চমক মজুমদারের স্মৃতি আলেখ্য


এইম ইন লাইফ, লাইটম্যান আর ছায়াছবিরা

আমরা প্রাথমিকে ইংরাজি বা পাশ-ফেল উঠে যাওয়ার আগের ব্যাচ। তখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোনো না কোনো পরিক্ষায় একটা ইংরাজি এসে আসতই—ইয়োর এইম ইন লাইফ। প্রতিবারই ক্লাসশুদ্ধু ছেলে বানিয়ে লিখতাম আমরা কী হতে চাই। কেউ ডাক্তার,কেউ ইঞ্জিনিয়ার,কেউ বৈজ্ঞানিক।ক্লাসে স্ট্যান্ড করা ছেলেরা কেউ কেউ লিখত—সমাজসেবা করবে। বলা বাহুল্য আমরা কেউই সেই সময় লিখিনি কেরানী/ আমলা হবো। কিন্তু পড়াশুনো শেষ করে পুরো মিডল ক্লাস ছুটেছি সেই সরকারী চাকরীর পিছনেই। যাই হোক, সে অন্য কথা। আমি অন্তত যেটা লিখতাম সেটা পুরোপুরি মুখস্ত, শুধুমাত্র পরীক্ষার খাতার জন্যই। নব্বই দশকটা আমাদের কাছে বিখ্যাত লোডশেডিংয়ের জন্য। সন্ধেবেলা পড়তে বসার সাথে সাথে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসতো। অ্যানুয়াল পরিক্ষার পরপর যখন পড়ার চাপ কম, তখন কারেন্ট চলে গেলেই পাড়াসুদ্ধু লোক নেমে আসত পাড়ার রাস্তায়, হাওয়া খেতে। আস্তে আস্তে পড়ার চাপ বাড়তে থাকার সাথে সাথেই সবাই ভিড় করতাম হ্যারিকেনের চারপাশে।ফাঁকিবাজ আমি চিরকালই। তাই দেওয়াল আর হ্যারিকেনের মাঝে আঙুলের কারসাজিতে শুরু করে দিতাম শ্যাডোগ্রাফি। দেওয়ালে শুরু হয়ে যেত সিল্যুলয়েটের সিনেমা। ফুটে উঠত হরিণ, কুকুর।

ছোটবেলা থেকেই টিভির পোকা। ফি সপ্তাহে দূরদর্শনের ছায়াছবিতে তখন সৎ পুলিশ অফিসারদের ভিড়। জণজিরের অমিতাভ বা শত্রুর রঞ্জিত মল্লিক তখন মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের বাড়ির পিছনের বাগানটাতে বন্ধুরা মিলে দিব্যি শুরু হয়ে যেত চোর পুলিশ খেলা। দুর্গাপুজোর সময় কেনা ক্যাপ ফাটানো পিস্তল নিয়ে আমরা তখন সৎ পুলিশ অফিসার। একটু বড় হতেই বাড়ির বাগান বদলে গেছে ফুটবলের মাঠে। সাদা কালো ছোপের বল আর স্পাইক পায়ে অ্যাম্বিশনটাও বদলে গেছে। তখন মাথায় ঘুরছে রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, দুঙ্গা’রা। মাধ্যমিক পরিক্ষার বছরে মোহনবাগান প্রথমবার জাতীয় লিগ পেয়ে গেল। তখনো জাতীয় লীগ আই লিগ হয়নি। ব্যাস আগুনে ঘৃতাহুতি। মাধ্যমিকে ‘এইম ইন লাইফ’ এলেই ফুটবলার লিখে দিই আরকি।

মাধ্যমিকটা আমাদের কাছে অনেকটা রেলগেটের মতো ছিল। গেট ফেলা রয়েছে, মানে সামনে দিয়ে ট্রেন যাবে। গেট উঠে গেলেই দুদিক না তাকিয়েও রেললাইন পার হওয়া যায়। মাধ্যমিক পাশ করে পিছনে একটি লেজ গজালো। এবং একদিন দুপুরে ব্রাঞ্চ স্কুলের পাঁচিল টপকে আমরা কয়েকজন বন্ধু পৌঁছে গেলাম অরো সিনেমা হলের সামনে। দুপুর এক’টার শো। আমাদের চোখ ঘুরঘুর করছে পরিচিত কোনো মুখের খোঁজে। এমন কাউকে পেলেই সটকে পড়তে হবে। প্রথমদিন এমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু ওইদিনই আমার অ্যাম্বিশন আবার ফুটবলার থেকে সরে গেল অন্যত্র। সেইদিনের সেই সিনেমাটার নাম আজো মনে আছে –হাসিনা মান জায়েগি। পুরোটা দেখতে পারিনি। প্রথমত ছবিটা খুব খারাপ লাগছিল আর সময়ে বাড়ি ফেরার টেনশন ছিল। কিন্তু সেই শুরু, বাঁধটা ভেঙে গেল। এরপর থেকে সিনেমা দেখাটা একটা সাধারণ নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেল। আর আমি হিংসে করে যেতে লাগলাম সেই লোকগুলোকে। সেই লোকগুলো, যারা সিনেমা হলের ঘন অন্ধকারেও ঠিক আপনাকে আপনার সিটের রোয়ের সামনে এনে সিটের উপর টর্চের আলো ফেলবে। অদ্ভুত তাদের দক্ষতা, প্রেমিকদের কাপল সিট একদিকে, লেডিসরা উল্টোদিকে—অসাধারণ ক্ষমতায় পথ দেখিয়ে সিটে বসিয়ে দেবে, লাইটম্যানরা। এখনকার মাল্টিপ্লেক্সের মতো হলের সিড়িপথে তখন কিন্তু টিমটিমে আলো লাগানো থাকতো না। মন যখন তখন গেয়ে উঠতেই পারতো –ও আলোর পথযাত্রী...। হিংসে করতাম এই লাইটম্যানদের। এরাই আমার টিনএজের শেষ যুগের অ্যাম্বিশন হয়ে উঠেছিল ক্রমশ। মনে মনে ভাবতাম, যদি এদের মতো হওয়া যায় তবে তো ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’য়ের টিকিটের জন্য সকাল থেকে লাইন দিতে হবে না। রোজ সিনেমা দেখা তাও তিনবেলা। কী মজা!

সেই সব দিনে, সিলেবাস ক্রমশ বাড়ছে আর বেড়ে যাচ্ছে আমাদের সিনেমা দেখার সাহস। বেশিরভাগ সিনেমা হলের নাম মেয়েদের নামে কেন কে জানে। আমাদের মফস্বলের চারপাশের যত সিনেমাহল সব হয় মহিলাদের নামে না হয় ভগবানের নামে। এক শুক্রবার দুপুরে ‘মিলন’এ দেখতে গেছি শাহরুখ খানের বাদশা। টাইম হয়ে গেছে কিন্তু তখনও ফার্স্ট বেল পড়েনি। গেটও খোলেনি। এদিকে টিকিট হাউসফুল। সিনেমা হলের সামনের উঠোনে লোকে লোকারণ্য। আমাদের বন্ধুদের গ্রুপটা একেবারে বিশাল গেটটার সামনে। হঠাৎ খবর এলো সিনেমার রিল এখনো আসেনি। সেই সময় ডিজিটাল প্রোজেকশন শুরু হয়নি। উঠোনের ভিড়টা ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে। সময় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। বন্ধ গ্রিলের ওপাশে কয়েকজন গেটকিপার আর লাইটম্যান। আর এপাশের প্রথমেই আমরা। জায়গাটা নিয়েছিলাম, যাতে গেট খুললেই ঢুকে যাওয়া যায়। ভিড়টা ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে। চাপ বাড়ছে আমাদের উপর। আমি ক্রমশ চেপ্টে যাচ্ছি গ্রিলের সাথে। শুরু হয়ে গেল ইটবৃষ্টি। ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়ছে হলের কাঁচ। দু একটা মিস ফায়ার হয়ে আমাদের দিকেও ছুটে আসছে। কোনো রকমে মাথা নিচু করে বাঁচছি। এমন সময় রে রে করে হলের পাশের পাড়া থেকে কিছু ছেলে হাতে বাঁশ নিয়ে বের হয়ে এলো। এসেই ঝাপিয়ে পড়লো উঠোনের ভিড়টার উপর, ইট ছুড়তে থাকা ছেলেরাই তাদের মূল লক্ষ্য। একটা দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। যে যেখানে পারছে পালাচ্ছে। আমরা কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের একদিকে বন্ধ গ্রিলের দরজা অন্যদিকে এগিয়ে আসছে বাঁশ হাতে রুদ্রমূর্তি ছেলে্র দল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যখন দাঁড়িয়ে আছি, তখনই চোখের উপর একটা তীব্র আলো, টর্চের। প্রতিবর্ত ক্রিয়াতে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ারই কথা ছিল। তার মধ্যেই বুঝতে পারলাম টর্চের আলোটা আমাদের বাঁদিকে সরে যেতে বলছে। লাইটম্যানের সেই আলো অনুসরণ করা ছাড়া আমাদের করার কিছু ছিলোও না। বাঁদিকে সরে আসতেই একটা সরু গলি পেয়ে গেলাম। সুট করে গলিতে ঢুকতেই ডানদিকে একটা ছোট দরজা। ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকতেই সামনে সেই লাইট ম্যান। দরজা তাড়াতাড়ি আটকে দিল সে। বাইরে তখন কুরুক্ষেত্র। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছি আমরা। তবে বেশিক্ষণ চলেনি সেই যুদ্ধ। সিনেমার রিল এসে গিয়েছিল, আর যুদ্ধের দুই পক্ষই শাহরুখকে সিটি মারতে শুরু করে দিয়েছিল। আমি শুধু সেই অন্ধকারে ডিটেকটিভ বাদশার মতো খুঁজে যাচ্ছিলাম সেই তীব্র আলোটাকে।

সেই সময়কালে আমার জীবনে ক্রিকেট, সিনেমা আর সিআরডিজি এক সাথে চলছিল। বাঁশবেড়িয়ার স্বপনপুরী সিনেমাহলে একবার খুড়তুতো বোন পিউয়ের সাথে গিয়েছিলাম ‘বর্ডার’ দেখতে। সিনেমার মাঝামাঝি হলে ঢুকে পড়লো এক প্রমান সাইজের গরু। মনে হয় তারও এন্টারটেনমেন্টের দরকার ছিল। সমাধান সেই লাইটম্যান। পর্দায় যখন সানি দেওল গুলি চালিয়ে পাকিস্থানী সৈন্যদের তাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন সেই লাইটম্যান গরুটিকে হলের বাইরে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। অস্ত্র শুধু সেই টর্চ। আদি সপ্তগ্রামে এক ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলাম। কি এক কারণে খেলা না হওয়ায়, টার্গেট নেওয়া হলো মগরার রামকৃষ্ণ হলে নুন শো দেখতে যাওয়া হবে। ব্যাট, উইকেট নিয়ে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে যাওয়া হলো হলে। কিন্তু এই ব্যাট উইকেট কোথায় রাখা যায়। সাইকেল গ্যারেজ রাখতে নারাজ। মুশকিল আসান সেই এক লাইটম্যান। টিকিট কাউন্টারের ঘরের এক কোণে ডাঁই করে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো সে সব। ‘অরো’তে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’র ফার্স্ট শো শেষ করে বেড়িয়ে বেড়িয়ে আসার সময় দেখেছি লাইটম্যান টর্চ জ্বালিয়ে মেঝেতে খুচরো পয়সা খুঁজছে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আশুতোষে ভর্তি হয়েছি। মাঝে মাঝেই টালিগঞ্জের প্রদীপে পানু দেখতে যাওয়া বাঁধা। এক বর্ষার দিন আয়েশ করে ছবি দেখছি, লাইটম্যান এসে মৃদু স্বরে বলে গেল—জল ঢুকতে পারে পা তুলে বসো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উর্বশীতে আমাদের ফি সপ্তাহের টাইমপাশ বসত। মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল লাইটম্যানদের সাথে।

বাংলার সিনেমা হলগুলোর তখন শেষ দশা চলছে। ঘরঘর শব্দ তুলে ঘরতে থাকা পাখা, ভাঙ্গা চেয়ার, এসবেস্টারের চাল থেকে বৃষ্টির জল নামা, অস্পষ্ট সাউন্ড সিস্টেমের মতোই ধুকতে থাকছিল সিনেমা হলের স্টাফরা, লাইটম্যানরা। বাজার দখল নিচ্ছে ক্রমশ আইনক্স, ফেমের মতো মাল্টিপ্লেক্সরা। উপরি পাওনা পাইরেটেড সিডির রমরমা বাজার। কেউ কেউ পানু চালিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও ততদিনে সিডি আর ইন্টারনেটের জমানা এসে গেছে। এই সময়টায় কিছু বছরের জন্য চলে যাই দার্জিলিংয়ে, কাজের সূত্রে। এই জগতের সাথে কেমন একটা বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ওখানে আইনক্স আর পাইরেটেড সিডিতে তৃষ্ণা মেটানো চলতো। ফিরে এসে একবার গিয়েছিলাম ‘রূপালী’তে, প্রেমিকাকে নিয়ে। ঋতুপর্ণের ‘খেলা’ দেখবো বলে। হাতে সময় ছিল, তাই টিকিট কেটে দুজনে সামান্য মার্কেটিং করবো। বেড়িয়ে আসছি, মুখ চেনা লাইটম্যান শুকনো হাসলো। হাসিটা বড়ই শুকনো। মার্কেটিং করে ঠিক সময়ে হলে ঢুকতে যাবো, মুখোমুখি সেই লাইটম্যানের। ‘এই শো’টায় ছয়জনও হয়নি। শো ক্যান্সেল হয়ে গেছে। টিকিটের টাকা ফেরত নিয়ে নিন’। একটু আগে দেখা সেই শুকনো হাসিটাও সেই সময় ছিল না ওর মুখে।

এরপর গঙ্গা দিয়ে যত জল বয়ে গেছে, তত ভাঙ্গা পড়েছে একের পর এক সিনেমা হল। উর্বশী ভেঙে বহুতল উঠে গেছে। অন্নপূর্ণা, অরো নিশ্চিহ্ন। একের পর এক সিনেমা হলের তালা মরচে পড়ছে। ২০১৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল এক চালু সিনেমা হলে। এক তলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আর ড্রেস সার্কেলে খাওয়া দাওয়া। ট্রেনিং সেলের প্রধান হওয়ায় প্রথম দিন থেকেই হল মালিক কাকুতি মিনতি করে যাচ্ছে দুপুর সাড়ে তিনটের মধ্যে কাজ শেষ করে দেওয়ার জন্য। যাতে চারটের শো ঠিক মতো চলতে পারে। কিন্তু সরকারী কাজ কখনই বা ঠিকমতো সময়ে মিটেছে। ট্রেনিং শেষে খাওয়া দাওয়া করতে উপরে গেছি, হঠাৎ নজরে পড়লো—শেষ রো’য়ের সামনেটা প্লাই দিয়ে ঘেরা। কি ব্যাপার? খোঁজ শুরু করলাম। হল মালিক কিছুতেই ঝেড়ে কাশবে না। হলের পারমিশনের এনওসি আমাদের অফিস থেকেই যায়। সে কারনে সে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছে কিন্তু ট্রেড সিক্রেট কেই বা কবে বলেছে। এক লাইটম্যানের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানা গেল—ওটা কেবিন সিস্টেম। শেষ রো’তে দুজন দুজন একসাথে বসার ব্যবস্থা। পাশে রীতিমত প্লাইয়ের পাঁচিল। সামনে চোখের উচ্চতা পর্যন্ত প্লাইএর দেওয়াল। সামনে থেকে কিছু দেখারও উপায় নেই। আসেপাশের কলেজ স্টুডেন্টদের কাছে এই সিটের চাহিদা বিপুল। শেষ দিনের ট্রেনিং তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় চার’টের শো চলেছিল। আমরা ফ্রি পাশ নিয়ে সেই কেবিনে বসে একটা নাম ভুলে যাওয়া সিনেমা দেখেছিলাম। আমার পাশে বসেছিল জয়ন্তদা। তার পাশের কেবিনে দুর্গা আর এপিও ম্যাডাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধু পথ চিনিয়ে দিয়েছিল লাইটম্যানের টর্চ।

এখন অনেক রাত করে যখন বাড়ি ফিরি তখন লিফট পর্যন্ত আমাকে আলো দেখায় আমার ফ্ল্যাটের নাইটগার্ডের টর্চ। একদিন রাত করে ফ্ল্যাটে ঢুকছি, দেখি, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে আছে আমাদের নাইটগার্ড।

- কী দেখছেন?

- কিছু না স্যার। চমকে উঠে বলে প্রৌঢ় নাইট গার্ড। মুচকি হেসে টর্চের আলোর বৃত্ত ফলো করে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ আমার প্রৌঢ় আলোকশিখা বলে উঠলো,

- স্যার রোজ বাড়ি ফিরে আপনিই তো পুরোনো গান চালান। শুনে তো মনে হয় ফোর ডি থেকেই আসছে।

- হুম আমার ফ্ল্যাটেই গান চলে, তবে খুব আস্তে।

- খুব ভালো লাগে স্যার।

লিফট উঠে যায় চারতলায়। আলোর ছিটে পড়ে থাকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে।

রাতে ঘুম আসছে না। ব্যালকনিতে বসে গান শুনছি। সলিল চৌধুরী। নিচে তাকিয়ে দেখি নাইটগার্ড হা করে তাকিয়ে আছে ফ্ল্যাটের শরীরের দিকে। মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে ওর হাতের টর্চ। কি মনে হওয়াতে নিচে নেমে এলাম। লিফটের ভিতরের আলো জোড়া কোলাপসিপবল গেট পেরিয়ে ছড়িয়ে গেল গ্রাউন্ড ফ্লোরের মুখটায়। এখান থেকেও হালকা শোনা যাচ্ছে সলিল চৌধুরী। বাইরে বেড়িয়ে এলাম। রাস্তার ওপারে একটা ভেপার ল্যাম্প। আমার ফ্ল্যাটের সামনেটা একটা বড় অশ্বত্থ গাছ। ভেপার ল্যাম্পের আলোয় ফ্ল্যাটের দেওয়ালে অশ্বত্থের ছায়া। হাওয়ায় গাছটা আলতো দুলছে। আর ফ্ল্যাটের দেওয়ালে চলছে ছায়ার খেলা। শ্যাডোগ্রাফি। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।  

- ছায়াছবি। তাই না স্যার? প্রৌঢ়ের কন্ঠে চমকে উঠি আমি। খানিকটা বোকাবোকা খানিকটা হাসি মেশানো মুখ করে চেয়ে থাকি আমি।

- আমি যখন লাইটম্যান ছিলাম স্যার তখন থেকেই এমন আলো অন্ধকারের খেলা বড় ভালো লাগে আমার।

সাদা কালো স্ট্রাইপের ইউনিফর্মের কথায় আমি চমকে উঠি। তারপর কথা চলতে থাকে। লকআউট থেকে একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়া ওর সিনেমা হল। চাকরি চলে যাওয়া। ইমারতটা ভেঙে যাওয়া। আবার গড়ে ওঠা, তবে মাল্টিস্টোরেড হয়ে। আর আমার ফ্ল্যাটের গায়ে ফুটে ফুটে ওঠে অশ্বত্থের ছায়া। ছায়াছবি চলতে থাকে।

- স্যার অনেক রাত হলো। এবার চলুন। আপনাকে এগিয়ে দিই।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাইটম্যানের পিছনে পিছনে টর্চের আলোকবৃত্ত অনুসরণ করতে থাকলাম। অনুসরণ করতে থাকলাম আমার ছোটবেলার ‘এইম ইন লাইফ’কে। অনুসরণ করতে থাকলাম রোজ রোজ সিনেমা দেখার হিংসেটাকে। লিফটের সামনে এসে টর্চের আলো মিশে গেল। কোলাপসিবল গেট খুলে দিলেন প্রৌঢ়। আমি ভিতরে ঢুকলাম। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর মুখ। উনি টর্চের আলো ফেললেন উপরের দিকে। গন্তব্য ফোর ডি। যেখান থেকে এখন ভেসে আসছে আলতো সলিল চৌধুরী – ও আলোর পথযাত্রী...। আমি জানি আমি, এই ফ্ল্যাটের সবাই, সামনের রাস্তার কুকুরগুলোও ঘুমিয়ে পড়লেও ফ্ল্যাটের শরীরে ছায়াছবি চলতে থাকবে অশ্বত্থের লতাপাতার। লোকটাকে জিজ্ঞেস করা হলো না, ওর পকেটে কি এখনো সেই সিনেমা হলের টর্চটাই?

লেখক চমক মজুমদার
১০৫ সার্ভে ভিউ পার্ক, ব্যান্ডেল, হুগলি
























  

0 Comments