সুমিতা চক্রবর্তীর আত্মকথন



যেখানে সময় থেমে গেছে 

সময়টা ১৭৬৫ সাল। দীর্ঘ সাত বছরের বন্দী জীবন কাটিয়ে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদ থেকে মুক্তি পেয়েছি। এসেছি আমার ফেলে আসা শহর মুর্শিদাবাদে - হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার খোঁজে। শহরটাকে এখন অচেনা লাগে। এই সাত বছরে কতো জল বয়ে গেছে ভাগীরথী দিয়ে। মুর্শিদাবাদ কি আমাকে মনে রেখেছে? মনে পড়ে,একসময় এই ঐতিহাসিক শহরের নবাব সিরাজদৌল্লার বেগম লুত্ফুন্নিসার কথা ! তখন কতো সম্মান ,গুণমুগ্ধতা ,বৈভব,জৌলুস আমাকে ঘিরে। আর ছিলো নবাবের প্রাণভরা ভালোবাসা। আমার মতো সামান্য একজন দাসীকে বিবাহ করে রানির মর্যাদা দিয়েছিলেন তিনি। আগে ছিলাম নবাবের মাতা আমিনা বেগমের পরিচারিকা। তখন আমি হিন্দু ছিলাম , নাম ছিলো রাজ কুনয়ার। তখন থেকেই মুগ্ধ চোখে সিরাজকে দেখতাম। ও তখন নবাব হননি। বিবাহ হয়েছিলো উমদাতুন্নিসার সাথে। ঐ বেগম সিরাজকে সুখী করতে পারেননি। বেগম রাজবাড়ির ভোগ বিলাসে মত্ত থাকতেন। পরে আমিনা বেগম আমার দায়িত্ব তুলে দেন সিরাজের হাতে। তখন থেকে সিরাজের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। বুঝতাম সিরাজ ক্রমশ আমার রূপ আর গুণের প্রতি মুগ্ধ হচ্ছেন। খুব ভালো লাগত। আমিও যে মনে মনে চাইতাম ওঁকে ! বলতে পারিনি। আমি যে সামান্য দাসী। কিন্তু সিরাজ নিজেই একদিন আমার প্রতি ওঁর ভালোবাসার কথা জানালেন। সেদিন যে কি আনন্দের দিন ছিলো আমার ! তারপর ১৭৫২সালে নবাব আলিবর্দি খাঁ তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজের জন্য সিংহাসনের উত্তরাধিকার ঘোষনা করেন। সেদিন ভারী গর্ব হয়েছিলো আমার সিরাজের জন্য। ঐ বছরই সিরাজ আমাকে বিবাহ করেন।

শুনেছি ১৭০৪ সালে মুর্শিদাবাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তাঁর নামেই শহরের এই নামকরণ। আগে এর নাম ছিলো মুকসুদাবাদ। বরাবরই এই শহর বিখ্যাত এর রেশম শিল্প আর হাতির দাঁতের তৈরী সামগ্রীর জন্য। আর একটা কারণে এর প্রসিদ্ধি ছিলো,তা হল জরির কাজ। নবাব নগর বলে কথা ! যাক, যেকথা বলছিলাম। আমার বিয়ের কথা। তখন ১৭৫২ সাল। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ তখন সমৃদ্ধির শহর।গোটা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যর রাজধানী। আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছিল ধুমধাম করে। সিরাজ তখন একেবারেই তরুন। সুদর্শন ,তরুন স্বামীকে তখন আমি ছায়ার মতো অনুসরণ করতাম। হীরাঝিলে সিরাজ তখন তাঁর স্বপ্নের প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। গৌড়ের ভগ্নস্তূপ থেকে পাথর এনে তৈরী হয়েছিলো এই প্রাসাদ। আগে এখানে ছিলো একটা দিঘি। সেই দিঘি থেকে ঝিল কাটা হোলো। নাম হোলো হীরাঝিল। চারদিক সাজানো ছিলো গাছ দিয়ে। ঝিলের স্বচ্ছ জলে দেখা যেতো প্রাসাদের অপূর্ব প্রতিবিম্ব। সে এক স্বর্গীয় সুখের দিন ছিলো। মনে আছে জ্যোৎস্না রাতে কতদিন ঝিলের পাড়ে বসে থাকতাম সিরাজের পাশে,হাতে হাত রেখে। তারপর আমাদের মাঝে এলো ফুটফুটে কন্যা - আমাদের জোহরা। আলিবর্দি খাঁর ঘোষনা অনুযায়ী ১৭৫৬ সালে সিরাজ নবাব হলেন বাংলা , বিহার , উড়িষ্যর। আর আমি হলাম তাঁর বেগম লুত্ফুন্নিসা। নবাব বিয়ের পর আমাকে এই নাম দিয়েছিলেন। আমি তাঁর ধর্ম গ্রহণ করেছিলাম। তখন থেকে দুশ্চিন্তা সঙ্গী হোলো সিরাজের। বুঝতাম ঘরে বাইরে ওঁর তখন অনেক শত্রু। ওঁকে ঘিরে অনেক ষড়যন্ত্র। কিন্তু ওঁকে মনমরা দেখলে খুব কষ্ট হতো আমার। তাই কখনো ওঁর সাথে খুনসুটি করে,কখনো ওঁর কোনো আসন্ন সমস্যার সমাধান বাতলে দিয়ে খুশী রাখতে চাইতাম ওঁকে। সিরাজও তখন অনেক ব্যাপারেই নির্ভর করতেন আমার উপরে।

নবাবের অনেক শত্রুর মধ্যে যাঁদের কথা বেশি মনে পড়ে, তাঁরা হলেন ঘসেটি বেগম, জগত শেঠ, মির্জাফর এবং লর্ড ক্লাইভ। নবাব আলিবর্দি খাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা ,ছিলো তিন কন্যা।এঁদের মধ্যে বড়ো কন্যা এই ঘসেটি বেগম। এনার কোনো সন্তান ছিলনা। সিরাজের ভাই ছিলেন ওনার পোষ্যপুত্র। ঘসেটি বেগম চাইতেন ওনার পোষ্যপুত্র নবাব হোক। আর তিনি রাজমাতা হয়ে রাজ্য পরিচালনা করবেন। তাই সিরাজকে কোনোদিন নবাব হিসাবে মেনে নিতে পারেননি। সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেন ইংরেজদের সঙ্গে।

নবাবের অনেক অমাত্যদের প্রলোভন দিয়ে দলে টেনেছিলেন ইংরেজরা। এমন একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন জগত শেঠ। আলিবর্দি খাঁকে নবাবের পদে বসাতে ওনার ভূমিকা ছিলো। তাই তিনি আশা করেছিলেন সিরাজ ওঁর কথামতো চলবেন। তাই কি হয় ! সিরাজ একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন স্বাধীনতাচেতা মানুষ। তিনি ইংরেজদেরই মানতেননা। তাই জগত শেঠও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন।

শুনেছি রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল সন্তান। তাই পিতা - মাতা  বিরক্ত হয়ে কোম্পানির কাজে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কোম্পানির ব্যবসার কাজে বিরক্ত হয়ে ক্লাইভ নাকি দুবার গুলি করে আত্মহত্যা করতে গেছিলেন। ধূর্ত  ক্লাইভ রাজসভার অনেককেই সিরাজের বিরুদ্ধে এনেছিলেন। বিশেষ করে মির্জাফরকে।

শুনেছি মির্জাফর নাকি কপর্দকশূন্য অবস্থায় পারস্য থেকে এদেশে এসেছিলেন। কূটকৌশলে নবাব আলিবর্দি খাঁর স্নেহ ভাজন হন। কিন্তু এমন বেইমান যে বারবার নবাবের বিরুদ্ধেই চক্রান্ত করতেন। আর ততবার আলিবর্দি খাঁ তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু এবার সিরাজের বিরুদ্ধে যা  করলেন , তার জন্য ইতিহাস তাঁকে ক্ষমা করবেনা। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশির প্রান্তরে সিরাজের সাথে যুদ্ধ হোলো ইংরেজদের। মির্জাফর ছিলেন নবাবের প্রধান সেনাপতি। সিরাজ বিশ্বাস করেছিলেন তাঁকে। কোরান ছুঁয়ে শপথ করেও যুদ্ধ করলেননা। তাই একরকম বিনা বাঁধায় ইংরেজরা পরাজিত করলেন সিরাজকে।

সেই অভিশপ্ত দিনটা কোনোদিন ভুলতে পারবনা। ক্লান্ত , বিশ্বাস ভঙ্গে মর্মাহত সিরাজ ফিরে এলেন হীরাঝিল প্রাসাদে। তখন ওঁর মুখটা দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। সিরাজ কিন্তু তখনও ভেঙে পরেননি। আমাকে সান্তনা দিয়েছিলেন - আবার ফিরে আসবেন অনেক সৈন্য নিয়ে , আবার সিংহাসনে বসবেন। তাই এখন একা পালিয়ে যাবেন। কিন্তু আমার মনটা কু গাইছিল। তাই ওঁকে একা ছাড়তে চাইনি। শেষে আমার আব্দারে সিরাজ আমাকে আর জোহরাকে নিয়ে নৌকায় চাপলেন। নদীর চড়ায় নৌকা আটকে গেলো। খিদেয় কান্না শুরু করলো জোহরা। নিরুপায় সিরাজ নৌকা থেকে নেমে খাবারের সন্ধান করছিলেন। এদিকে মির্জফরের বাহিনী নবাবের সন্ধান করছিলেন। তাঁদের গুপ্তচর নবাবকে চিনে ফেলে। যদিও সিরাজ ছদ্মবেশে ছিলেন। কিন্তু ওনার নাগরাই জুতোই চিনিয়ে দেয় ওঁকে। বন্দী হলেন নবাব। তখন থেকে চিরকালের মতো হারিয়ে গেলেন আমার জীবন থেকে।

সিরাজের বিরহে দগ্ধ আমাকে সেইসময় বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন মির্জাফর আর তাঁর পুত্র মিরন। আমি ঘৃণাভরে বলেছিলাম " যে হাতির পিঠে চড়তে অভ্যস্ত , সে কখন সুযোগ পেলেও গাধার পিঠে চড়েনা। " শুনে ক্রোধে ওঁরা ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে পাঠিয়ে দেন আমাকে। সেখানেই বন্দী ছিলাম এতদিন। আমার সঙ্গে বন্দী ছিলেন শোকাতুরা সিরাজের মা ও ঘসেটি বেগম। পরে শুনেছি ওঁদের মিরনের নির্দেশে বুকে বালির বস্তা বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো।

কিন্তু আমার উপর এঁদের অনেক দয়া। প্রাণে মারেননি! ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি পেনশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মুর্শিদাবাদে ফিরে খোশবাগে আমার স্বামীর সমাধির পাশে একটা কুড়েঘরে থাকি। সিরাজের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছি। ওঁর সমাধি পরিস্কার করি , ধূপ দিই , কোরান পাঠ করি। এভাবেই দিন কাটে। আল্লার কাছে একটাই দোঁয়া- জন্মে না হলেও মৃত্যুর পরে যেন স্বামীর সমাধির পাশে ঠাঁই পাই।

সাহিত্যিক সুমিতা চক্রবর্তী 
বেলুড়, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ































0 Comments