে পড়ছে রাধারাণীর শরীরও। তাই নতুন বাড়িতে আলো-বাতাস খেলার পর্যাপ্ত অবকাশ রেখেছিলেন নরেন্দ্র। একদিন সেই দুঃসময় কেটে গেল। কোল আলো করে এল তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান--- খুকু। হ্যাঁ, জন্ম হল নবনীতার। কিন্তু রঘুভাইয়ের কাছে লিলুয়ার ওই বাড়ির গল্প শুনলেও, কেমন যেন বিশ্বাস হত না তাঁর। মনে হত রূপকথা। তাই অনেক বড় হওয়ার পরে তিনি একবার বাবা-মায়ের স্মৃতি বিজরিত সেই বাড়িটি দেখতেও গিয়েছিলেন।
যে বাড়িতে তাঁর মা রাধারাণী দেবী, দাদা-জামাইবাবুরা উপস্থিত থাকা সত্বেও, তিনি নিজের বিয়েতে নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করেছিলেন।
আসলে মাত্র তেরো বছর বয়সে রাধারাণীর প্রথম বিয়ে হয়। সংসার কী— তা বুঝে ওঠার আগেই, বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এশিয়াটিক ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন তাঁর স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ। সে সময় তাঁর শ্বশুরবাড়ি, বিশেষ করে তাঁর শাশুড়ি তাঁ পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে, আরও পরে, যখন তিনি পুরোমাত্রায় লেখালিখি করছেন, তখন 'কাব্য-দিপালী’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন নরেন্দ্রনাথ দেব। সেই কাজে সাহায্য করতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে রাধারাণীর। এর চার বছর পরেই দু’জনের বিয়ে।
প্রথম বিয়ের বৈধব্যের পর রাধারাণী নতুন জীবনে আনীতা হচ্ছেন দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নতুন নামকরণ করেছিলেন--- নবনীতা। কিন্তু রাধারাণী দেবী তা প্রত্যাক্ষ্যাণ করেন। তিনি বলেন, আঠাশ বছর ধরে যে নামটা বয়ে বেড়াচ্ছি, যে নামে ইতিমধ্যে দু'-দুটো বই বেরিয়ে গেছে, সে নাম আর পাল্টাব না।
তাই নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণীর যখন কন্যা সন্তান হল, তখন তাঁদের মেয়ের মাত্র তিন দিন বয়সে, সেই মেয়ের উদ্দেশে একটি চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথ। তাতে তিনি লেখেন, যেহেতু প্রত্যাখ্যান করার মতো তুমি অত বড় হওনি, তাই তোমার নাম দিলাম--- নবনীতা।
তারও কিছু দিন আগে, মানে এই নবনীতার জন্মেরও আগে, আরও অনেকের মতোই আরও একজন অবশ্য তাঁর নামকরণ করেছিলেন। তাঁর নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি তখন শেষ শয্যায়। সেই অবস্থাতেই বলেছিলেন, বলেছিলেন, তোমাদের যদি ছেলে হয়, তাঁর নাম রেখো, দেবদত্ত। আর মেয়ে হলে--- অণুরাধা। ছোট রাধা তো, তাই অণু, অণুরাধা। যদিও তিনি আর দেখে যেতে পারেননি এই মেয়েকে। কারণ, তার তিন দিন আগেই তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু না। শরৎচন্দ্রের দেওয়া মেয়ের সেই নাম আর রাখা হয়নি ওঁদের। স্থায়ী হল, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নামটাই। নবনীতা। তাঁর নামের প্রসঙ্গে উঠলেই নবনীতা তাই বলতেন, এই নাম তাঁর 'না চাহিতে পাওয়া ধন।'
বাড়ির সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে পড়াশোনা। পরে লেডি ব্রাবোর্ন, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং যাদবপুরে। তারও পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসটিংশন নিয়ে আবারও এম এ। পি এইচ ডি করেন ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পোস্ট ডক্টরেট ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৯৭৫ থেকে ২০০২ সাল অবধি তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং বেশ কিছু কাল বিভাগীয় প্রধানও ছিলেন। এ ছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও বেশ কিছু দিন তিনি পড়িয়েছেন। তাঁকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট জন হিসেবেই গণ্য করা হয়।
শুধু পড়াশোনাই নয়, পড়াশোনার বাইরেও খেলাধুলোর প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম আগ্রহ। দারুণ জিমন্যাসটিক জানতেন। বাসকেটবল খেলতেন। সাঁতার কাটতেন। ইন্টার স্কুল স্পোর্টসে তাঁর ছিল বাঁধা পুরস্কার।
একবার কলকাতা বইমেলায় দেখা হতেই কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী বই কিনলেন? উনি বলেছিলেন, বইমেলায় বই কিনে তো আমাদের কোনও লাভ নেই। এখানে টেন পার্সেন্ট দেয়। বাইরে থেকে কিনলে তো টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ফাইভ পাই। আব্দার করলে কেউ কেউ আবার আরও বেশি দেয়। বইমেলায় এলে একটাই লাভ। বহু পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে দেখা হয়। আলাপ হয়। এই বইমেলাকে কেন্দ্র করেই কত জনের সঙ্গে যে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কী বলব!
যে বাড়িতে শুধু বাবা মা-ই নন, পিসি, মাসি, কাকা, জেঠা এবং বাবা-মায়ের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই লেখেন, সে বাড়ির বাচ্চাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ছোটরা তো পড়াশোনা করে। খেলাধুলো করে। বড়রা কী করে? তারা তো বলবেই--- বড়রা শুধু লেখে।
নবনীতারও তাই মনে হয়েছিল। ফলে ছোটবেলাতেই কলম তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের স্কুলের ম্যাগাজিন--- 'সাধনা'য়। একই সঙ্গে ছাপা হয়েছিল বাংলা এবং ইংরেজি ছড়া ছাড়াও, কাল বৈশাখী ঝড় নিয়ে একটি প্রবন্ধ। তাঁর প্রথম বাণিজ্যিক কাগজে লেখা প্রকাশিত হয় মাত্র বারো বছর বয়সে--- ভারতবর্ষে।
বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া, ফরাসি, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাও তিনি বেশ ভাল ভাবেই জানতেন।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' প্রকাশিত হয় ১৯৫৯-এ। এবং প্রথম উপন্যাস 'আমি, অনুপম' ১৯৭৬-এ। কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনি, উপন্যাস মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য--- নব-নীতা, দেশান্তর, দ্বিরাগমন, অভিজ্ঞান, ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে, সীতা থেকে শুরু, নবনীতার নোট বই। এ ছাড়াও আছে--- ভ্রমণের নবনীতা, রঙ্কিণীর রাজ্যপট এবং অন্যান্য, অ্যালবাট্রস, হে পূর্ণ তব চরণের কাছে, তিতলি, স্বপ্ন কেনার সদাগর, পলাশপুরের পিকনিক।
তিনি দীর্ঘ দিন ‘রামকথা’ নিয়ে কাজ করছেন। সীতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রামকথার বিশ্লেষণ করেছেন। ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’ তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
কথা বলতে যেমন তিনি ভালবাসতেন, তেমনি ভালও বাসতেন মানুষকে৷ আপন করে নিতে জানতেন। ১৯৬০-এ বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ (পরবর্তী কালে নোবেলজয়ী) অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। যদিও এনগেজমেন্ট হয়েছিল বিদেশে। ১৯৫৯ সালে। সেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল তাঁদের বাড়ির উল্টো দিকে, পশ্চিমবঙ্গের এক সময়ের দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু আর বিখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ি সান্যালের বাড়িতে। এই বিয়ের অনুষ্ঠান করার জন্যই পাশাপাশি এই দুই বাড়ির মাঝখানের পাঁচিল ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
বিয়ের পরে তিনি যখন বিদেশে, সে সময় নবনীতা দেব থেকে তিনি প্রথম প্রথম নবনীতা ডি সেন লিখতে শুরু করেন। নাম হিসেবে নবনীতা, পদবি হিসেবে দেব, আর মধ্য নাম হিসেবে ডি। পরে আর 'ডি' নয়, পুরোপুরি--- নবনীতা দেবসেন।
তাঁদের দুটি মেয়ে। বড় মেয়ে অন্তরা। পেশায় সাংবাদিক ও সম্পাদক। আর ছোট মেয়ে নন্দনা। অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী। এ ছাড়াও তাঁদের একটি মেয়ে আছে। পালিতা। যদিও তাঁদের সেই বিয়েটা টেকেনি। বিয়ের ষোলো বছর পর ১৯৭৬ সালে সেটা ভেঙে যায়।
পড়াশোনা এবং পড়ানোর ব্যস্ততার মধ্যেও কিন্তু নবনীতার কলম কখনও থেমে থাকেনি। একের পর এক লিখে গিয়েছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস। রম্যরচনাতেও ছিল তাঁর নজরকাড়া মুন্সিয়ানা। শুধু লেখালিখি নয়, আকের সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে 'সংলাপ' নামে একটি পত্রিকাও চালু করেছিলেন তিনি। যত্ন সহকারে সম্পাদনাও করতেন।
তাঁর ক্ষোভ ছিল, ইন্ডিয়ান লিটেরেচার বলতে ভারতীয়দের লেখা শুধু ইংরেজি বইগুলোকেই কেন বোঝাবে? বাকি ভাষাগুলোকে এ ভাবে আঞ্চলিক করে দেওয়ার প্রবণতা কেন? তিনি একবার বলেছিলেন, এর পর তো রবীন্দ্রনাথ, প্রেমচাঁদও ব্রাত্য হয়ে যাবেন!
বলেছিলেন, ইংরেজিতে লিখলেই, সেটা যেন অত্যন্ত উচ্চমার্গের। লেখার মান যাই হোক না কেন, ওগুলোকেই পুরস্কার দিতে হবে। আর ওগুলোকে পুরস্কার দেওয়ার ফলে, বাংলা-সহ অন্যান্য ভাষাতেও যে অসামান্য এক-একটা সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তা লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে যাচ্ছে। লোকে ভাবছে, ওই ইংরেজিগুলোই বুঝি মূল ভারতীয় সাহিত্য। ফলে বিশ্বসাহিত্যের কাছে সত্যিকারের যে ভারতীয় সাহিত্য, তার মান ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। বুঝতে পারি না, ভারতীয় সাহিত্য বলতে ওগুলোকেই তুলে ধরা হচ্ছে কেন? লীলা মজুমদার কি কম বড় মাপের লেখিকা? এখনও তাঁর লেখা পড়লে মুগ্ধ হয়ে যাই।
ওঁর মনে হত, সিনেমা জগতের কাস্টিং কাউচের মতো আমাদের লেখালিখির জগতেও ওই সব ঢুকে পড়েছে। পুরুষরাই ডমিনেট করার চেষ্টা করছে মহিলা কবি-সাহিত্যিকদের। তাই তিনি গড়ে তুলেছিলেন, 'সই'য়ের মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। যেটা মেয়েদের নিয়ে, মেয়েদের জন্য এবং মেয়েদের দ্বারাই পরিচালিত হয়।
আফসোস করতেন, প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচার নিয়েও। প্ল্যাস্টিক ব্যবহার নিয়ে, বন কাটা নিয়ে, জলাশয় ভরাট নিয়েও সোচ্চার ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলতেন, ঋতুগুলো সব পাল্টে যাচ্ছে!
আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনা ‘নটী নবনীতা‘ গ্রন্থের জন্যে তিনি ১৯৯৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। ২০০০ সালে পদ্মশ্রী সম্মান ছাড়াও পেয়েছেন মহাদেবী বর্মা ও ভারতীয় ভাষা পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও অজস্র পুরস্কার।
শুধু ভারতের তাবড় তাবড় কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গেই নয়, উমবের্তো একো, জাক দেরিদা, গুন্টার গ্রাস, নাদিন গর্ডিমার অ্যালেন গিনসবার্গ, কার্লোস ফুয়েন্তেস মার্গারেট অ্যাটউডের মতো দেশ-বিদেশের বিখ্যাত কবিনসাহিত্যিকদের সঙ্গেও তাঁর ছিল দারুণ সখ্যতা। আর সে জন্যই বোধহয় তিনি ছিলেন একদম ভয়ডরহীন অত্যন্ত স্মার্ট একজন মহিলা। স্মার্ট না হলে যে শিরোনাম লেখার আগে সদ্য লিখতে আসা বেপরোয়া, উদ্ধত ছেলেমেয়েরাও দশ বার ভাববে, ভাবলেও লিখতে সাহস পাবে কি না সন্দেহ, তিনি তা অবলীলায় লিখে দিতেন।
১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন যখন নোবেল পেলেন, তার প্রায় বাইশ বছর আগেই তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তবু সেই নোবেল পুরস্কারের ধাক্কা সামলাতে হয়েছিল অমর্ত্য সেনের প্রথমা স্ত্রী এই নবনীতাকেও। সে বছর একটি নামকরা সাহিত্য পত্রিকার পুজো সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন এক অসামান্য রম্যরচনা। আর তার শিরোনাম? এখনও চমকে দেবে বহু মানুষকে। তিনি লিখেছিলেন--- যারা হাটকে যারা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান।
এত ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেও একটা মানুষ যে এত রসিক, এত মন খোলা, দিলদার হতে পারেন, নিজেকে নিয়ে, এমনকী, নিজের ক্যানসার হয়েছে জানার পরেও, নিজের আসন্ন মৃত্যু নিয়েও কেউ যে এত মজা করতে পারেন, তা একমাত্র নবনীতাকে সামনে থেকে না দেখলে বা তাঁর লেখার নিমগ্ন পাঠক না হলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না।
এই তো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার কয়েক দিন আগে তিনি একটি দৈনিক পত্রিকায় লিখেছিলেন--- যে সব মানুষ আমাকে একবারও চোখে দ্যাখেনি, দূর দূর গ্রাম থেকে ছুটে আসতে চাইছে একবার শেষ দ্যাখা দেখতে— আরে, এটাই শেষ দ্যাখা, তোমায় কে বলল? এই যে এত লম্বা জীবনটা কাটালুম, তার একটা যথাযথ সমাপন তো দরকার! পাঁজিপুঁথি দেখে, শুভ দিন, শুভ লগ্ন স্থির করে, স্বজনবান্ধবকে নেমতন্ন খাইয়ে তবে তো শুভযাত্রা!
নিজেকে নিয়ে, নিজের মৃত্যুকে নিয়ে এ ভাবে রসিকতা করার মতো স্পর্ধা বোধ হয় একমাত্র তাঁকেই মানায়৷
আসলে নবনীতা হল এমন এক জন, যাঁর পুরো পরিবারটাই বিখ্যাত! বাবা বিখ্যাত, মা বিখ্যাত, স্বামী বিখ্যাত, মেয়েরাও যথেষ্ট খ্যাতিমান।
কিছু দিন আগে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে কলকাতায় এসেছিলেন অমর্ত্য সেন। নবনীতাদি শুধু আমাকেই যেতে বলেননি, আমার ছেলেকেও নিয়ে যেতে বলেছিলেন। এসেছিল নবনীতাদির মেয়ে-জামাইও। দারুণ জমে উঠেছিল সে দিন।
নবনীতাদি চলে যাওয়ার দু'দিন আগেও গিয়েছিলাম 'ভালো-বাসা'য়। আমার সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'ভারত বিচিত্রা'র সম্পাদক নান্টু রায়। না, ওঁর তখন ওঠার মতো অবস্থা ছিল না। আমি নবনীতাদিকে লাস্ট দেখেছিলাম, সদ্য নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন ওঁকে দেখতে গিয়েছিলেন, সে দিন।
তিনি একদিন আফসোস করে বলেছিলেন, আমি খুব ঘুরতে ভালবাসি। যদিও সারা পৃথিবী উনি যে কত বার ঘুরেছেন, তার কোনও ঠিক নেই। নবনীতা ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র।
দীর্ঘ দিন হাঁপানিতে ভুগেছেন। ইনহেলার নিয়ে ঘুরতেন। অথচ শরীর নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, না না, ও কিছু না। আসলে, শারীরিক কোনও সমস্যাকেই উনি বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইতেন না। এই যেমন, আলাস্কার মতো জায়গায় ওঁর মতো একজন হাঁপানি রোগী দুম করে ঘুরতে চলে গেলেন। একবার নয়, একাধিকবার আলাস্কায় গিয়েছিলেন তিনি। ভাবা যায়!
তবু কথায় কথায় বলতেন, আমার খুব ইচ্ছে ছিল ইজিপ্টে যাওয়ার। সাউথ আফ্রিকা যাওয়ার। কায়রো যাওয়ার। অবশ্য কায়রো বিমানবন্দর অবধি আমি গিয়েছি। কিন্তু নেমে ঘোরা হয়নি। আর এখন যা পায়ের অবস্থা, মনে হচ্ছে আন্দামানও আমার দেখা হবে না!
কিছু দিন আগে নবনীতাদির বাড়িতে আমার এক বাংলাদেশি লেখক-বন্ধুকে নিয়ে আচমকাই হাজির হয়ে ছিলাম ভরদুপুরে। আমি ফোন-টোন না করে এ রকমই হুটহাট চলে যেতাম। সে দিনও গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ গল্প হল। উঠে আসার সময় আমার সেই বন্ধুটি বলল, দিদির সঙ্গে একটা ছবি নিয়ে নিই...
না, তরুণরা কেউ কিছু বললে উনি কাউকেই নিরাশ করতেন না। কিন্তু সে দিন তিনি বললেন, না, আজ থাক। ছবি তুলে কী হবে? আর ক'দিন পরে তো এমনিই ছবি হয়ে যাব।
সে দিন এই কথাটার মানে বুঝিনি। আজ বুঝতে পারছি। ভীষণ ভাবে বুঝতে পারছি।
২৭/পি, আলিপুর রোড, কলকাতা